কন্যাযাত্রী
কাফি কামাল
গর্জনবুনিয়ার পশ্চিম ঢাল বেয়ে গড়িয়ে নামছে দুপুর। সদ্য নেভানো চুলোর মতো ঠাণ্ডা হয়ে আসছে সূর্যের তেজ। মৃদু বাতাসে অঘ্রাণের ধানকাটা মাঠের নাড়ার মতো সুর ওঠেছে চ্যাপ্টামুড়ার মৌলভী বাড়িতে। বরকনে দু’পক্ষের মেহমানরা সমবয়সীদের নিয়ে আড্ডা জমিয়ে তুলেছেন। আড়ালে-আবডালে চলছে হালকা রঙ্গ-রসিকতাও। না দেখা জামাই নিয়ে কনে দিনারাকে অন্দর মহলে টিপ্পনি কাটছে বুড়ি দাদী-নানীরা। তা শুনে হাসিতে গড়িয়ে পড়ছে তরুণীরা। তবে ভেতর বাড়ির খোশালাপ বাইরে উঠোনের পুরুষ মানুষের কানে একটা আবছা রেশ ছড়িয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। মৌলভী বাড়ির অন্দরে পুরুষ মানুষের অবাধ যাতায়াত নিষিদ্ধ। বিয়ে-শাদী উপলক্ষেও কোন গান-বাজনা নেই। নেই তেমন হৈ হুল্লোড়ও। আছে কেবল কনের দাদা সিকান্দার মৌলভীর হাঁক-ডাক আর বাচ্চাদের হইচই। তারপরও বিয়েবাড়ির কিছু স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য চ্যাপ্টামুড়ার চূড়া ছুঁইয়ে গেছে। হাঁটাচলায় শাহেদের কানে অন্দর মহলের দু-এক টুকরো হাস্যরস অনুরণন তুলেছে। ওদিকে বরপক্ষ এটা আনেনি, ওটা আনেনি ইত্যাদি মেয়েলী অনুযোগে, হৈ হল্লায় সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে।
কি একটা প্রয়োজনে দিনারার মাকে খুঁজতে গিয়ে পাশের বারান্দায় দিনারাকেই চোখে পড়ে শাহেদের। বিয়ের শাড়িতে দিনারাকে পরীর মতো লাগছে। তার চোখ দু’টো জলে ভেজা। কিছুক্ষণ পরই তাকে না দেখা জামাইর কাছে নিজেকে আজীবনের জন্য সমর্পণ করতে যেতে হবে। সমুদ্র তীরবর্তী দূরের এক গ্রামে। মেয়েরা নাকি স্বর্গে যাওয়ার আগমুহূর্তেও রান্নাঘরে একটা ঢুঁ মেরে যায়। দিনারাও শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার আসে বিয়েবাড়িতে ব্যস্ত মাকে এটা-ওটা এগিয়ে দিচ্ছে। শাহেদকে দেখেই সে দ্রুত আঁচলে মুখ ঢাকে। শাহেদ নীরবে দ্রুত বেরিয়ে যায়।
ঘরভর্তি মেয়েদের চোখে জল, কণ্ঠে চিরায়ত কনে বিদায়ের শোক। বরযাত্রীরা দুপুরের খাওয়ার পর্ব শেষ করে ফেরার তাড়া দিচ্ছেন। কয়েকজন বয়স্ক বরযাত্রী খানাপিনা সেরে ছুটেছিলেন মসজিদের উদ্দেশে। ছেলে-ছোকরারা ভিড় করছিল পাড়ার দোকানে। সবাই এখন চ্যাপ্টামুড়ার চূড়ায় কনেবাড়ির উঠোনে ফিরে আসছে। নীরবে এটা-ওটা আনা-নেয়া করছেন কনের বাবা নুরুল করিম মৌলভী। তার চোখও টলমল। তিনি পাঞ্জাবির খুঁট দিয়ে চোখের পানি মুচছেন। বড় মেয়ের বিয়ে দিয়ে মন ভরেনি তার। দ্বিতীয় মেয়ের বিয়েতেও মনের মতো আয়োজন করতে পারলেন না। বুড়ো পিতার হাঁকডাকের কাছে বড্ড অসহায় নূরুল করিম মৌলভী। তবে নাতনিকে শ্বশুর বাড়ির মুরব্বীদের হাতে হাওলা করে দিতে দিনারার দাদা সিকান্দার মৌলভীর তাড়ার অন্ত নেই। উঁচুস্বরে হাঁক দিচ্ছেন- কই রে তাড়াতাড়ি কর। তাড়া কর, সূর্য যে ডুবে যায়। সন্ধ্যা হয়ে আসছে।
খ.
বন্ধুর ছোট বোনের বিয়েতে চল্লিশ কিলোমিটার দূর থেকে চ্যাপ্টামুড়া এসেছে শাহেদ। সমুদ্রের ঘ্রাণযুক্ত শরীরে হাজির আরেকবন্ধু মোশতাক। বিয়েবাড়িতে প্রথম পরিচয়েই তাদের সঙ্গে আড্ডা জমিয়ে তুলেছেন কনের ফুফাতো ভাই মোরশেদ। আগের রাত থেকেই গল্প, আড্ডা, বিয়েবাড়ির ছোটখাটো নানা কাজে আনন্দের মধ্যেই কেটে গেছে সময়।
কনে বিদায়ের আসে দিনারার বড়ভাই জয়নাল বন্ধুদের কন্যাযাত্রী হওয়ার প্রস্তাব দেয়। বলে- চলরে শাহেদ রাজাখালী যাই...।
কে কে যাচ্ছে? শাহেদের কৌতূহলী জিজ্ঞাসা।
মোরশেদ এবং মোশতাকও যাবে। ছেলে-বুড়োরা তো আছেই। জয়নালের হাসিমাখা উত্তর।
চল্। তাহলে নতুন জায়গা দেখা হবে। সমুদ্রতীরের গ্রামে জামাইবাড়িতে নিশ্চয় খুব আনন্দ হবে। জয়নালের প্রস্তাবে কন্যাযাত্রী হতে এককথায় রাজি হয়ে গেল তিনবন্ধু। জয়নাল তাড়া দেয়- দ্রুত কর। কিছুক্ষণের মধ্যেই দিনারাকে নিয়ে বরযাত্রীরা রওনা দেবে।
পুরনো আমলের লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা জিপে চড়ে বিকাল নাগাদ শুরু হলো কন্যাযাত্রা। একটিতে দু’পক্ষের পুরুষ অন্যটিতে মেয়েদের নিয়ে হেলেদুলে চলতে শুরু করলো জিপ দু’টো। ধুলো ওড়া, খোয়া ভাঙা মেঠোপথ ধরে জিপ চলছে। রাস্তার দু’পাশ থেকে গ্রাম্য বৌ-ঝি’রা বেড়ার ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে উঁকি দিচ্ছে। হাফপ্যান্ট পরা শিশু আর লুঙ্গির কাছা মারা বালকগুলো জিপের পেছনে পেছনে দৌঁড়াতে দৌড়াতে ধুলো খেয়ে হাঁপিয়ে উঠছে। কন্যাযাত্রী বুড়োরা কখনও ধমক দিয়ে কখনও হাতের লাঠি দেখিয়ে শিশুদের দৌড় থামিয়ে দিচ্ছেন। জিপগুলো যখন আঁকাবাঁকা মেঠোপথ ভেঙে বাঘগুজরা স্টেশনে পৌঁছে তখন আসরের নামায শেষ করে মুসল্লিরা বেরিয়ে আসছে।
মুসল্লীদের দেখেই বরযাত্রী আবদুস সালাম আপসোস করে- নামাযটা কাজা হয়ে গেল। গাড়ি একটু পরে ছাড়লে হতো না।
পাশে বসা আবদুল কাইয়ুম ভেংচি কাটে... আরে আমার নামাযি। সবাই নামায পড়েই গাড়িতে ওঠলো আর সালাম ভাই হাওয়া খেয়ে।
কাইয়ুমের কথা শুনে সালাম প্রথমে অবিশ্বাসের সঙ্গে তাকালেও পরক্ষণেই লজ্জায় চুপ মেরে গেলেন।
সুযোগ পেয়েই শাহেদ দুষ্টুমি করেÑ এক ওয়াক্ত নামায কাজা করলে ২৪ খুতবা দোজখের আগুনে জ্বলতে হবে।
শাহেদের কথাটা কেড়ে নিয়েই বর ও কনেযাত্রী কয়েকজন বুড়ো ধর্মালাপ শুরু করে দিলেন। শাহেদ তখন মোশতাককে চিমটি কেটে দেখালেন পাশের বাড়ির একটি তরুণীকে কিভাবে উঁকি মারছে।
মোশতাক মৃদু হেসে বলে- দোস্ত, একদম দোস্ত।
বাঘগুজরা থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে ছোট পাকা রাস্তাটি পেকুয়ার দিকে চলে গেছে। বর্ষাকালে প্রচুর কাদামাটির কারণেই নাকি লোক মুখে এ নামকরণ। কিছুদিন আগেও বর্ষাকালে এ অঞ্চলের মানুষের দুর্ভোগের অন্ত ছিল না। এখনও পেকুয়া থেকে চকরিয়া যাতায়াতে জিপই ভরসা। কিন্তু রাত বাড়লে তাও মেলে না। চারদিকের দৃশ্য অবলোকন করে শাহেদের মন ভরে উঠে। অন্যরা যখন নানা গল্পগুজবে মেতে ওঠেছে তখন শাহেদ দেখছে প্রকৃতি। অঘ্রাণের ধানকাটার পর হলুদ নাড়া মেটে হলদে আভা ছড়িয়ে দিয়েছে দিগন্তব্যাপী। পেকুয়া স্টেশন থেকে গাড়ি পশ্চিম দিকে বাঁক নিতেই বিশাল ধুঁ ধুঁ বিল। আঁকাবাঁকা রাস্তা পশ্চিম দিকে চলে গেছে রাজাখালী অভিমুখে। মোশতাক ও মোরশেদের নানা গল্প, ভেতরে বুড়োদের নানা মন্তব্য আর উজ্জ্বল শ্যামলা একটি তন্বী বরযাত্রীর চোখাচোখি হয়ে মাঝে মধ্যে ছেদ পড়ছে শাহেদের প্রকৃতি ভোগে। জিপ দু’টো পেকুয়ার সবুজ বাজার পৌঁছতেই ক্লান্ত সূর্য হেলে পড়লো। সেমিপাকা টিনশেড কয়েকটি দোকানে নিয়ে গড়ে ওঠা সবুজ বাজার পেরুতেই চারদিকে লবণের ধুঁ ধুঁ মাঠ। কানে ভেসে আসছে সমুদ্রের গর্জন। জামাইবাড়ি পৌঁছাতেই সূর্য ডুব দেয় বঙ্গোপসাগরে। নুনের মাঠ থেকে বাড়ি ফিরছে সুঠাম দেহের ঘামে ভেজা নুনচাষিরা। নুনের মাঠে বিচ্ছিন্ন একেকটি বাড়ি নিয়ে রাজাখালীর গ্রামগুলো। নারকেল গাছ আর ছোট ছোট পুকুর নিয়ে প্রতিটি বাড়িই যেন মাঠের সমুদ্রে একেকটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ।
শাহেদের মনে পড়ে ’৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের কথা। মনে করিয়ে দিতেই হু করে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে মোশতাক। তারপর উদাস কণ্ঠে বলে- সে কি ভোলার মতো ঘটনা রে...। তারপর স্বগোক্তি করে বলে- বিরান ভূমিতে পরিণত হয়েছিল। চারদিকে লাশের পর লাশ। ভেসে এসেছে কুতুবদিয়া, মাতারবাড়ি আর মগনামা থেকে। আমার মেঝ ফুফুর লাশই তো পাইনি।
শাহেদের চোখ তখন অনুসন্ধিৎসু হয়ে ওঠে। যেন ঘূর্ণি তাণ্ডবের অস্তিত্ব খুঁজছে।
গ.
