Saturday, May 19, 2012

খুন
কাফি কামাল

বৃষ্টি ঝরছে। সদ্য বিধবা তরুণীর বউয়ের মতোন। ফুপিয়ে ফুপিয়ে বিরতীহীন। বৃষ্টির এমন আচরণে ভেতরের বিরক্তিটা ধীরে ধীরে রাসে রূপান্তর ঘটছে মুন্নীর। চৈত মাসের মরিচের মতো। 
কথা ছিল মুন্নী আর মিঠু সিনেমা দেখতে যাবে। বেইলী রোডের সাগর পাবলিসার্সের সামনে থেকে তারা অটোরিক্সা ধরবে। কিন্তু অকারণ বৃষ্টি ঝামেলা পাকিয়ে দিয়েছে। ঘড়ির কাটা চারটার ঘর পেরিয়ে গেছে। বৃষ্টি থামছে না। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে পাশে শাড়ীর দোকানে আশ্রয় নিয়েছে মুন্নী। অনেকক্ষণ ধরে শাড়ি নেড়ে চেড়ে দেখছে মুন্নী। কিছুক্ষন পর পর হাতঘড়ির দিয়ে এক পলকে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছেন। মনে মনে উদ্ধার করছে হৃদয়ের চৌদ্দগোষ্ঠী। বাইরে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। জল আর যানজটে একাকার হয়ে গেছে বেইলী রোড। হঠাৎ বৃষ্টি নামায় ক্রেতার সংখ্যা এমনিতেই কম।
এতক্ষণে খেয়াল করল দোকানের ছেলেটা তার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে। ছেলেটি কি মুন্নীকে অন্যরকম কিছু ভাবছে। আশপাশে কোন রেস্টুরেন্টও নেই যে সেখানে বসে। তাই বারবার ফোন করছে মিঠুকে। কয়েকবার সে জবাব দিয়েছে- হোয়াইট হাউজের সামনে বৃষ্টিতে আটকা পড়েছে। ছাতা নেই, রিক্সাও মিলছে না। একই কথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে, নানা ভঙ্গিতে। আর এখন রিংও ধরছে না। তাই সমস্ত রাগ জমছে বৃষ্টির ওপর। কবি কালিদাসের ওপরও। তিনি কাব্য করতে গিয়ে মেঘকে বানিয়েছিলেন ‘দূত’। কিন্তু এখন বৃষ্টি তার জীবনে এনেছে বিচ্ছেদের ঘটঘটা। বৃষ্টি কি রসিকতা জানে!
অনেকক্ষণ পর মুন্নির মোবাইল বেজে উঠে। স্ক্রিনে ভাসছে মিঠুর ছবি। কি বলবে সেÑ আবার সে ফ্যানফানানি? একটু অপেক্ষা করো জান। বৃষ্টি কমলেই আসছি। স্যরি... ইত্যাদি। দেরি করেই ফোন রিসিভ করে মুন্নি, বলো। ছোট্ট জিজ্ঞাসা।
আমি বাসায় ফিরছি।
মানে! মুন্নির কণ্ঠে বিস্ময়।
বাসায় জরুরি তলব। নিশ্চিত কোন ঝামেলা।
তাহলে আমি? এবার অসহায়ত্ব ফুটে উঠে মুন্নির কণ্ঠেÑ বলার মতো কোন কথা খুঁজে পায় না। দীর্ঘ দুইঘন্টা অপেক্ষার পর মিঠুর এমন কাণ্ডে কিইবা বলার থাকতে পারে। কিন্তু তাকে কিছুই বলতে হয় না। ওইপ্রান্ত থেকে লাইনটি কেটে গেছে।
অঘোর বৃষ্টির মধ্যে এমন একগুয়ে পরিবেশে তাকে অপেক্ষায় রেখেছে পাক্কা দুইঘন্টা। এখন দেখা না করেই পালিয়ে যাচ্ছে বাসায়। অথচ তিনদিন ধরেই মোবাইলে অনুনয়-বিনয়। তোমাকে নিয়ে সিনেমা দেখতে ইচ্ছা করছে। আগের দিনে নাকি কপোত-কপোতীরা চুপিচুপি একসঙ্গে সিনেমা দেখতো। আমারই তোমাকে নিয়ে... জানো, বসুন্ধরা সিনেপ্লেক্সে চলছেÑ ...। দুপুরে বেইলী রোডে আসবে কিন্তু। এখন বলছে কিনা, বাসায় জরুরি তলব!
মুন্নীর মনে সন্দেহ উঁকি দেয়। মিঠু কি হঠাৎ শায়লার ফোন পেয়েছে? ঝালঝোল রেস্টুরেন্টের ঘটনাটি তার মনে পড়ে। সেদিন ফার্মগেটের ঝালঝোল রেস্টুরেন্টে বসে আড্ডা দিচ্ছিল। হঠাৎ একটি ফোন পেয়ে মিঠু হন্তদন্ত হয়ে টেবিল থেকে উঠে দুরে গিয়ে কথা বলে। মুন্নী তাৎক্ষনিক কোন প্রতিক্রিয়া দেখায় না। মিঠু যেচে বলে- ভাই রিং দিয়েছিল। কিন্তু সে যখন ওয়াশ রুমে গেল তখন মুন্নী রিসিভ কলের নাম্বারটি টুকে নিল। রাতে ফোন করতেই ভেসে এলো একটি নারীর কণ্ঠস্বর। কৌশলে অন্য আরেকজনকে খুঁজতেই মহিলা বললেন- তিনি শায়লা, চাকুরি করেন। মুহুর্তেই যা বোঝার বুঝে নিয়েছে মুন্নী। কিন্তু বিষয়টি বেমালুম চেপে গেছে মিঠুর কাছে। আজকালের ছেলে মেয়েরা একাধিক সম্পর্ক রাখে। কিন্তু কেউ একজন শক্তভাবে চেপে ধরলে অন্যগুলো হারিয়ে যায়। কিন্তু আজ মিঠুর আকস্মিক সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে মুন্নীর সন্দেহ গাঢ় হয়।  
মোবাইল আবারও বেজে উঠে। স্ত্রিনে মিঠুর ছবি ভাসছে। বাজছে, বেজেই যাচ্ছে। মুন্নির রিসিভ করতে ইচ্ছে করছে না। কিছুক্ষণ পর রাগ করেই কলটি রিসিভ করলো সে। চুপচাপ...।
ওইপ্রান্ত থেকে মিঠু বলছে- রাগ করো না জান। কাল-পরশু সুযোগ করে আবার বেরুবো। এবার বাসায় চলে যাও।
মুন্নি বিরক্ত হয়ে রিং কেটে দেয়ার আসে বললো- হা করে থাকো।
কী অদ্ভুত! মিঠুর সঙ্গে কথা শেষ হতে না হতেই একটি খালি রিক্সা চোখে পড়লো মুন্নির। মুহূর্তেই ভুলে গেলো সে কোথায়। বাচ্চা মেয়ের মতো ডাক দিলে- এই রিক্সা।
চোকরা রিক্সাওয়ালা ঘুরে দোকানের সামনে এনে দাঁড় করায়। ভিজে একসা চোকরাটির থুতনি চুইয়ে ঝরছে অবিরল বৃষ্টিজল। তার মুখে কথা নেই, চোখে প্রশ্ন ভাসে- কোথায় যাবেন?
যাবে, ওয়ারলেস মোড়?
চোকরা মুখে কথা ফুটে না। ইশারায় রিক্সায় উঠতে বলে।
মুন্নি অনেকক্ষণ ধরে একগুয়ে পরিবেশ থেকে মুক্তি খুঁজছিল। তাই দরদাম না করেই হুড়মুড়িয়ে রিক্সায় চড়ে বসে। তাতেই বৃষ্টির ছাট ভিজিয়ে দিয়েছে তার ত্রিপিস। বৃষ্টির ঠাণ্ডা জল এখন কাপড় ভেদ করে শরীরে আলপিনের মতো বিঁধছে।
রিক্সা যখন মগবাজার ডাক্তার গলির মুখে পৌছালো ততক্ষণে বৃষ্টির তীব্রতা কমে এসেছে। মুন্নি হাতের পার্স খুলে দুইটি দশটাকার নোট বের করে আনে। হঠাৎ একটি নোটে তার দৃষ্টি আটকে যায়। সুন্দর হস্তাক্ষরে লেখা ‘প্রেম চাই’। নিচে একটি মোবাইল নম্বর। মুহূর্তেই কী এক কৌতুহল কম্পন তুলে তার নিউরণে। সে পাল্টে আরেকটি নোট রিক্সাওয়ালাকে দেয়।
ছোকরাটি গুনেও দেখে না। কোমরে গুঁজে রাখা পলিথিনের প্যাকেটে ঢুকিয়ে রিক্সা টান দেয়।
মুন্নি বাসায় ফিরতেই মা প্রশ্ন করে। এত দ্রুত ফিরলি যে, অনুষ্ঠানে যাসসি?