জিপগুলো ধুলো উড়া পথ মাড়িয়ে জামাইবাড়ির অদূরে এসে থামলো। অল্প একটু পায়ে হাঁটা পথ পেরুলেই নারকেল গাছে ঘেরা জামাইবাড়ি। আঙ্গিনায় ঢুকেই এক ধরনের বিদঘুটে আবহাওয়া নাকে মুখে ঝাপটা দিয়ে গেল শাহেদের। পাড়া প্রতিবেশীরা বরের আঙ্গিনায়ও ঢুকলো না। জিপ থেকে নেমেই যে যার বাড়িতে চলে গেলো। বরের আত্মীয়-স্বজনরা ব্যস্ত হয়ে উঠলেন নিজেদের নিয়েই। উঠোনে ধান শুকানোর তলুই বিছিয়ে বসার ব্যবস্থা করা হলো কন্যাযাত্রী কয়েকজন বুড়োর। মেয়েরাও নিজেদের মতো করে বাড়ির ভেতরে বসার জায়গা খুঁজে নিয়েছে। কিন্তু বাইরে দাঁড়ানো কন্যাযাত্রী জোয়ান ছেলেগুলোর দিকে কারও নজর নেই।
বন্ধুদের কথা ভেবে ছোট হয়ে যাচ্ছিল কনের ভাই জয়নাল। রাগে-অপমানে তার মুখের শিরা ফুলে ওঠেছে। ঠোঁট কামড়াতে কামড়াতে সে পায়চারী শুরু করে। এ কেমন বাড়ি রে বাবা! প্রতিবেশীদের আনাগোনা নেই। আত্মীয়-স্বজনের হৈ হুল্লোড় নেই। সামিয়ানা আর আলোকসজ্জা নেই। রঙিন কাগজের ফুল পর্যন্ত লাগানো হয়নি দরজায়। শাহেদ কিছুটা অবাক হয়। আঙিনায় নারকেল গাছে হেলান দিয়ে গল্পে মেতে ওঠা শাহেদ ও মোরশেদকে দু’টো মোড়া এনে দেয় একটি ছেলে। দিনারার জামাই তখনো বাজার থেকে ঘরে ফিরেনি। দু’কিলোমিটার দূরেই রাজাখালী বাজারে তার তেলের দোকান। মাছমারা ট্রলার ও ইঞ্জিন নৌকায় তেল সাপ্লাই দেয়। বিয়ের দিনেও দোকানে তেল বেচাকেনা করছে, শুনেই শাহেদের মনটা কুচকে যায়।
কন্যাযাত্রী আর আত্মীয়-স্বজনরা বরের জন্য অপেক্ষা করছে। তরজা বেড়ার ফোকর দিয়ে ঘরের ভেতর থেকে মাঝে মধ্যে মহিলাদের ফোড়ন কাটা আর মুখ ঝামটার শব্দ কানে আসছে। দিনারার মামা শ্বশুর কুদ্দুস মেম্বারের মধ্য বয়সী স্ত্রীর অট্টহাসির শব্দগুলো বেশ জোরালো। এরই মধ্যে শাহেদের পরিচিত হয়ে ওঠেছে ওই হাসির শব্দ। পৃত্থুলা আকৃতির বাচাল মহিলাটি দুপুর থেকেই কথায় কথায় হাসির ধমক ছড়াচ্ছেন। নিজেই বলেন, নিজেই হাসেন। অলঙ্কার সজ্জিত শরীরের অহঙ্কারী ভাঁজ খুলে কন্যাযাত্রী মহিলাদের সঙ্গে মেয়েলী ঠাট্টা-মশকরা করে যাচ্ছেন। বাইরে কন্যাযাত্রীদের সঙ্গে কথাবলার লোক নেই। কেউ এসে জিজ্ঞেসও করছে না। বুড়োরা নিজেদের মতো গল্পগুজবে মেতে ওঠলেও শাহেদদের নিঃসঙ্গটা ঘুচে না। তার মনে হচ্ছে, এ কোন আবোলাইন্যা মেজবানে এসে পড়েছি। যে বাড়িতে অনুষ্ঠান সে বাড়ির লোকজন কথার খাতির না করলে নিজেকে কেমন ছোট ছোট লাগে। মনে হয় অযাচিত। মোরশেদের সঙ্গে এলোমেলো গল্প লতিয়ে ওঠলেও তার ভাল লাগছে না।
চট্টগ্রামের বিয়ের সঙ্গে কোন মিলই নেই। এজন্য শাহেদের বিস্ময়টা একটু বেশি। বৃহত্তর চট্টগ্রামের লোকজনের মেহমানদারীর সুনাম দেশজোড়া। চট্টগ্রামে বিয়ে বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া, আদর-আপ্যায়নের জুড়ি মেলাভার। লোকে বলে, পাতিলে চাল না থাকলেও খরচের হাত খোলা। চট্টগ্রামের লোকজনের মধ্যে এ নিয়ে একটি অহঙ্কারও আছে। এখানে খাবার চেয়ে কথার মান বেশি।
শাহেদ শুনেছে সমুদ্রতীরের মানুষ সাহসী ও উদার হয়। এখন মনে হচ্ছে, তাদের মধ্যে হিংস্রতা আর অসামাজিকতাও আছে। নাকি ভুল বিচার করছে? একটি বাড়ির লোকজনের আচরণে পুরো এলাকার চরিত্র বিচার করা কি ঠিক?
উঠোনে একটি চেয়ারে বসে পায়ের ওপর পা তুলে বরের কনিষ্ঠ কবির চার ব্যান্ডের রেডিও নিয়ে বসেছে। রেডিওর নব-এ স্টেশন ঘোরাতে ঘোরাতে সে খুব রসিয়ে রসিয়ে বিদেশের গল্প শুরু করে। হা করে গিলছে কয়েকজন বুড়ো লোক। মনে হচ্ছে কোন প্রবাসী দীর্ঘদিন পর বাড়ি ফিরেছে। সবাই তাকে ঘিরে সাত সমূদ্র তের নদীর গল্প শুনছে। কবির ছিটগ্রস্তদের প্রলাপের মতো গল্প করেই যাচ্ছে। কিন্তু বিরক্ত লাগছে শাহেদের। কোন সুস্থ সামাজিক লোক কি বিয়েবাড়িতে মেহমানদের প্রজার মতো বসিয়ে নিজে জমিদারের মতো গল্প শোনায় নাকি। কার গল্প কে শোনে, কে কার চেয়ে কম। লোকটা পাগল নাকি!
ঘ.
অপেক্ষা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। বরের দেখা মিলছে না। কন্যাযাত্রীদের মুখে মুখে ঘুরপাক খাচ্ছে একই প্রশ্ন- কখন আসবে বর? বর এলেই না সম্পন্ন হবে আক্দ। কন্যাযাত্রীদের বেশিরভাগই আসে বরকে দেখেনি। দিনারার দূর সম্পর্কের এক দুলাভাইয়ের ঘটকালিতে বিয়ের ঠিক-ফর্দ হয়েছে। তিনিই দিনারার দাদাকে বর ও তাদের আত্মীয়-স্বজনের ব্যাপারে নানা কথা বাড়িয়ে বলেছে। দিনারার দাদার কারণে কেউ আগ বাড়িয়ে রাজাখালী গিয়ে বর বা তার ঘরবাড়ি দেখেনি। বুড়োর এক কথা- বাজারে তেলের দোকান আছে, এক দুনের নুনের মাঠ আছে, দেখতে শুনতেও মন্দ নয়। তাই কারও দেখতে যাওয়ার দরকার নেই। বেশি খোঁজ নিতে গেলেই দুষ্ট লোকরা ত্রুটি বের করে। এখন বরের বাড়ি পৌঁছেই মন খারাপ হয়ে গেছে দিনারার ভাই জয়নালের। রাত যত বাড়ছে ততই হাফিয়ে ওঠছে কন্যাযাত্রীরা। বুড়োরাও হাঁক দিচ্ছে- কই গো আমাদের নাতজামাই কই?
শাহেদ আর মোরশেদ উসখুস করছে। মোশতাক তাকিয়ে আছে জয়নালের বেদনার্ত চেহেরার দিকে। তাদের কিছুই ভাল লাগছে না। সামুদ্রিক হাওয়ায় ক্ষুধা-তৃষ্ণা দু’টোই উসকে দিচ্ছে। তৃষ্ণায় বুকটা ফেটে যাচ্ছে শাহেদের। এতক্ষণ একটির পর একটি সিগারেট টানতে টানতে তার কলজে পর্যন্ত যেন শুকিয়ে গেছে। সে ইশারায় একজন বয়সী লোকের কাছে খাবার পানি চাইলেন। লোকটি দ্রুত ওঠে গিয়ে কিছুক্ষণ পর ফিরে এলো খালি হাতে। কানে কানে বললেন, মেয়েদের কারণে তিনি ভেতরে যেতে পারেননি। এবার মোশতাক বাড়ির ভেতরে ঢোকে। কিছুক্ষণ পর সেও বেরিয়ে আসে খালি হাতে। বিরক্তি প্রকাশ করে বলে, কেমন বাড়ি রে বাপ। চারবার বলার পরও কেউ এক গ্লাস পানি দিল না!
এবার জয়নাল বেয়াই কবিরকে বলে- কি ভাই একটু পানিও খাওয়াবেন না?
কবির একজনকে হাক দেয়। লোকটি বেরিয়ে এসেই জানায়- শরবতের ব্যবস্থা হচ্ছে।
সময় গড়িয়ে আধঘণ্টা পেরিয়ে যায়, পানি আসে না। শাহেদ মনে মনে হাসে। এখানকার মানুষ কি পানিও খায় না। আশপাশে নলকূপও দেখা যাচ্ছে না। মোরশেদ পেছন থেকে চিমটি কাটে শাহেদের। দুইজন বাড়ির উত্তরদিকের পুকুরে যায়। নারকেল গাছ দিয়ে বানানো ঘাটে বসে তৃষ্ণা মিটিয়ে পানি খায়। হাত-মুখ ধোয়। মোরশেদ বলে- পানিতো দেখি ডাবের চেয়ে মিষ্টি। তারপর দু’জনই হেসে ওঠে।
শাহেদ খেয়াল করে প্রতিবেশীদের মধ্যে বিয়েবাড়ি নিয়ে তেমন আগ্রহ নেই। লোকজন নানা টিপ্পনি কাটছে। গল্পচ্ছলে শাহেদ পাশের বাড়ির মধ্যবয়সী একজনকে জিজ্ঞেস করলো- কি ভাই আপনাদের দেশে কি বিয়েবাড়িতে হৈ হুল্লোড় হয় না?
লোকটি মৃদু ভেংচি কাটে। ওই বাড়িতে হৈ হুল্লোড়, নাউযুবিল্লাহ!
কথাটি শুনেই মোরশেদের মুখটি কালো হয়ে গেল। অচেনা এ লোকটি যেন তাদের গালে কষে থাপ্পড় দিয়েছে। হাজার হলেও মামাতো বোনের শ্বশুরবাড়ি। শাহেদ ও মোরশেদ হাঁটতে হাঁটতে পাড়ার উত্তর দিকের একটি গাছের নীচে এসে দাঁড়ায়। পকেটের সিগারেটও ফুরিয়ে গেছে। আশপাশে কোন দোকানও দেখা যাচ্ছে না। যার কাছেই জিজ্ঞেস করে সেই গাল দেয়ার মতো করে উত্তর দেয়- রাজাখালী যান।
দুইকিলোমিটার দূরেই রাজাখালী। পথ বেশি নয়। মন ভাল থাকলে দূরত্ব নস্যি। বিয়েবাড়ির গোষ্ঠী উদ্ধার করতে করতে তারা নিজেদের নিয়ে আলাপে মেতে ওঠে। কিছুক্ষণ পর মোশতাকও যোগ দেয়। বলে, তোদের খুঁজতে খুঁজতে এদিকে চলে এলাম।
মোশতাক স্বগোক্তি করে- ভালই হলো, ওই যে আমার মামির বোনের বাড়ি। চল সেখানে যাই। এমন পানসে বিয়ে বাড়ির চেয়ে দূরসম্পর্কের আত্মীয় বাড়িই অনেক ভাল।
শাহেদ সায় দেয়- চলো।
মোশতাকের মামীর বোনের বাড়ির উঠোনে ঢুকতেই চোখে পড়ে তলুই বিছিয়ে খোশগল্প করছে নুনের মাঠ ফেরত কয়েকজন যুবক। তাদের দেখেই একজন হাঁক দেয়- আপনারা কারা? মোশতাক নাম বলতেই বাড়ির মেঝ ছেলে সালাম রীতিমতো লাফিয়ে ওঠে। আরে মোশতাক তুই! অন্যরাও ওঠে দাঁড়ায়। বাড়ির ভেতর থেকে দু’টি হাতল ভাঙা চেয়ার আর মোড়া এনে তাদের বসতে দেয়। বিয়েবাড়ির কথা শুনতেই সালাম হেসে ওঠে। শাহেদ খেয়াল করে আবারও মোরশেদের মুখটা কালো হয়ে গেছে। কথা বলতে বলতেই শরবত আর বিস্কুট নিয়ে এলো বাচ্চা একটি মেয়ে। মেঘ না চাইতেই জল, কি ব্যাপার। শুরু হয়ে গেল আড্ডা। নুনের মাঠ থেকে মধ্যপ্রাচ্য, কলেজ থেকে জনপ্রতিনিধি... হাজারও কথা। এরই মধ্যে তাসের প্যাকেট জোগাড় করে ফেলেছে মোশতাক। তাকে একটি ধন্যবাদ দিয়েই শুরু হলো টুয়েন্টি নাইন।
রাত তখন সাড়ে ১০টা। খেলা জমে ওঠলেও মোরশেদের পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে রাগে। এতক্ষণেও বিয়ে বাড়ির কেউ তাদের খোঁজও নেয়নি। বিয়ের দিন দোকানদারি করে শ্বশুর বাড়ির লোকজনরে দেখাচ্ছে শালা বর। মনে মনে গাল পাড়ে আর আস্তে করে মোশতাককে চিমটি কাটে। চিমটি খেয়েই তাড়া দেয় মোশতাক। চল বিয়েবাড়ি যাই। বর এসেছে কিনা দেখি। সালাম ক্ষেপে উঠেÑ আরে কতদিন পর বেড়াতে এসেছো ভাত খেয়ে যাও, রাতে থাকো।
এ বাড়ির লোকজনের আতিথেয়তায় শাহেদ মুগ্ধ। তবে হঠাৎ কোন বাড়িতে এসেই ভাত খেতে বসে যাওয়া ভাল দেখায় না। ভেতরে আগ্রহ থাকলেও বাইরে তাড়া দেখায় তারা। সালাম তাদের বিয়ে বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিলেও বিয়ে বাড়িতে ঢুকে না। শাহেদের অনুরোধও বিনীতভাবে এড়িয়ে গেল।
ঙ.