না মা, যাইনি।
এতক্ষণ কোথায় ছিলি? পাল্টা প্রশ্ন মায়েরÑ
বৃষ্টিতে আটকে পড়েছিলাম মৌচাকে।
বৃষ্টির দিন ছাতা নিলি না যে? রাবেয়া খাতুনের জিজ্ঞাসার যেন অন্ত নেই।
এতক্ষণ টানা বৃষ্টি হবে কে জানতÑ বলেই কথা না বাড়িয়ে মুন্নি নিজের কামরায় চলে যায়। মাত্র ক’ফোটা বৃষ্টি পড়েছে শরীরে। তাতেই শীত শীত লাগছে। দ্রুত কাপড় পাল্টে সে দুপুরের ঠাণ্ডা খাবার খেয়ে অসময়ে শুয়ে পড়ে।
সেদিন রাতে মুন্নীর মোবাইলটি অবিরত বেজে যায়। স্ক্রিণে মিঠুর নায়কোচিত ছবিটা যেন আর্তনাদ কর্ েকিন্তু মুন্নীর রাগ কমে না। ইচ্ছে করে মোবাইল সেটটি আচড়ে গুড়ো করে ফেলে। অনেক কষ্টে রাগ চেয়ে সে মিঠুর সঙ্গে সম্পর্কের দফারফা করার সিদ্ধান্ত নেয়। মেসেজ অপশনে গিয়ে তিন অক্ষরের ‘বাই’ শব্দটি লিখে পাঠিয়ে মিঠুর নাম্বারটি ব্লক করে দেয়।

রোববার দুপুর থেকে শুক্রবার দুপুর। একশ বিশ ঘন্টা পেরিয়ে গেছে। কিন্তু মুন্নীর মন থেকে রাগের ব্যথা সারছে না। পুরোনো ক্ষতের মতো থেকে থেকে জেসে উঠছে। কখনো অকাল বৃষ্টির উপর কখনো মিঠুর ওপর সে রাগ কালবোশেখীর ঝড়ের মতো বইতে থাকে। এরই মধ্যে অন্য নাম্বার থেকে একাধিকবার রিং দিয়েছে মিঠু। কিন্তু তার গলা শুনলেই মুন্নীর রাগের মাত্রা বেড়ে গেছে অবুঝের মতো। বৃষ্টি বা অপেক্ষা নয়, হঠাৎ বাসায় তলবের কথায় তার রাগ জমেছে। যে রাগের সহজ ক্ষরণ নেই।
দুপুরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে এলোমেলো ভাবতে থাকে মুন্নী। মিঠুর মুখটি চোখে ভাসে। রবিনের মুখটিও ভাসে। কলেজের আড্ডায় একবারে নির্জ্ঝাণ্ট ছেলেটি। হঠাৎ করে মোবাইল নাম্বার লেখা দশটাকার নোটটির কথা মনে পড়ে তার। পার্স থেকে ভাজ করা নোটটি বের করে আনে। তারপর কয়েকবার চোখ বুলায়। একবার মনে হয়- বোগাস। আরেকমন বলে- যেখানে দেখিবে ছাই...। মুন্নী ম্যাগাজিনে পড়েছে এরকম টাকা বা এখানে ওখানে পাওয়া নাম্বার থেকেই অনেক সম্পর্ক হয়েছে। এমন সব এলোমেলো ভাবতে ভাবতে সে সাহস করলো। সরাসরি ফোন করা নিরাপদ নয়। ক্ষুদেবার্তা পাঠানো যাক আগে। ভুল লোকের হাতে পড়লে কৌশলগতভাবে এড়িয়ে যাওয়া যাবে। বুড়ো হাবড়ার এবড়োথেবড়ো হৃদয়ে ঢুকে পড়লে ভুলে বলে সরে আসা যাবে।
ঘোরের মধ্যেই মুন্নী ক্ষুদেবার্তাটি লেখে- ‘দরজা খোলো’।
পরমুহুূর্তেই জবাব আসবে তা সে ভাবেনি। কিন্তু তাই হলো। পিলে চমকানো প্রশ্নের অতিক্ষুদ্র উত্তর- ‘কে’? মুন্নীর ভেতরটায় উতাল-পাতাল শুরু হয়ে গেল। মনে হচ্ছে- ব্যস্ত কেউ। ধুরন্ধর। কত কিছু...। ঘোরের মধ্যেই ক্ষুদেবার্তার লেনদেনে মেতে উঠলো দুইজন। কেউ কাউকে সরাসরি রিং দিচ্ছে না। কৌতুহল আর জমিয়ে তোলার মজাটা যখন তুঙ্গে উঠছে তখনই- বিরক্তি প্রকাশ করলো ওই নাম্বার। ক্ষুদে বার্তায় প্রকাশ পেল সে বিরক্তি। মুন্নী ছেড়ে দেয়ার পাত্রী নয়। আধার গেলা মাছ কে নিয়ে নিয়ে যেন শিকারী খেলা করছে।