বরের কোন খোঁজ নেই। মুরব্বীদের কেউ কেউ উঠোনে বসেই ঘুমে নাক ডাকতে শুরু করেছে। অন্যরা বিরক্ত মুখে অপেক্ষা করছেন। তাদের সঙ্গে আসা নঈম ভেতরে গিয়ে একটি চক্কর কেটে এসে মন্তব্য করলেন, কি মুখরা একেকটি বুড়ি। দিনারা চোখের জলে একাকার। মেয়েগুলো নানা রকম খোটা দেয়া শুরু করেছে। কুদ্দুস মেম্বারের বউটা, একটি দজ্জাল। সারা শরীরে অলঙ্কার পরে বাড়ি জুড়ে পায়চারী করছে আর তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করছে। শুনে শাহেদ অবাক হয় না। বিকালে জিপে বসেই তো মহিলাটি নানা মন্তব্য করছিল। দিনারার জন্য তার খুব মায়া হয়। মেয়েটিকে সারাজীবনই এ খোটাখুটির যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে। মেয়েরা কি এ জন্যই জন্মায়? শাহেদের বোনের কথা মনে পড়ে।
বরের কনিষ্ঠ এসে খুবই অনান্তরিক স্বরে হাঁক দেয়- কার কার ক্ষুধা পেয়েছে আসুন। অপমানে শাহেদের মুখ লাল হয়ে গেল। এ কোন ভুতের রাজ্য রে বাপ। শুনেই পিত্তি জ্বলে গেলো মোরশেদের। অস্ফুষ্ট স্বর বেরিয়ে এল গলা দিয়ে- শালা!
রাজাখালী থেকে চল্লিশ কিলোমিটার দূরে শাহেদদের বাড়ি। সেখানে এত অনান্তরিক কণ্ঠে ডাকলে কুকুরও খেতে আসবে না। জয়নাল জানে, মোশতাকও জানে। কিন্তু অপমানে লাল হওয়া ছাড়া কিইবা করার আছে। তারা সেটাই হয়, লালে লাল।
তারা কেউ ভেতরে যাচ্ছে না দেখে একটি বয়স্ক মানুষ আবারও হাঁক দেয়, কই খেতে আসেন।
এতক্ষণ চুপচাপ থাকলেও জয়নাল এবার গলা চড়িয়ে ডাকে বেয়াইকে। কি মিয়া আমরা আপনাদের বাড়িতে কি কামলা এসেছি নাকি? মেহমানদের আপ্যায়ন তো করলেন না উল্টো এত রাতে জানতে চাচ্ছেন ক্ষুধা পেয়েছে নাকি।
জয়নালের কণ্ঠে ঝগড়া ও অপমানের কান্নার সুর যুগপৎ উপছে পড়ছে। বরের কনিষ্ঠ কবির সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করেই রেডিও হাতে চলে গেল ভেতরে।
কয়েকজন বুড়ো খাবার পর্ব সেরেই বরের খোঁজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। কন্যাযাত্রী আবুল কিছুটা শ্লেষ জড়িয়ে বললেন- বরতো লাখ টাকার কারবারি। টাকা গুণতেই নাকি আঙুল ব্যথা হয়ে যায়।
আরেকজন টিপ্পনি কাটে, বরের মুখে নাকি বসন্তের দাগ আছে। বেচারা হয়তো লজ্জায় দেরি করছে। বুড়ো লোকগুলো এভাবে গ্রাম্য ঠাট্টা মশকরায় মেতে ওঠে।
কন্যাযাত্রী বুড়োদের মুখ ঝামটা দিয়ে কুদ্দুস মেম্বারের বউ বলে ওঠে, লোকের মতো ফকির না। অন্যের কাছে চেয়ে চিন্তে খায় না। আমার ভাগনের মুখ থেকে নুরের জ্যোতি বেরুয়।
শাহেদের এসব মেয়েলী প্যাঁচাল ভাল লাসে না। তবে দুপুর থেকেই সারাপথে কুদ্দুস মেম্বারের উজ্জ্বল শ্যামলা উচ্ছল মেয়েটিকে দেখে তার ভেতরে অন্যরকম একটি অনুভূতি জন্মেছে। রাতে উঠোনে পাল্টানো পোশাকে মেয়েটিকে আরেক ঝলক দেখে তার মনে হয়Ñ আজ কি পূর্ণিমা তিথি। মেয়েটির সঙ্গে কথা বলতে পারলে সময়টা ভাল কাটতো। তবে এখন তার মায়ের কথা শুনে চোখে মুখে মরিচের জ্বালা অনুভব করে। ‘বর আসছে না, বর কই, কখন আসবে’ সবাই একে অন্যকে প্রশ্ন করছে আর প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। মেয়ে পক্ষের লোক হলেই যত জ্বালা। মনের বিরক্তিও প্রকাশ করা যায় না।
উঠোনে অপেক্ষারত কন্যাযাত্রীদের গুঞ্জণে হঠাৎ জল ঢেলে দিলেন কুদ্দুস মেম্বারের বউ। বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে ঘোষণা দিলেন, সবাই আলহামদুলিল্লাহ বলেন। বর-কনে কবুল বলেছে। মানে? একযোসে সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন সবার। সবার প্রশ্নের নীরব উত্তর হিসেবে তার পেছনে পেছনে হাসিমুখে বেরিয়ে আসে একজন বয়স্ক মৌলভী। বোবা একটি মুহূর্ত কাটানোর পর বুড়ো কন্যাযাত্রীরা আলহামদুলিল্লাহ পড়লেন। এবার নিশ্চয় বরকে দেখা যাবে। আবার সবার মধ্যে বর দেখার কৌতূহল চারিয়ে ওঠলো। দুলাভাই কই, নাতজামাই কই? বুড়োরা আবারও জানতে চাইলেন। শাহেদ আর মোরশেদ ভেবে পায় না, বিষয়টি কি? সে সন্ধ্যা থেকে কন্যাযাত্রীরা অপেক্ষা করছে। কিন্তু গভীর রাতে বাড়ি ফিরে গোপনে বিয়ে পড়লেন বর। শেষ দফা অপমানে লাল হয় কন্যাযাত্রীরা। জয়নালের চোখ দিয়ে টপটপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে।
মোরশেদ হঠাৎ বলে ওঠে, চলো শাহেদ।
কোথায়?
ফিরে যাই...
কিভাবে?
পূর্বদিকে হাঁটতে শুরু করলে সকাল নাগাদ নানাবাড়ি পৌঁছে যাবো। পারবে হাঁটতে?
শাহেদের মনে হচ্ছিল সে কোন ভুল জায়গায় এসেছে। তাই তার অনিবার্য উত্তর, হ্যাঁ।
কন্যাযাত্রীদের জটলা থেকে ইশারায় মোশতাককে ডাকে মোরশেদ। কাছে আসতেই মোরশেদ ফিসফিসিয়ে বলে, তুমি জয়নালের সঙ্গে থাকো আমরা চললাম। কোথায় যাচ্ছি সেটা জিজ্ঞেস না করেই বোকার মতো ঘাড় নাড়লেন মোশতাক। জামাইবাড়ির উঠোন থেকে বেরিয়ে তারা পূর্বদিকে হাঁটতে শুরু করে। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ আলো বিলাচ্ছে। চাঁদের আলোয় ধুলো ওড়া পথে পা বাড়িয়েই তাদের মনে হয় কোন কনসেনট্রেশন ক্যাম্প থেকে তারা পালিয়ে যাচ্ছেন। ধীরে ধীরে তাদের চলার গতি বাড়ে। পেটের ক্ষুধা-তৃষ্ণা উবে যায়।
প্রথমে শাহেদই মুখ খোলে। আমরা যে চলে এলাম বিষয়টি কেমন হলো?
মোরশেদের সোজা উত্তর- ভাল। ওরা আমাদের খুঁজবেও না।
যে বাড়িতে সন্ধ্যা থেকে এক গ্লাস পানি খেতে দেয়নি তারা আবার আমাদের খুঁজবে।
নিজের এ অতিসামাজিক মনোভাবের জন্য শাহেদের হাসি পায়। কোথাও গেলে তার সবসময় মনে হয় কে কি মনে করছে, কি ভাবছে ইত্যাদি। তবে জয়নালের জন্য তার সত্যি সত্যিই খারাপ লাগে। বেচারা কন্যার ভাই। যেন কত বড় অপরাধ করে ফেলেছে। পদে পদে বন্ধুদের কাছে মুখ ছোট আর তালুই বাড়িতে তাচ্ছিল্যের শিকার হতে হচ্ছে।
ধীরে ধীরে তাদের গল্প জমে উঠে। দূরত্ব অজানা থাকায় তারা কতটুকু এগুলো তা বুঝতে পারে না। পূর্ণিমা রাতের নানা গল্প ডালপালা ছড়াতে থাকে। পথের দুই পাশের বিচ্ছিন্ন বাড়িগুলোকে আকাশের নিচে বিস্তীর্ণ মাঠে এক একটি স্তূপের মতো মনে হয়।
হাঁটতে হাঁটতেই তাদের সামনে পড়ে মূর্তিমান অজগর। সমুদ্র নালাটিকে শাহেদের বিশাল বিস্তীর্ণ বিলে ছুটে চলা অজগরের মতো মনে হয়। পায়ে জুতো, সামনে খাল। দু’জনই গ্রামের ছেলে। খাল পেরুনোর বিস্তর অভিজ্ঞতা। তারপরও তারা এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়ায়। মোরশেদ দ্রুত প্যান্ট তুলে খালে নেমে পড়ে। তবে কয়েক কদম এগুতেই গভীর কাদায় তার পা দেবে যায়। অবস্থা বেগতিক দেখে শাহেদ তাকে টেনে তুলে। কাদামাখা পায়ে রাস্তায় ওঠেই তারা হঠাৎ হাসিতে গড়িয়ে পড়ে। তারপর দক্ষিণমুখী হাঁটা শুরু করে।
চ.
শার্টপ্যান্ট ইন করা মোরশেদকে হাতে জুতো নিয়ে হাঁটতে দেখে শাহেদের বেশ মজা লাগে। গভীর রাত, দেখার কেউ নেই। কিছুক্ষন হাঁটার পর দূর থেকে রাস্তার পাশে একটি বাড়ির উঠোনে কুপি বাতি জ্বলতে দেখা যায়। কাছে গিয়েই মোরশেদ জানতে চায়, বাড়িতে কেউ আছেন? সঙ্গে সঙ্গেই উঠোনের এক কোন থেকে সাড়া মিলে। একটি বুড়ো লোক হাঁক দেয়- কে?
সহজ সরল গ্রাম্য মানুষের সঙ্গে সহজ উত্তর দেয়াই ভাল। চাতুর্যপূর্ণ উত্তর আবার কোন বিপদ নিয়ে আসে। তাই মোরশেদ বলে- আমরা পথিক।
বুড়োটি এবার তার ছেলেকে ডাক দেয়, দেখতো বশির কারা।
এবার বশির নামের মধ্যবয়সী লোকটি তাদের কাছে এসে কিছুটা অবাক হয়।
আপনারা কারা? কোথায় যাবেন?
বাড়ি বিলপুকুরিয়া। রাজাখালী বেড়াতে গিয়েছিলাম।
এতরাতে কোথায় যাবেন?
জরুরি বাড়ি ফিরতে হচ্ছে, একটু খালের পুলটি দেখিয়ে দেবেন?
বশির দক্ষিণদিকে আঙুল উঁচিয়ে বলেন, সামনে হাঁটতে থাকেন।
বশিরদের বাড়ির উঠোনের পুকুর থেকে পায়ের কাদা ধুয়ে নেয় মোরশেদ।
বাঁশের সাকো পার হয়ে তারা খাল পার হয়। এবার নদীর ওপার দিয়ে যত পথ হেঁটেছিল ঠিক তত পথ উল্টো উত্তর দিকে হাঁটে। পূর্বপাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে পশ্চিম পাড়ে ফেলে আসা বিয়েবাড়ির কথা মনে হচ্ছিল শাহেদের বারবার। খালপাড়ের পথে বাঁশবন, শো শো শব্দ। কোন পথে যাবে সেটা নিয়ে দু’জনের দ্বিধাদ্বন্দ্ব।
আবার পূর্ব দিকে হাঁটা। প্রথম পাড়াটি অতিক্রমের সময় বাড়ির লোকজনের গলা শোনা যাচ্ছিল। একটি শিশুর কান্না আর তার মায়ের আদর কানে আসে। রাস্তার পাশে মসজিদের নলকূপ থেকে পানি খায় তারা। কিছুক্ষণ বেঞ্চিতে বসে বিশ্রাম নেয়। পাড়ার আঁকাবাঁকা মেঠোপথ ধরে তারা আবার হাঁটা শুরু করে। কিছু দূর উত্তর দিকে হাঁটার পর তারা মাঠের মধ্যখান ধরে পূর্বদিকে চলে যাওয়া একটি বড় আলপথে নেমে পড়ে। কিছুদূর যাওয়ার পর দ্বিতীয় পাড়াটি শুরু হয়। আবারও ধান কাটা ধুঁ ধুঁ মাঠ। মাঝে মাঝে কিছু জমিতে এখনও পাকা ধান কাটা হয়নি। শুক্লপক্ষের কোমল আলোতে আবছা কুয়াশা ছড়িয়ে পড়ছে আবিরের মতো। চাঁদটা যেন অভিজাত গৃহিণীর মতো গলে গলে পড়ছে সম্ভ্রমে। সারিবদ্ধ নাড়ার ডগাগুলো ঊর্ধ্বমুখী হয়ে সাজিয়ে তুলেছে বিস্তীর্ণ মাঠ। সৃষ্টি করেছে এক অপূর্ব ব্যঞ্জনা। আঁকাবাঁকা আলগুলো যেন সহমর্মিতায় পরস্পর হাত ধরাধরি করে নিশ্চুপ শুয়ে আছে। পূর্ণিমার হলুদ আলোয় ধানকাটা মাঠের অপূর্ণ দৃশ্য তাদের মাথা ধরিয়ে দেয়। তাদের ডানপাশের একটি বাড়ির আঙ্গিনায় হঠাৎ কয়েকটি পাটি সশব্দে ডানা ঝাঁপটে ডাল পরিবর্তন করলো। শাহেদ গান ধরে...।
ধু-ধু মাঠে হঠাৎ দুটো টর্চের তীব্র আলো তাদের চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। মুহূর্তেই দু’জনের শিরদাঁড়া বেয়ে একটি ভয়ের স্রোত নেমে যায়। বিস্ময়াবিভূত হয়ে তারা থমকে দাঁড়ায়। দূর থেকে কড়া প্রশ্ন আসে- এ কে রে তোরা?
আমরা পথিক...
এদিকে আয়... কড়া ডাক।
তারা ধীরে ধীরে আলোর উৎসে গিয়ে নিজেদের পরিচয় দেয়। তখনো তাদের দৃষ্টি স্বাভাবিক হয়নি। ষণ্ডা প্রকৃতির একজন চোখ রাঙিয়ে তাদের প্রশ্ন করে- তোরা কারা? কোথায় যাবি?
বিলপুকুরিয়া... মোরশেদের নি®প্রান উত্তর।
আরেকজন বলে উঠে- শালাদের আসে বেঁধে ফেল।
প্রথম লোকটি বলে- দরকার নেই।
এরই মধ্যে তাদের কয়েকজন শাহেদ ও মোরশেদকে ঘিরে ফেলে। মাপলার ও মুখোশে মুখ ঢাকা এসব লোকের চেহারা দেখা যায় না। তবে বুঝতে বাকি নেই লোকগুলো ডাকাত। একজনের হাতে একটি দোনলা বন্দুক। দু’জনের মুখ থেকে কোন কথা সরে না। থ হয়ে পড়া মোরশেদের প্রতি নতুন প্রশ্ন- এতরাতে কোথা থেকে আসছো ?
রাজাখালী থেকে।
এতরাত কেন?
পাশ থেকে আরেকজন তাড়া দেয়- টাইম নেই। শালাদের বেঁধে ফেলে রেখে চল যাই।
মোরশেদ ষণ্ডামার্কা লোকটিকে অনুনয়ের সুরে বলে- কাল আমাদের পরীক্ষা।
মোরশেদ বানিয়ে রাখা গল্প শুরু করে- আমরা একটি বিয়ে বাড়িতে গিয়েছিলাম। হৈ হুল্লোড়ে দেরি হয়ে গেছে। পরে গাড়ি মিস করে অনন্যোপায় হয়ে হেঁটেই বাড়ি ফিরছি। আগামীকাল দুপুরে আমাদের পরীক্ষা আছে। সকাল সকাল চট্টগ্রাম শহরে ফিরতে না পারলে পরীক্ষা দিতে পারবো না।
কোথায় পড়ো? এবার কণ্ঠ কিছুটা নরম...
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে...
এতক্ষণ নীরব ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা শাহেদকে ডেকে প্রশ্ন করে- এ তোর বাড়ি কই?
বিলপুকুরিয়া...
শার্ট-প্যান্ট পরা দু’জন তরুণকে দেখে ডাকাতরা দ্বিধাদ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে। একেক জনের একেক মত। ষণ্ডামার্কা লোকটি এক মুহূর্ত কি যেন ভাবলেন। এদিকে তার সঙ্গীদের ঘন ঘন তাড়া আসছে। এবার লোকটি তাদের ইশারায় মাঠের কোনাকুনি পথ দেখিয়ে দিয়ে বলেন- ওদিকে চুপচাপ হাঁটতে থাক। কোন শব্দ করলে গুলি করবো। বুঝছিস...। মোরশেদ একটি ঢোক গিলে বলে- জ্বি।
ডাকাতরা তাদের ভুল পথে ফসল তোলা মাঠের দিকে চলে যেতে বলে। ডাকাতদের ইশারা করা পথে তারা মাঠের কোণাকুনি হাঁটতে শুরু করে। ভয়ে একটি বারের জন্যও পেছনে তাকায় না। শাহেদের মনে হয়- এই বুঝি একটি গুলি তাকে ভেদ করে ছুটে গেল। ভয়ে জমে যাওয়া পাথরের মতো ভারী পায়ে হাঁটা পথ যেন হাজার মাইলের ফুরোবেই না। একটি নাড়ার ডগা শাহেদের জুতার পাশ দিয়ে পায়ে বিদ্ধ হয়। আহ্ শব্দে শাহেদ বেদনা প্রকাশ করতেই শাহেদ মৃদু স্বরে তাড়া দেয়। আরেকটু জোরে...। শাহেদ ভাবে সুযোগ পেয়ে সদ্য কাটা ধানের নাড়াগুলোও যেন প্রতিশোধ প্রবণ হয়ে ওঠেছে।
কোনাকুনি মাঠ ধরে কিছুদুর সামনে যেতেই বিচ্ছিন্ন কয়েকটি বাড়ি চোখে পড়ে। বাড়িগুলো পার হতে না হতেই পেছন দিক থেকে গুলির শব্দ আসে। হৈ চৈ ও চিৎকারের শব্দ আসে। দ্বিতীয় গুলির শব্দের সঙ্গে সঙ্গেই পাড়ার কুকুরগুলো একযোসে ডেকে ওঠে। তারা আবারও থমকে দাঁড়ায়। বেকুবের মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। অজানা আশঙ্কা তাদের গ্রাস করতে চায়। আবার অতিসন্তর্পণে হাঁটা ধরে। তারা এতই সন্তর্পণে বিড়ালের পায়ে হাঁটে যে, যেন তাদের পায়ের শব্দে পাড়ার লোকের ঘুম ভেঙে যাবে। গ্রামবাসী জেসে ওঠে তাদের ডাকাত সন্দেহ করে পিঠিয়ে হাড্ডি ভেঙে দেবে।
ছ.
কত দূর এলাম... শাহেদের কণ্ঠে কৌতুহল।
মনে হয় টৈঠংয়ের কাছাকাছি... মোরশেদের নির্লিপ্ত উত্তর।
আর কতদূর...
মাইল দশেক হবে হয়তো..
আকস্মাৎ আলের উপর দিয়ে নাড়ায় শব্দ তুলে কি একটি যেন শোঁ শোঁ শব্দ করে ছুটে গেল। শাহেদের বুকের ভেতর ভয়ের শিহরণ জাগে। আস্তে মোরশেদ... কি যেন ছুটে গেল।
সাপ হয়তো...
ওরে বাপরে... সাপ! শাহেদের গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়। কণ্ঠে স্পষ্ট ভয়ের রেশ।
ভয় পেয়েছেন?
পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ভয় পাই ওই সাপ খোপ।
দুই জন আছি ভয় করবেন না।
অন্য ভয় নয়, তবে সাপের কথা আলাদা। এবার মোরশেদ হো হো করে হেসে ওঠে। এখন আর ভয়ের কারণ নেই। পেছনের ডাকাতদল অনেক দূরে ফেলে এসেছি।
সামনে... শাহেদের কণ্ঠে নতুন আশঙ্কা।
সামনে বারবাকিয়া বাজারের পশ্চিমের জঙ্গলপথেও ডাকাতি হয়। তবে একদলকে যেহেতু পেছনে ফেলে এসেছি তাই সামনে আরেকদল পড়বে বলে মনে হয় না।
সামনে পড়লেও সে পুরনো গল্প...এবার এতক্ষণ ভয়ার্ত শাহেদও হেসে ওঠে। সাপের ভয় ও রাতের গল্প... ধুলোময় মেঠো আলপথ ধরে হাঁটতে ভালই লাগছে। মন থেকে ধীরে ধীরে কেটে গেছে ডাকাতের ভয়। বিল পেরুতেই হঠাৎ একটি উঁচু খোয়াভাঙা পথের এসে তারা ওঠে। মোরশেদ চিনতে পারে। পথটি উত্তরে টৈটংয়ের দিকে চলে গেছে। এবার টৈটংয়ের খোয়া ভাঙা পথ ধরে অগ্নিকোনামুখী তারা হাঁটতে থাকে। ততক্ষণে আবার খুলে গেছে গানের গলা।
হাঁটতে হাঁটতে আবার নিকষ অন্ধকার। দুইধারে গা ছমছম করা জঙ্গলাকীর্ণ নিঃশব্দ নির্জন পথ। শেয়ালের হুক্কা হুয়া ডাক, বুনো পশুপাখির সশব্দ পদচারণা, ডালে ডালে পাখিদের ডানা ঝাপটানি তাদের মনে আবারও ভয় ধরিয়ে দেয়। জঙ্গলের পথে এগুতেই উঁচু ও ঘন গাছপালার কারণে চাঁদের আলো অতিম্লান হয়ে ঝরে। ফলে চারদিক থেকে নিকষ অন্ধকার তাদের গিলে খেতে চায়। যেন কোন নির্জন প্রেতপুরীতে এসে পড়েছেন। শাহেদ ভয় তাড়াতে গল্প শুরু করলেও মোরশেদ দোয়া দরুদ... পড়তে থাকে।
পাহাড়ি নির্জন পথ অতিক্রম করে তারা বারবকিয়া বাজারে এসে পৌঁছে। তখন ফজরের আযান পড়ে পড়ে সময়। তারা বাজারের একটি খোলা চকিতে বসে বিশ্রাম নেন। পা এগুনো যাচ্ছে না। ক্ষুধায় অর্ধেক হয়ে গেছে দু’জনেই। ভেতর থেকে বন্ধ একটি মুদি দোকানের কড়া নাড়ে। ভাই ভেতরে কেউ আছেন? কোন সাড়া শব্দ নেই। মনে হয় ভেতরে কেউ নেই।
ভেতরে কেউ আছেন?
কে? ভয় এবং গাম্ভীর্যময় ঘুম জড়ানো স্বর।
মোরশেদ নিজের পরিচয় দিয়ে বলে- ভাই আমরা খুবই ক্ষুধার্ত। দোকানে কি বিস্কুট আছে?
এরই মধ্যে ভেতরে কুপি জ্বলে উঠে। একটু পর দোকানের কাঠের একটি পাল্লা খুলে বেরিয়ে আসেন দোকানি সোলেমান। হাতে তার দীর্ঘ উলঙ্গ ধারালো কিরিচ। কিরিচ হাতে দোকানদারকে বেরুতে দেখেই ভয়ে সেটিয়ে যায় শাহেদ। পরক্ষণেই আনমনে হেসে ওঠে। বেচারা নিশ্চয় তাদের ডাকাত-টাকাত ভেবেছে। সোলেমানও শার্ট প্যান্ট পরা দুই তরুণকে দেখে কিছুটা ভড়কে যায়।
এত রাতে কোথা থেকে আসছেন?
মোরশেদ চতুর্থবারের মতো বানানো গল্প শুরু করে...
বাজারের মসজিদের মুয়াজ্জিনের গলা শোনা যাচ্ছে। বাজারের কুকুরগুলোও জেসে ওঠেছে। কোন একটি বাড়ি থেকে একটি মোরগ বাক্ দিয়ে ওঠল। সোলেমান সওদাগর দুই প্যাকেট বেকারীর বিস্কুট বের করে দেয়। সঙ্গে একটি পানির গ্লাসও। শাহেদ নতুন হলেও মোরশেদের পরিচিত এ বাজার। সে বাজারের নলকূপ থেকে পানি নিয়ে আসে। সত্যি সত্যিই তাদের প্রচুর ক্ষুধা পেয়েছে। এতক্ষণ বুঝতেই পারেনি ভয়ে এবং উত্তেজনার চোটে। দুই প্যাকেট বিস্কুট শেষ করে পানি খেয়ে তারা বাজারের খোলা চৌকিতে বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়। তখন চারদিকে আযান শুরু হয়ে গেছে। দু’একজন করে মুসল্লিরা ঘুম ভাঙা চোখে মসজিদের দিকে ছুটছে।
এখন আর তাদের পা চলছে না। ক্ষুধার্ত অবস্থায় সারারাত হাঁটার পর পেট ভরে বিস্কুট আর পানি খাওয়ায় তাদের শরীরে ক্লান্তি নেমে আসে। শাহেদের পা ব্যথা করছে। মনে হচ্ছে, দু’পায়ে কেউ ভারী পাথর বেঁধে দিয়েছে। সেই সঙ্গে একটি বিজয়ের স্ফুর্তিও অনুরণন তুলছে স্নায়ুতে। মোরশেদ খেয়াল করে অদূরেই চ্যাপ্টামুড়ার শীর্ষে উঁকি দিচ্ছে নতুন দিনের রক্তাভ আভা।
কাফি কামাল
গর্জনবুনিয়ার পশ্চিম ঢাল বেয়ে গড়িয়ে নামছে দুপুর। সদ্য নেভানো চুলোর মতো ঠাণ্ডা হয়ে আসছে সূর্যের তেজ। মৃদু বাতাসে অঘ্রাণের ধানকাটা মাঠের নাড়ার মতো সুর ওঠেছে চ্যাপ্টামুড়ার মৌলভী বাড়িতে। বরকনে দু’পক্ষের মেহমানরা সমবয়সীদের নিয়ে আড্ডা জমিয়ে তুলেছেন। আড়ালে-আবডালে চলছে হালকা রঙ্গ-রসিকতাও। না দেখা জামাই নিয়ে কনে দিনারাকে অন্দর মহলে টিপ্পনি কাটছে বুড়ি দাদী-নানীরা। তা শুনে হাসিতে গড়িয়ে পড়ছে তরুণীরা। তবে ভেতর বাড়ির খোশালাপ বাইরে উঠোনের পুরুষ মানুষের কানে একটা আবছা রেশ ছড়িয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। মৌলভী বাড়ির অন্দরে পুরুষ মানুষের অবাধ যাতায়াত নিষিদ্ধ। বিয়ে-শাদী উপলক্ষেও কোন গান-বাজনা নেই। নেই তেমন হৈ হুল্লোড়ও। আছে কেবল কনের দাদা সিকান্দার মৌলভীর হাঁক-ডাক আর বাচ্চাদের হইচই। তারপরও বিয়েবাড়ির কিছু স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য চ্যাপ্টামুড়ার চূড়া ছুঁইয়ে গেছে। হাঁটাচলায় শাহেদের কানে অন্দর মহলের দু-এক টুকরো হাস্যরস অনুরণন তুলেছে। ওদিকে বরপক্ষ এটা আনেনি, ওটা আনেনি ইত্যাদি মেয়েলী অনুযোগে, হৈ হল্লায় সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে।
কি একটা প্রয়োজনে দিনারার মাকে খুঁজতে গিয়ে পাশের বারান্দায় দিনারাকেই চোখে পড়ে শাহেদের। বিয়ের শাড়িতে দিনারাকে পরীর মতো লাগছে। তার চোখ দু’টো জলে ভেজা। কিছুক্ষণ পরই তাকে না দেখা জামাইর কাছে নিজেকে আজীবনের জন্য সমর্পণ করতে যেতে হবে। সমুদ্র তীরবর্তী দূরের এক গ্রামে। মেয়েরা নাকি স্বর্গে যাওয়ার আগমুহূর্তেও রান্নাঘরে একটা ঢুঁ মেরে যায়। দিনারাও শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার আসে বিয়েবাড়িতে ব্যস্ত মাকে এটা-ওটা এগিয়ে দিচ্ছে। শাহেদকে দেখেই সে দ্রুত আঁচলে মুখ ঢাকে। শাহেদ নীরবে দ্রুত বেরিয়ে যায়।
ঘরভর্তি মেয়েদের চোখে জল, কণ্ঠে চিরায়ত কনে বিদায়ের শোক। বরযাত্রীরা দুপুরের খাওয়ার পর্ব শেষ করে ফেরার তাড়া দিচ্ছেন। কয়েকজন বয়স্ক বরযাত্রী খানাপিনা সেরে ছুটেছিলেন মসজিদের উদ্দেশে। ছেলে-ছোকরারা ভিড় করছিল পাড়ার দোকানে। সবাই এখন চ্যাপ্টামুড়ার চূড়ায় কনেবাড়ির উঠোনে ফিরে আসছে। নীরবে এটা-ওটা আনা-নেয়া করছেন কনের বাবা নুরুল করিম মৌলভী। তার চোখও টলমল। তিনি পাঞ্জাবির খুঁট দিয়ে চোখের পানি মুচছেন। বড় মেয়ের বিয়ে দিয়ে মন ভরেনি তার। দ্বিতীয় মেয়ের বিয়েতেও মনের মতো আয়োজন করতে পারলেন না। বুড়ো পিতার হাঁকডাকের কাছে বড্ড অসহায় নূরুল করিম মৌলভী। তবে নাতনিকে শ্বশুর বাড়ির মুরব্বীদের হাতে হাওলা করে দিতে দিনারার দাদা সিকান্দার মৌলভীর তাড়ার অন্ত নেই। উঁচুস্বরে হাঁক দিচ্ছেন- কই রে তাড়াতাড়ি কর। তাড়া কর, সূর্য যে ডুবে যায়। সন্ধ্যা হয়ে আসছে।
খ.
বন্ধুর ছোট বোনের বিয়েতে চল্লিশ কিলোমিটার দূর থেকে চ্যাপ্টামুড়া এসেছে শাহেদ। সমুদ্রের ঘ্রাণযুক্ত শরীরে হাজির আরেকবন্ধু মোশতাক। বিয়েবাড়িতে প্রথম পরিচয়েই তাদের সঙ্গে আড্ডা জমিয়ে তুলেছেন কনের ফুফাতো ভাই মোরশেদ। আগের রাত থেকেই গল্প, আড্ডা, বিয়েবাড়ির ছোটখাটো নানা কাজে আনন্দের মধ্যেই কেটে গেছে সময়।
কনে বিদায়ের আসে দিনারার বড়ভাই জয়নাল বন্ধুদের কন্যাযাত্রী হওয়ার প্রস্তাব দেয়। বলে- চলরে শাহেদ রাজাখালী যাই...।
কে কে যাচ্ছে? শাহেদের কৌতূহলী জিজ্ঞাসা।
মোরশেদ এবং মোশতাকও যাবে। ছেলে-বুড়োরা তো আছেই। জয়নালের হাসিমাখা উত্তর।
চল্। তাহলে নতুন জায়গা দেখা হবে। সমুদ্রতীরের গ্রামে জামাইবাড়িতে নিশ্চয় খুব আনন্দ হবে। জয়নালের প্রস্তাবে কন্যাযাত্রী হতে এককথায় রাজি হয়ে গেল তিনবন্ধু। জয়নাল তাড়া দেয়- দ্রুত কর। কিছুক্ষণের মধ্যেই দিনারাকে নিয়ে বরযাত্রীরা রওনা দেবে।
পুরনো আমলের লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা জিপে চড়ে বিকাল নাগাদ শুরু হলো কন্যাযাত্রা। একটিতে দু’পক্ষের পুরুষ অন্যটিতে মেয়েদের নিয়ে হেলেদুলে চলতে শুরু করলো জিপ দু’টো। ধুলো ওড়া, খোয়া ভাঙা মেঠোপথ ধরে জিপ চলছে। রাস্তার দু’পাশ থেকে গ্রাম্য বৌ-ঝি’রা বেড়ার ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে উঁকি দিচ্ছে। হাফপ্যান্ট পরা শিশু আর লুঙ্গির কাছা মারা বালকগুলো জিপের পেছনে পেছনে দৌঁড়াতে দৌড়াতে ধুলো খেয়ে হাঁপিয়ে উঠছে। কন্যাযাত্রী বুড়োরা কখনও ধমক দিয়ে কখনও হাতের লাঠি দেখিয়ে শিশুদের দৌড় থামিয়ে দিচ্ছেন। জিপগুলো যখন আঁকাবাঁকা মেঠোপথ ভেঙে বাঘগুজরা স্টেশনে পৌঁছে তখন আসরের নামায শেষ করে মুসল্লিরা বেরিয়ে আসছে।
মুসল্লীদের দেখেই বরযাত্রী আবদুস সালাম আপসোস করে- নামাযটা কাজা হয়ে গেল। গাড়ি একটু পরে ছাড়লে হতো না।
পাশে বসা আবদুল কাইয়ুম ভেংচি কাটে... আরে আমার নামাযি। সবাই নামায পড়েই গাড়িতে ওঠলো আর সালাম ভাই হাওয়া খেয়ে।
কাইয়ুমের কথা শুনে সালাম প্রথমে অবিশ্বাসের সঙ্গে তাকালেও পরক্ষণেই লজ্জায় চুপ মেরে গেলেন।
সুযোগ পেয়েই শাহেদ দুষ্টুমি করেÑ এক ওয়াক্ত নামায কাজা করলে ২৪ খুতবা দোজখের আগুনে জ্বলতে হবে।
শাহেদের কথাটা কেড়ে নিয়েই বর ও কনেযাত্রী কয়েকজন বুড়ো ধর্মালাপ শুরু করে দিলেন। শাহেদ তখন মোশতাককে চিমটি কেটে দেখালেন পাশের বাড়ির একটি তরুণীকে কিভাবে উঁকি মারছে।
মোশতাক মৃদু হেসে বলে- দোস্ত, একদম দোস্ত।
বাঘগুজরা থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে ছোট পাকা রাস্তাটি পেকুয়ার দিকে চলে গেছে। বর্ষাকালে প্রচুর কাদামাটির কারণেই নাকি লোক মুখে এ নামকরণ। কিছুদিন আগেও বর্ষাকালে এ অঞ্চলের মানুষের দুর্ভোগের অন্ত ছিল না। এখনও পেকুয়া থেকে চকরিয়া যাতায়াতে জিপই ভরসা। কিন্তু রাত বাড়লে তাও মেলে না। চারদিকের দৃশ্য অবলোকন করে শাহেদের মন ভরে উঠে। অন্যরা যখন নানা গল্পগুজবে মেতে ওঠেছে তখন শাহেদ দেখছে প্রকৃতি। অঘ্রাণের ধানকাটার পর হলুদ নাড়া মেটে হলদে আভা ছড়িয়ে দিয়েছে দিগন্তব্যাপী। পেকুয়া স্টেশন থেকে গাড়ি পশ্চিম দিকে বাঁক নিতেই বিশাল ধুঁ ধুঁ বিল। আঁকাবাঁকা রাস্তা পশ্চিম দিকে চলে গেছে রাজাখালী অভিমুখে। মোশতাক ও মোরশেদের নানা গল্প, ভেতরে বুড়োদের নানা মন্তব্য আর উজ্জ্বল শ্যামলা একটি তন্বী বরযাত্রীর চোখাচোখি হয়ে মাঝে মধ্যে ছেদ পড়ছে শাহেদের প্রকৃতি ভোগে। জিপ দু’টো পেকুয়ার সবুজ বাজার পৌঁছতেই ক্লান্ত সূর্য হেলে পড়লো। সেমিপাকা টিনশেড কয়েকটি দোকানে নিয়ে গড়ে ওঠা সবুজ বাজার পেরুতেই চারদিকে লবণের ধুঁ ধুঁ মাঠ। কানে ভেসে আসছে সমুদ্রের গর্জন। জামাইবাড়ি পৌঁছাতেই সূর্য ডুব দেয় বঙ্গোপসাগরে। নুনের মাঠ থেকে বাড়ি ফিরছে সুঠাম দেহের ঘামে ভেজা নুনচাষিরা। নুনের মাঠে বিচ্ছিন্ন একেকটি বাড়ি নিয়ে রাজাখালীর গ্রামগুলো। নারকেল গাছ আর ছোট ছোট পুকুর নিয়ে প্রতিটি বাড়িই যেন মাঠের সমুদ্রে একেকটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ।
শাহেদের মনে পড়ে ’৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের কথা। মনে করিয়ে দিতেই হু করে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে মোশতাক। তারপর উদাস কণ্ঠে বলে- সে কি ভোলার মতো ঘটনা রে...। তারপর স্বগোক্তি করে বলে- বিরান ভূমিতে পরিণত হয়েছিল। চারদিকে লাশের পর লাশ। ভেসে এসেছে কুতুবদিয়া, মাতারবাড়ি আর মগনামা থেকে। আমার মেঝ ফুফুর লাশই তো পাইনি।
শাহেদের চোখ তখন অনুসন্ধিৎসু হয়ে ওঠে। যেন ঘূর্ণি তাণ্ডবের অস্তিত্ব খুঁজছে।
গ.
জিপগুলো ধুলো উড়া পথ মাড়িয়ে জামাইবাড়ির অদূরে এসে থামলো। অল্প একটু পায়ে হাঁটা পথ পেরুলেই নারকেল গাছে ঘেরা জামাইবাড়ি। আঙ্গিনায় ঢুকেই এক ধরনের বিদঘুটে আবহাওয়া নাকে মুখে ঝাপটা দিয়ে গেল শাহেদের। পাড়া প্রতিবেশীরা বরের আঙ্গিনায়ও ঢুকলো না। জিপ থেকে নেমেই যে যার বাড়িতে চলে গেলো। বরের আত্মীয়-স্বজনরা ব্যস্ত হয়ে উঠলেন নিজেদের নিয়েই। উঠোনে ধান শুকানোর তলুই বিছিয়ে বসার ব্যবস্থা করা হলো কন্যাযাত্রী কয়েকজন বুড়োর। মেয়েরাও নিজেদের মতো করে বাড়ির ভেতরে বসার জায়গা খুঁজে নিয়েছে। কিন্তু বাইরে দাঁড়ানো কন্যাযাত্রী জোয়ান ছেলেগুলোর দিকে কারও নজর নেই।
বন্ধুদের কথা ভেবে ছোট হয়ে যাচ্ছিল কনের ভাই জয়নাল। রাগে-অপমানে তার মুখের শিরা ফুলে ওঠেছে। ঠোঁট কামড়াতে কামড়াতে সে পায়চারী শুরু করে। এ কেমন বাড়ি রে বাবা! প্রতিবেশীদের আনাগোনা নেই। আত্মীয়-স্বজনের হৈ হুল্লোড় নেই। সামিয়ানা আর আলোকসজ্জা নেই। রঙিন কাগজের ফুল পর্যন্ত লাগানো হয়নি দরজায়। শাহেদ কিছুটা অবাক হয়। আঙিনায় নারকেল গাছে হেলান দিয়ে গল্পে মেতে ওঠা শাহেদ ও মোরশেদকে দু’টো মোড়া এনে দেয় একটি ছেলে। দিনারার জামাই তখনো বাজার থেকে ঘরে ফিরেনি। দু’কিলোমিটার দূরেই রাজাখালী বাজারে তার তেলের দোকান। মাছমারা ট্রলার ও ইঞ্জিন নৌকায় তেল সাপ্লাই দেয়। বিয়ের দিনেও দোকানে তেল বেচাকেনা করছে, শুনেই শাহেদের মনটা কুচকে যায়।
কন্যাযাত্রী আর আত্মীয়-স্বজনরা বরের জন্য অপেক্ষা করছে। তরজা বেড়ার ফোকর দিয়ে ঘরের ভেতর থেকে মাঝে মধ্যে মহিলাদের ফোড়ন কাটা আর মুখ ঝামটার শব্দ কানে আসছে। দিনারার মামা শ্বশুর কুদ্দুস মেম্বারের মধ্য বয়সী স্ত্রীর অট্টহাসির শব্দগুলো বেশ জোরালো। এরই মধ্যে শাহেদের পরিচিত হয়ে ওঠেছে ওই হাসির শব্দ। পৃত্থুলা আকৃতির বাচাল মহিলাটি দুপুর থেকেই কথায় কথায় হাসির ধমক ছড়াচ্ছেন। নিজেই বলেন, নিজেই হাসেন। অলঙ্কার সজ্জিত শরীরের অহঙ্কারী ভাঁজ খুলে কন্যাযাত্রী মহিলাদের সঙ্গে মেয়েলী ঠাট্টা-মশকরা করে যাচ্ছেন। বাইরে কন্যাযাত্রীদের সঙ্গে কথাবলার লোক নেই। কেউ এসে জিজ্ঞেসও করছে না। বুড়োরা নিজেদের মতো গল্পগুজবে মেতে ওঠলেও শাহেদদের নিঃসঙ্গটা ঘুচে না। তার মনে হচ্ছে, এ কোন আবোলাইন্যা মেজবানে এসে পড়েছি। যে বাড়িতে অনুষ্ঠান সে বাড়ির লোকজন কথার খাতির না করলে নিজেকে কেমন ছোট ছোট লাগে। মনে হয় অযাচিত। মোরশেদের সঙ্গে এলোমেলো গল্প লতিয়ে ওঠলেও তার ভাল লাগছে না।
চট্টগ্রামের বিয়ের সঙ্গে কোন মিলই নেই। এজন্য শাহেদের বিস্ময়টা একটু বেশি। বৃহত্তর চট্টগ্রামের লোকজনের মেহমানদারীর সুনাম দেশজোড়া। চট্টগ্রামে বিয়ে বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া, আদর-আপ্যায়নের জুড়ি মেলাভার। লোকে বলে, পাতিলে চাল না থাকলেও খরচের হাত খোলা। চট্টগ্রামের লোকজনের মধ্যে এ নিয়ে একটি অহঙ্কারও আছে। এখানে খাবার চেয়ে কথার মান বেশি।
শাহেদ শুনেছে সমুদ্রতীরের মানুষ সাহসী ও উদার হয়। এখন মনে হচ্ছে, তাদের মধ্যে হিংস্রতা আর অসামাজিকতাও আছে। নাকি ভুল বিচার করছে? একটি বাড়ির লোকজনের আচরণে পুরো এলাকার চরিত্র বিচার করা কি ঠিক?
উঠোনে একটি চেয়ারে বসে পায়ের ওপর পা তুলে বরের কনিষ্ঠ কবির চার ব্যান্ডের রেডিও নিয়ে বসেছে। রেডিওর নব-এ স্টেশন ঘোরাতে ঘোরাতে সে খুব রসিয়ে রসিয়ে বিদেশের গল্প শুরু করে। হা করে গিলছে কয়েকজন বুড়ো লোক। মনে হচ্ছে কোন প্রবাসী দীর্ঘদিন পর বাড়ি ফিরেছে। সবাই তাকে ঘিরে সাত সমূদ্র তের নদীর গল্প শুনছে। কবির ছিটগ্রস্তদের প্রলাপের মতো গল্প করেই যাচ্ছে। কিন্তু বিরক্ত লাগছে শাহেদের। কোন সুস্থ সামাজিক লোক কি বিয়েবাড়িতে মেহমানদের প্রজার মতো বসিয়ে নিজে জমিদারের মতো গল্প শোনায় নাকি। কার গল্প কে শোনে, কে কার চেয়ে কম। লোকটা পাগল নাকি!
ঘ.
অপেক্ষা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। বরের দেখা মিলছে না। কন্যাযাত্রীদের মুখে মুখে ঘুরপাক খাচ্ছে একই প্রশ্ন- কখন আসবে বর? বর এলেই না সম্পন্ন হবে আক্দ। কন্যাযাত্রীদের বেশিরভাগই আসে বরকে দেখেনি। দিনারার দূর সম্পর্কের এক দুলাভাইয়ের ঘটকালিতে বিয়ের ঠিক-ফর্দ হয়েছে। তিনিই দিনারার দাদাকে বর ও তাদের আত্মীয়-স্বজনের ব্যাপারে নানা কথা বাড়িয়ে বলেছে। দিনারার দাদার কারণে কেউ আগ বাড়িয়ে রাজাখালী গিয়ে বর বা তার ঘরবাড়ি দেখেনি। বুড়োর এক কথা- বাজারে তেলের দোকান আছে, এক দুনের নুনের মাঠ আছে, দেখতে শুনতেও মন্দ নয়। তাই কারও দেখতে যাওয়ার দরকার নেই। বেশি খোঁজ নিতে গেলেই দুষ্ট লোকরা ত্রুটি বের করে। এখন বরের বাড়ি পৌঁছেই মন খারাপ হয়ে গেছে দিনারার ভাই জয়নালের। রাত যত বাড়ছে ততই হাফিয়ে ওঠছে কন্যাযাত্রীরা। বুড়োরাও হাঁক দিচ্ছে- কই গো আমাদের নাতজামাই কই?
শাহেদ আর মোরশেদ উসখুস করছে। মোশতাক তাকিয়ে আছে জয়নালের বেদনার্ত চেহেরার দিকে। তাদের কিছুই ভাল লাগছে না। সামুদ্রিক হাওয়ায় ক্ষুধা-তৃষ্ণা দু’টোই উসকে দিচ্ছে। তৃষ্ণায় বুকটা ফেটে যাচ্ছে শাহেদের। এতক্ষণ একটির পর একটি সিগারেট টানতে টানতে তার কলজে পর্যন্ত যেন শুকিয়ে গেছে। সে ইশারায় একজন বয়সী লোকের কাছে খাবার পানি চাইলেন। লোকটি দ্রুত ওঠে গিয়ে কিছুক্ষণ পর ফিরে এলো খালি হাতে। কানে কানে বললেন, মেয়েদের কারণে তিনি ভেতরে যেতে পারেননি। এবার মোশতাক বাড়ির ভেতরে ঢোকে। কিছুক্ষণ পর সেও বেরিয়ে আসে খালি হাতে। বিরক্তি প্রকাশ করে বলে, কেমন বাড়ি রে বাপ। চারবার বলার পরও কেউ এক গ্লাস পানি দিল না!
এবার জয়নাল বেয়াই কবিরকে বলে- কি ভাই একটু পানিও খাওয়াবেন না?
কবির একজনকে হাক দেয়। লোকটি বেরিয়ে এসেই জানায়- শরবতের ব্যবস্থা হচ্ছে।
সময় গড়িয়ে আধঘণ্টা পেরিয়ে যায়, পানি আসে না। শাহেদ মনে মনে হাসে। এখানকার মানুষ কি পানিও খায় না। আশপাশে নলকূপও দেখা যাচ্ছে না। মোরশেদ পেছন থেকে চিমটি কাটে শাহেদের। দুইজন বাড়ির উত্তরদিকের পুকুরে যায়। নারকেল গাছ দিয়ে বানানো ঘাটে বসে তৃষ্ণা মিটিয়ে পানি খায়। হাত-মুখ ধোয়। মোরশেদ বলে- পানিতো দেখি ডাবের চেয়ে মিষ্টি। তারপর দু’জনই হেসে ওঠে।
শাহেদ খেয়াল করে প্রতিবেশীদের মধ্যে বিয়েবাড়ি নিয়ে তেমন আগ্রহ নেই। লোকজন নানা টিপ্পনি কাটছে। গল্পচ্ছলে শাহেদ পাশের বাড়ির মধ্যবয়সী একজনকে জিজ্ঞেস করলো- কি ভাই আপনাদের দেশে কি বিয়েবাড়িতে হৈ হুল্লোড় হয় না?
লোকটি মৃদু ভেংচি কাটে। ওই বাড়িতে হৈ হুল্লোড়, নাউযুবিল্লাহ!
কথাটি শুনেই মোরশেদের মুখটি কালো হয়ে গেল। অচেনা এ লোকটি যেন তাদের গালে কষে থাপ্পড় দিয়েছে। হাজার হলেও মামাতো বোনের শ্বশুরবাড়ি। শাহেদ ও মোরশেদ হাঁটতে হাঁটতে পাড়ার উত্তর দিকের একটি গাছের নীচে এসে দাঁড়ায়। পকেটের সিগারেটও ফুরিয়ে গেছে। আশপাশে কোন দোকানও দেখা যাচ্ছে না। যার কাছেই জিজ্ঞেস করে সেই গাল দেয়ার মতো করে উত্তর দেয়- রাজাখালী যান।
দুইকিলোমিটার দূরেই রাজাখালী। পথ বেশি নয়। মন ভাল থাকলে দূরত্ব নস্যি। বিয়েবাড়ির গোষ্ঠী উদ্ধার করতে করতে তারা নিজেদের নিয়ে আলাপে মেতে ওঠে। কিছুক্ষণ পর মোশতাকও যোগ দেয়। বলে, তোদের খুঁজতে খুঁজতে এদিকে চলে এলাম।
মোশতাক স্বগোক্তি করে- ভালই হলো, ওই যে আমার মামির বোনের বাড়ি। চল সেখানে যাই। এমন পানসে বিয়ে বাড়ির চেয়ে দূরসম্পর্কের আত্মীয় বাড়িই অনেক ভাল।
শাহেদ সায় দেয়- চলো।
মোশতাকের মামীর বোনের বাড়ির উঠোনে ঢুকতেই চোখে পড়ে তলুই বিছিয়ে খোশগল্প করছে নুনের মাঠ ফেরত কয়েকজন যুবক। তাদের দেখেই একজন হাঁক দেয়- আপনারা কারা? মোশতাক নাম বলতেই বাড়ির মেঝ ছেলে সালাম রীতিমতো লাফিয়ে ওঠে। আরে মোশতাক তুই! অন্যরাও ওঠে দাঁড়ায়। বাড়ির ভেতর থেকে দু’টি হাতল ভাঙা চেয়ার আর মোড়া এনে তাদের বসতে দেয়। বিয়েবাড়ির কথা শুনতেই সালাম হেসে ওঠে। শাহেদ খেয়াল করে আবারও মোরশেদের মুখটা কালো হয়ে গেছে। কথা বলতে বলতেই শরবত আর বিস্কুট নিয়ে এলো বাচ্চা একটি মেয়ে। মেঘ না চাইতেই জল, কি ব্যাপার। শুরু হয়ে গেল আড্ডা। নুনের মাঠ থেকে মধ্যপ্রাচ্য, কলেজ থেকে জনপ্রতিনিধি... হাজারও কথা। এরই মধ্যে তাসের প্যাকেট জোগাড় করে ফেলেছে মোশতাক। তাকে একটি ধন্যবাদ দিয়েই শুরু হলো টুয়েন্টি নাইন।
রাত তখন সাড়ে ১০টা। খেলা জমে ওঠলেও মোরশেদের পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে রাগে। এতক্ষণেও বিয়ে বাড়ির কেউ তাদের খোঁজও নেয়নি। বিয়ের দিন দোকানদারি করে শ্বশুর বাড়ির লোকজনরে দেখাচ্ছে শালা বর। মনে মনে গাল পাড়ে আর আস্তে করে মোশতাককে চিমটি কাটে। চিমটি খেয়েই তাড়া দেয় মোশতাক। চল বিয়েবাড়ি যাই। বর এসেছে কিনা দেখি। সালাম ক্ষেপে উঠেÑ আরে কতদিন পর বেড়াতে এসেছো ভাত খেয়ে যাও, রাতে থাকো।
এ বাড়ির লোকজনের আতিথেয়তায় শাহেদ মুগ্ধ। তবে হঠাৎ কোন বাড়িতে এসেই ভাত খেতে বসে যাওয়া ভাল দেখায় না। ভেতরে আগ্রহ থাকলেও বাইরে তাড়া দেখায় তারা। সালাম তাদের বিয়ে বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিলেও বিয়ে বাড়িতে ঢুকে না। শাহেদের অনুরোধও বিনীতভাবে এড়িয়ে গেল।
ঙ.
বরের কোন খোঁজ নেই। মুরব্বীদের কেউ কেউ উঠোনে বসেই ঘুমে নাক ডাকতে শুরু করেছে। অন্যরা বিরক্ত মুখে অপেক্ষা করছেন। তাদের সঙ্গে আসা নঈম ভেতরে গিয়ে একটি চক্কর কেটে এসে মন্তব্য করলেন, কি মুখরা একেকটি বুড়ি। দিনারা চোখের জলে একাকার। মেয়েগুলো নানা রকম খোটা দেয়া শুরু করেছে। কুদ্দুস মেম্বারের বউটা, একটি দজ্জাল। সারা শরীরে অলঙ্কার পরে বাড়ি জুড়ে পায়চারী করছে আর তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করছে। শুনে শাহেদ অবাক হয় না। বিকালে জিপে বসেই তো মহিলাটি নানা মন্তব্য করছিল। দিনারার জন্য তার খুব মায়া হয়। মেয়েটিকে সারাজীবনই এ খোটাখুটির যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে। মেয়েরা কি এ জন্যই জন্মায়? শাহেদের বোনের কথা মনে পড়ে।
বরের কনিষ্ঠ এসে খুবই অনান্তরিক স্বরে হাঁক দেয়- কার কার ক্ষুধা পেয়েছে আসুন। অপমানে শাহেদের মুখ লাল হয়ে গেল। এ কোন ভুতের রাজ্য রে বাপ। শুনেই পিত্তি জ্বলে গেলো মোরশেদের। অস্ফুষ্ট স্বর বেরিয়ে এল গলা দিয়ে- শালা!
রাজাখালী থেকে চল্লিশ কিলোমিটার দূরে শাহেদদের বাড়ি। সেখানে এত অনান্তরিক কণ্ঠে ডাকলে কুকুরও খেতে আসবে না। জয়নাল জানে, মোশতাকও জানে। কিন্তু অপমানে লাল হওয়া ছাড়া কিইবা করার আছে। তারা সেটাই হয়, লালে লাল।
তারা কেউ ভেতরে যাচ্ছে না দেখে একটি বয়স্ক মানুষ আবারও হাঁক দেয়, কই খেতে আসেন।
এতক্ষণ চুপচাপ থাকলেও জয়নাল এবার গলা চড়িয়ে ডাকে বেয়াইকে। কি মিয়া আমরা আপনাদের বাড়িতে কি কামলা এসেছি নাকি? মেহমানদের আপ্যায়ন তো করলেন না উল্টো এত রাতে জানতে চাচ্ছেন ক্ষুধা পেয়েছে নাকি।
জয়নালের কণ্ঠে ঝগড়া ও অপমানের কান্নার সুর যুগপৎ উপছে পড়ছে। বরের কনিষ্ঠ কবির সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করেই রেডিও হাতে চলে গেল ভেতরে।
কয়েকজন বুড়ো খাবার পর্ব সেরেই বরের খোঁজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। কন্যাযাত্রী আবুল কিছুটা শ্লেষ জড়িয়ে বললেন- বরতো লাখ টাকার কারবারি। টাকা গুণতেই নাকি আঙুল ব্যথা হয়ে যায়।
আরেকজন টিপ্পনি কাটে, বরের মুখে নাকি বসন্তের দাগ আছে। বেচারা হয়তো লজ্জায় দেরি করছে। বুড়ো লোকগুলো এভাবে গ্রাম্য ঠাট্টা মশকরায় মেতে ওঠে।
কন্যাযাত্রী বুড়োদের মুখ ঝামটা দিয়ে কুদ্দুস মেম্বারের বউ বলে ওঠে, লোকের মতো ফকির না। অন্যের কাছে চেয়ে চিন্তে খায় না। আমার ভাগনের মুখ থেকে নুরের জ্যোতি বেরুয়।
শাহেদের এসব মেয়েলী প্যাঁচাল ভাল লাসে না। তবে দুপুর থেকেই সারাপথে কুদ্দুস মেম্বারের উজ্জ্বল শ্যামলা উচ্ছল মেয়েটিকে দেখে তার ভেতরে অন্যরকম একটি অনুভূতি জন্মেছে। রাতে উঠোনে পাল্টানো পোশাকে মেয়েটিকে আরেক ঝলক দেখে তার মনে হয়Ñ আজ কি পূর্ণিমা তিথি। মেয়েটির সঙ্গে কথা বলতে পারলে সময়টা ভাল কাটতো। তবে এখন তার মায়ের কথা শুনে চোখে মুখে মরিচের জ্বালা অনুভব করে। ‘বর আসছে না, বর কই, কখন আসবে’ সবাই একে অন্যকে প্রশ্ন করছে আর প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। মেয়ে পক্ষের লোক হলেই যত জ্বালা। মনের বিরক্তিও প্রকাশ করা যায় না।
উঠোনে অপেক্ষারত কন্যাযাত্রীদের গুঞ্জণে হঠাৎ জল ঢেলে দিলেন কুদ্দুস মেম্বারের বউ। বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে ঘোষণা দিলেন, সবাই আলহামদুলিল্লাহ বলেন। বর-কনে কবুল বলেছে। মানে? একযোসে সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন সবার। সবার প্রশ্নের নীরব উত্তর হিসেবে তার পেছনে পেছনে হাসিমুখে বেরিয়ে আসে একজন বয়স্ক মৌলভী। বোবা একটি মুহূর্ত কাটানোর পর বুড়ো কন্যাযাত্রীরা আলহামদুলিল্লাহ পড়লেন। এবার নিশ্চয় বরকে দেখা যাবে। আবার সবার মধ্যে বর দেখার কৌতূহল চারিয়ে ওঠলো। দুলাভাই কই, নাতজামাই কই? বুড়োরা আবারও জানতে চাইলেন। শাহেদ আর মোরশেদ ভেবে পায় না, বিষয়টি কি? সে সন্ধ্যা থেকে কন্যাযাত্রীরা অপেক্ষা করছে। কিন্তু গভীর রাতে বাড়ি ফিরে গোপনে বিয়ে পড়লেন বর। শেষ দফা অপমানে লাল হয় কন্যাযাত্রীরা। জয়নালের চোখ দিয়ে টপটপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে।
মোরশেদ হঠাৎ বলে ওঠে, চলো শাহেদ।
কোথায়?
ফিরে যাই...
কিভাবে?
পূর্বদিকে হাঁটতে শুরু করলে সকাল নাগাদ নানাবাড়ি পৌঁছে যাবো। পারবে হাঁটতে?
শাহেদের মনে হচ্ছিল সে কোন ভুল জায়গায় এসেছে। তাই তার অনিবার্য উত্তর, হ্যাঁ।
কন্যাযাত্রীদের জটলা থেকে ইশারায় মোশতাককে ডাকে মোরশেদ। কাছে আসতেই মোরশেদ ফিসফিসিয়ে বলে, তুমি জয়নালের সঙ্গে থাকো আমরা চললাম। কোথায় যাচ্ছি সেটা জিজ্ঞেস না করেই বোকার মতো ঘাড় নাড়লেন মোশতাক। জামাইবাড়ির উঠোন থেকে বেরিয়ে তারা পূর্বদিকে হাঁটতে শুরু করে। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ আলো বিলাচ্ছে। চাঁদের আলোয় ধুলো ওড়া পথে পা বাড়িয়েই তাদের মনে হয় কোন কনসেনট্রেশন ক্যাম্প থেকে তারা পালিয়ে যাচ্ছেন। ধীরে ধীরে তাদের চলার গতি বাড়ে। পেটের ক্ষুধা-তৃষ্ণা উবে যায়।
প্রথমে শাহেদই মুখ খোলে। আমরা যে চলে এলাম বিষয়টি কেমন হলো?
মোরশেদের সোজা উত্তর- ভাল। ওরা আমাদের খুঁজবেও না।
যে বাড়িতে সন্ধ্যা থেকে এক গ্লাস পানি খেতে দেয়নি তারা আবার আমাদের খুঁজবে।
নিজের এ অতিসামাজিক মনোভাবের জন্য শাহেদের হাসি পায়। কোথাও গেলে তার সবসময় মনে হয় কে কি মনে করছে, কি ভাবছে ইত্যাদি। তবে জয়নালের জন্য তার সত্যি সত্যিই খারাপ লাগে। বেচারা কন্যার ভাই। যেন কত বড় অপরাধ করে ফেলেছে। পদে পদে বন্ধুদের কাছে মুখ ছোট আর তালুই বাড়িতে তাচ্ছিল্যের শিকার হতে হচ্ছে।
ধীরে ধীরে তাদের গল্প জমে উঠে। দূরত্ব অজানা থাকায় তারা কতটুকু এগুলো তা বুঝতে পারে না। পূর্ণিমা রাতের নানা গল্প ডালপালা ছড়াতে থাকে। পথের দুই পাশের বিচ্ছিন্ন বাড়িগুলোকে আকাশের নিচে বিস্তীর্ণ মাঠে এক একটি স্তূপের মতো মনে হয়।
হাঁটতে হাঁটতেই তাদের সামনে পড়ে মূর্তিমান অজগর। সমুদ্র নালাটিকে শাহেদের বিশাল বিস্তীর্ণ বিলে ছুটে চলা অজগরের মতো মনে হয়। পায়ে জুতো, সামনে খাল। দু’জনই গ্রামের ছেলে। খাল পেরুনোর বিস্তর অভিজ্ঞতা। তারপরও তারা এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়ায়। মোরশেদ দ্রুত প্যান্ট তুলে খালে নেমে পড়ে। তবে কয়েক কদম এগুতেই গভীর কাদায় তার পা দেবে যায়। অবস্থা বেগতিক দেখে শাহেদ তাকে টেনে তুলে। কাদামাখা পায়ে রাস্তায় ওঠেই তারা হঠাৎ হাসিতে গড়িয়ে পড়ে। তারপর দক্ষিণমুখী হাঁটা শুরু করে।
চ.
শার্টপ্যান্ট ইন করা মোরশেদকে হাতে জুতো নিয়ে হাঁটতে দেখে শাহেদের বেশ মজা লাগে। গভীর রাত, দেখার কেউ নেই। কিছুক্ষন হাঁটার পর দূর থেকে রাস্তার পাশে একটি বাড়ির উঠোনে কুপি বাতি জ্বলতে দেখা যায়। কাছে গিয়েই মোরশেদ জানতে চায়, বাড়িতে কেউ আছেন? সঙ্গে সঙ্গেই উঠোনের এক কোন থেকে সাড়া মিলে। একটি বুড়ো লোক হাঁক দেয়- কে?
সহজ সরল গ্রাম্য মানুষের সঙ্গে সহজ উত্তর দেয়াই ভাল। চাতুর্যপূর্ণ উত্তর আবার কোন বিপদ নিয়ে আসে। তাই মোরশেদ বলে- আমরা পথিক।
বুড়োটি এবার তার ছেলেকে ডাক দেয়, দেখতো বশির কারা।
এবার বশির নামের মধ্যবয়সী লোকটি তাদের কাছে এসে কিছুটা অবাক হয়।
আপনারা কারা? কোথায় যাবেন?
বাড়ি বিলপুকুরিয়া। রাজাখালী বেড়াতে গিয়েছিলাম।
এতরাতে কোথায় যাবেন?
জরুরি বাড়ি ফিরতে হচ্ছে, একটু খালের পুলটি দেখিয়ে দেবেন?
বশির দক্ষিণদিকে আঙুল উঁচিয়ে বলেন, সামনে হাঁটতে থাকেন।
বশিরদের বাড়ির উঠোনের পুকুর থেকে পায়ের কাদা ধুয়ে নেয় মোরশেদ।
বাঁশের সাকো পার হয়ে তারা খাল পার হয়। এবার নদীর ওপার দিয়ে যত পথ হেঁটেছিল ঠিক তত পথ উল্টো উত্তর দিকে হাঁটে। পূর্বপাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে পশ্চিম পাড়ে ফেলে আসা বিয়েবাড়ির কথা মনে হচ্ছিল শাহেদের বারবার। খালপাড়ের পথে বাঁশবন, শো শো শব্দ। কোন পথে যাবে সেটা নিয়ে দু’জনের দ্বিধাদ্বন্দ্ব।
আবার পূর্ব দিকে হাঁটা। প্রথম পাড়াটি অতিক্রমের সময় বাড়ির লোকজনের গলা শোনা যাচ্ছিল। একটি শিশুর কান্না আর তার মায়ের আদর কানে আসে। রাস্তার পাশে মসজিদের নলকূপ থেকে পানি খায় তারা। কিছুক্ষণ বেঞ্চিতে বসে বিশ্রাম নেয়। পাড়ার আঁকাবাঁকা মেঠোপথ ধরে তারা আবার হাঁটা শুরু করে। কিছু দূর উত্তর দিকে হাঁটার পর তারা মাঠের মধ্যখান ধরে পূর্বদিকে চলে যাওয়া একটি বড় আলপথে নেমে পড়ে। কিছুদূর যাওয়ার পর দ্বিতীয় পাড়াটি শুরু হয়। আবারও ধান কাটা ধুঁ ধুঁ মাঠ। মাঝে মাঝে কিছু জমিতে এখনও পাকা ধান কাটা হয়নি। শুক্লপক্ষের কোমল আলোতে আবছা কুয়াশা ছড়িয়ে পড়ছে আবিরের মতো। চাঁদটা যেন অভিজাত গৃহিণীর মতো গলে গলে পড়ছে সম্ভ্রমে। সারিবদ্ধ নাড়ার ডগাগুলো ঊর্ধ্বমুখী হয়ে সাজিয়ে তুলেছে বিস্তীর্ণ মাঠ। সৃষ্টি করেছে এক অপূর্ব ব্যঞ্জনা। আঁকাবাঁকা আলগুলো যেন সহমর্মিতায় পরস্পর হাত ধরাধরি করে নিশ্চুপ শুয়ে আছে। পূর্ণিমার হলুদ আলোয় ধানকাটা মাঠের অপূর্ণ দৃশ্য তাদের মাথা ধরিয়ে দেয়। তাদের ডানপাশের একটি বাড়ির আঙ্গিনায় হঠাৎ কয়েকটি পাটি সশব্দে ডানা ঝাঁপটে ডাল পরিবর্তন করলো। শাহেদ গান ধরে...।
ধু-ধু মাঠে হঠাৎ দুটো টর্চের তীব্র আলো তাদের চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। মুহূর্তেই দু’জনের শিরদাঁড়া বেয়ে একটি ভয়ের স্রোত নেমে যায়। বিস্ময়াবিভূত হয়ে তারা থমকে দাঁড়ায়। দূর থেকে কড়া প্রশ্ন আসে- এ কে রে তোরা?
আমরা পথিক...
এদিকে আয়... কড়া ডাক।
তারা ধীরে ধীরে আলোর উৎসে গিয়ে নিজেদের পরিচয় দেয়। তখনো তাদের দৃষ্টি স্বাভাবিক হয়নি। ষণ্ডা প্রকৃতির একজন চোখ রাঙিয়ে তাদের প্রশ্ন করে- তোরা কারা? কোথায় যাবি?
বিলপুকুরিয়া... মোরশেদের নি®প্রান উত্তর।
আরেকজন বলে উঠে- শালাদের আসে বেঁধে ফেল।
প্রথম লোকটি বলে- দরকার নেই।
এরই মধ্যে তাদের কয়েকজন শাহেদ ও মোরশেদকে ঘিরে ফেলে। মাপলার ও মুখোশে মুখ ঢাকা এসব লোকের চেহারা দেখা যায় না। তবে বুঝতে বাকি নেই লোকগুলো ডাকাত। একজনের হাতে একটি দোনলা বন্দুক। দু’জনের মুখ থেকে কোন কথা সরে না। থ হয়ে পড়া মোরশেদের প্রতি নতুন প্রশ্ন- এতরাতে কোথা থেকে আসছো ?
রাজাখালী থেকে।
এতরাত কেন?
পাশ থেকে আরেকজন তাড়া দেয়- টাইম নেই। শালাদের বেঁধে ফেলে রেখে চল যাই।
মোরশেদ ষণ্ডামার্কা লোকটিকে অনুনয়ের সুরে বলে- কাল আমাদের পরীক্ষা।
মোরশেদ বানিয়ে রাখা গল্প শুরু করে- আমরা একটি বিয়ে বাড়িতে গিয়েছিলাম। হৈ হুল্লোড়ে দেরি হয়ে গেছে। পরে গাড়ি মিস করে অনন্যোপায় হয়ে হেঁটেই বাড়ি ফিরছি। আগামীকাল দুপুরে আমাদের পরীক্ষা আছে। সকাল সকাল চট্টগ্রাম শহরে ফিরতে না পারলে পরীক্ষা দিতে পারবো না।
কোথায় পড়ো? এবার কণ্ঠ কিছুটা নরম...
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে...
এতক্ষণ নীরব ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা শাহেদকে ডেকে প্রশ্ন করে- এ তোর বাড়ি কই?
বিলপুকুরিয়া...
শার্ট-প্যান্ট পরা দু’জন তরুণকে দেখে ডাকাতরা দ্বিধাদ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে। একেক জনের একেক মত। ষণ্ডামার্কা লোকটি এক মুহূর্ত কি যেন ভাবলেন। এদিকে তার সঙ্গীদের ঘন ঘন তাড়া আসছে। এবার লোকটি তাদের ইশারায় মাঠের কোনাকুনি পথ দেখিয়ে দিয়ে বলেন- ওদিকে চুপচাপ হাঁটতে থাক। কোন শব্দ করলে গুলি করবো। বুঝছিস...। মোরশেদ একটি ঢোক গিলে বলে- জ্বি।
ডাকাতরা তাদের ভুল পথে ফসল তোলা মাঠের দিকে চলে যেতে বলে। ডাকাতদের ইশারা করা পথে তারা মাঠের কোণাকুনি হাঁটতে শুরু করে। ভয়ে একটি বারের জন্যও পেছনে তাকায় না। শাহেদের মনে হয়- এই বুঝি একটি গুলি তাকে ভেদ করে ছুটে গেল। ভয়ে জমে যাওয়া পাথরের মতো ভারী পায়ে হাঁটা পথ যেন হাজার মাইলের ফুরোবেই না। একটি নাড়ার ডগা শাহেদের জুতার পাশ দিয়ে পায়ে বিদ্ধ হয়। আহ্ শব্দে শাহেদ বেদনা প্রকাশ করতেই শাহেদ মৃদু স্বরে তাড়া দেয়। আরেকটু জোরে...। শাহেদ ভাবে সুযোগ পেয়ে সদ্য কাটা ধানের নাড়াগুলোও যেন প্রতিশোধ প্রবণ হয়ে ওঠেছে।
কোনাকুনি মাঠ ধরে কিছুদুর সামনে যেতেই বিচ্ছিন্ন কয়েকটি বাড়ি চোখে পড়ে। বাড়িগুলো পার হতে না হতেই পেছন দিক থেকে গুলির শব্দ আসে। হৈ চৈ ও চিৎকারের শব্দ আসে। দ্বিতীয় গুলির শব্দের সঙ্গে সঙ্গেই পাড়ার কুকুরগুলো একযোসে ডেকে ওঠে। তারা আবারও থমকে দাঁড়ায়। বেকুবের মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। অজানা আশঙ্কা তাদের গ্রাস করতে চায়। আবার অতিসন্তর্পণে হাঁটা ধরে। তারা এতই সন্তর্পণে বিড়ালের পায়ে হাঁটে যে, যেন তাদের পায়ের শব্দে পাড়ার লোকের ঘুম ভেঙে যাবে। গ্রামবাসী জেসে ওঠে তাদের ডাকাত সন্দেহ করে পিঠিয়ে হাড্ডি ভেঙে দেবে।
ছ.
কত দূর এলাম... শাহেদের কণ্ঠে কৌতুহল।
মনে হয় টৈঠংয়ের কাছাকাছি... মোরশেদের নির্লিপ্ত উত্তর।
আর কতদূর...
মাইল দশেক হবে হয়তো..
আকস্মাৎ আলের উপর দিয়ে নাড়ায় শব্দ তুলে কি একটি যেন শোঁ শোঁ শব্দ করে ছুটে গেল। শাহেদের বুকের ভেতর ভয়ের শিহরণ জাগে। আস্তে মোরশেদ... কি যেন ছুটে গেল।
সাপ হয়তো...
ওরে বাপরে... সাপ! শাহেদের গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়। কণ্ঠে স্পষ্ট ভয়ের রেশ।
ভয় পেয়েছেন?
পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ভয় পাই ওই সাপ খোপ।
দুই জন আছি ভয় করবেন না।
অন্য ভয় নয়, তবে সাপের কথা আলাদা। এবার মোরশেদ হো হো করে হেসে ওঠে। এখন আর ভয়ের কারণ নেই। পেছনের ডাকাতদল অনেক দূরে ফেলে এসেছি।
সামনে... শাহেদের কণ্ঠে নতুন আশঙ্কা।
সামনে বারবাকিয়া বাজারের পশ্চিমের জঙ্গলপথেও ডাকাতি হয়। তবে একদলকে যেহেতু পেছনে ফেলে এসেছি তাই সামনে আরেকদল পড়বে বলে মনে হয় না।
সামনে পড়লেও সে পুরনো গল্প...এবার এতক্ষণ ভয়ার্ত শাহেদও হেসে ওঠে। সাপের ভয় ও রাতের গল্প... ধুলোময় মেঠো আলপথ ধরে হাঁটতে ভালই লাগছে। মন থেকে ধীরে ধীরে কেটে গেছে ডাকাতের ভয়। বিল পেরুতেই হঠাৎ একটি উঁচু খোয়াভাঙা পথের এসে তারা ওঠে। মোরশেদ চিনতে পারে। পথটি উত্তরে টৈটংয়ের দিকে চলে গেছে। এবার টৈটংয়ের খোয়া ভাঙা পথ ধরে অগ্নিকোনামুখী তারা হাঁটতে থাকে। ততক্ষণে আবার খুলে গেছে গানের গলা।
হাঁটতে হাঁটতে আবার নিকষ অন্ধকার। দুইধারে গা ছমছম করা জঙ্গলাকীর্ণ নিঃশব্দ নির্জন পথ। শেয়ালের হুক্কা হুয়া ডাক, বুনো পশুপাখির সশব্দ পদচারণা, ডালে ডালে পাখিদের ডানা ঝাপটানি তাদের মনে আবারও ভয় ধরিয়ে দেয়। জঙ্গলের পথে এগুতেই উঁচু ও ঘন গাছপালার কারণে চাঁদের আলো অতিম্লান হয়ে ঝরে। ফলে চারদিক থেকে নিকষ অন্ধকার তাদের গিলে খেতে চায়। যেন কোন নির্জন প্রেতপুরীতে এসে পড়েছেন। শাহেদ ভয় তাড়াতে গল্প শুরু করলেও মোরশেদ দোয়া দরুদ... পড়তে থাকে।
পাহাড়ি নির্জন পথ অতিক্রম করে তারা বারবকিয়া বাজারে এসে পৌঁছে। তখন ফজরের আযান পড়ে পড়ে সময়। তারা বাজারের একটি খোলা চকিতে বসে বিশ্রাম নেন। পা এগুনো যাচ্ছে না। ক্ষুধায় অর্ধেক হয়ে গেছে দু’জনেই। ভেতর থেকে বন্ধ একটি মুদি দোকানের কড়া নাড়ে। ভাই ভেতরে কেউ আছেন? কোন সাড়া শব্দ নেই। মনে হয় ভেতরে কেউ নেই।
ভেতরে কেউ আছেন?
কে? ভয় এবং গাম্ভীর্যময় ঘুম জড়ানো স্বর।
মোরশেদ নিজের পরিচয় দিয়ে বলে- ভাই আমরা খুবই ক্ষুধার্ত। দোকানে কি বিস্কুট আছে?
এরই মধ্যে ভেতরে কুপি জ্বলে উঠে। একটু পর দোকানের কাঠের একটি পাল্লা খুলে বেরিয়ে আসেন দোকানি সোলেমান। হাতে তার দীর্ঘ উলঙ্গ ধারালো কিরিচ। কিরিচ হাতে দোকানদারকে বেরুতে দেখেই ভয়ে সেটিয়ে যায় শাহেদ। পরক্ষণেই আনমনে হেসে ওঠে। বেচারা নিশ্চয় তাদের ডাকাত-টাকাত ভেবেছে। সোলেমানও শার্ট প্যান্ট পরা দুই তরুণকে দেখে কিছুটা ভড়কে যায়।
এত রাতে কোথা থেকে আসছেন?
মোরশেদ চতুর্থবারের মতো বানানো গল্প শুরু করে...
বাজারের মসজিদের মুয়াজ্জিনের গলা শোনা যাচ্ছে। বাজারের কুকুরগুলোও জেসে ওঠেছে। কোন একটি বাড়ি থেকে একটি মোরগ বাক্ দিয়ে ওঠল। সোলেমান সওদাগর দুই প্যাকেট বেকারীর বিস্কুট বের করে দেয়। সঙ্গে একটি পানির গ্লাসও। শাহেদ নতুন হলেও মোরশেদের পরিচিত এ বাজার। সে বাজারের নলকূপ থেকে পানি নিয়ে আসে। সত্যি সত্যিই তাদের প্রচুর ক্ষুধা পেয়েছে। এতক্ষণ বুঝতেই পারেনি ভয়ে এবং উত্তেজনার চোটে। দুই প্যাকেট বিস্কুট শেষ করে পানি খেয়ে তারা বাজারের খোলা চৌকিতে বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়। তখন চারদিকে আযান শুরু হয়ে গেছে। দু’একজন করে মুসল্লিরা ঘুম ভাঙা চোখে মসজিদের দিকে ছুটছে।
এখন আর তাদের পা চলছে না। ক্ষুধার্ত অবস্থায় সারারাত হাঁটার পর পেট ভরে বিস্কুট আর পানি খাওয়ায় তাদের শরীরে ক্লান্তি নেমে আসে। শাহেদের পা ব্যথা করছে। মনে হচ্ছে, দু’পায়ে কেউ ভারী পাথর বেঁধে দিয়েছে। সেই সঙ্গে একটি বিজয়ের স্ফুর্তিও অনুরণন তুলছে স্নায়ুতে। মোরশেদ খেয়াল করে অদূরেই চ্যাপ্টামুড়ার শীর্ষে উঁকি দিচ্ছে নতুন দিনের রক্তাভ আভা।
kafi_bd80@yahoo.com
No comments:
Post a Comment