বিশ্রামবার দুপুরে তাজমহল রোডের বাসা থেকে বেরিয়ে সংসদ ভবনের দিকে হাঁটছে মঞ্জু। মানিকমিয়া এভিনিউতে তার জন্য প্রেমিকাকে নিয়ে অপেক্ষা করছে তার স্কুল বন্ধু আশিক। আসলে তার প্রেমিকাকে দেখার লোভেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটছে মঞ্জু। লোকাল বাসের ভেতর চিড়ে-চ্যাপ্টা হওয়ার অস্বস্তি এড়াতে তার এ পদযাত্রা। যানজটে আটকে পড়া বাসের ভেতর মানুষের নানা ভঙ্গির মুখ। মেয়ে মানুষের আচল উড়িয়ে বাতাস খাওয়ার দৃশ্যে ফুটে ওঠছে গ্রীষ্মকাল। মঞ্জু সেসব উপভোগ করতে করতে চলছে আনমনে, কিন্তু দ্রুত।
ঘড়ির কাটা যখন চারটার পাথর ছুই ছুই করছে তখনই সে পৌছালো আসাদ গেটে আর বেঁজে ওঠলো মোবাইলের মেসেজ টোন। মনে মনে কষে একটি গালি দিলো আশিককে। শালা, প্রেমিকা নিয়েও সময় কাটে না। কিন্তু কি ভেবে যেন প্যান্টের চাপা পকেট থেকে মোবাইলটি বের করে। স্ক্রিনে ভেসে আছে একটি অচেনা নাম্বার। রবীন্দ্রনাথ কোম্পানীর। মঞ্জুর নিজের নাম্বারটিও একই কোম্পানীর। তাই থমকে দাঁড়িয়ে দু’সেকেন্ডের মধ্যেই মেসেজ অপশনে ঢুকে পড়ে।
দ্রুত পড়ে নেয়- দু’বাক্যের ছোট্ট মেসেজটি।
‘দরোজা খোলো’।
মজার তো! অপরিরিচত নম্বর। বলছে- দরোজা খুলে দিতে। মঞ্জুর মাথায় ধরে না। কে দিতে এমন ক্ষুদেবার্তা? সে তো দরোজায় তালা লাগিয়ে এসেছে। কেউ তার সঙ্গে দেখা করতে এলে তো দরোজায় তালা ঝুলতে দেখবে। চোখের মাথা খেয়েছো শালা। মঞ্জু মনে মনে গালি দেয়।
সেই সঙ্গে মনের ঘোরে ফিরতি বার্তাও লিখে- কে?
কয়েক মুর্হূতের মধ্যে ফিরতি ক্ষুদেবার্তার টোন বেজে উঠলো। এবার আরও সংক্ষেপে- ‘আমি’।
মঞ্জু কিছুটা বিরক্তি আর খানিকটা কৌতুহলী হয়ে পুনর্বার বার্তা ব্যাক করে। এক শব্দ বাড়িয়ে- ‘আমি কে রে বাবা?’
‘এসএমএস...’
‘কি চাও?’
জানতে চাইÑ ‘কেমন আছো?’
এবার কৌতুহল মিশ্রিত রাসে সে ফিরতি বার্তা পাঠায়- ভালো, ভালো এবং ভালো।
ক্ষুদেবার্তা আদান-প্রদানের ঘোরের মধ্যেই মঞ্জু মানিকমিয়া এভিনিউ ধরে সংসদের দক্ষিণচত্বরে পৌছালো। ঘোরটা কাটিয়ে দিলো একটি ‘সংসদ সদস্য’ স্টিকার সাটানো প্রাডো।
হার্ড ব্রেক কষে চালক পলকে সাইটগ্লাস নামালেন। মঞ্জু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সেদিকে তাকাতেই কড়া একটি ধমক এসে বিদ্ধ করে তাকে।
ওই মিয়া চোখের মাথা খাইছেন?
মঞ্জু কথা বাড়ায় না। অপরাধীর ভঙ্গিতে পাশ কাটিয়ে সামনে এগোয়। আকস্মিক সে বিব্রতবোধ করে। আশিক বা তার বান্ধবী দেখে ফেলেনি তো আবার। তারা এ ধমক খাওয়ার বিষয়টি দেখে ফেললে লজ্জ্বার মধ্যে পড়ে যাবে সে। তাই সে চোরা চোখে বন্ধু জুটির অনুসন্ধান করে। না কোথাও দেখা যাচ্ছে না। তখন তার মনে প্রশ্ন- তাহলে কি এখনও তারা এসে পৌছোয়নি?
মানিকমিয়া এভিনিউ’র উত্তরপাশে সংসদ আঙ্গিনার প্রান্তরেখায় বকুল গাছের সারি। ফুটপাতে ফুলে ফলে ভরা পাম গাছের সারি। গাছের নিচে ফুলের রেনু। সংসদমুখী হয়ে সে বকুল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে আশিক আর ইশা। নামেই অন্তমিল। মঞ্জু আগেই তাদের দেখে ফেলে। ভালোই তো! মেয়েটির পেছন দিকটা দেখে আনমনে মন্তব্য করে বসে।
মঞ্জু কাছে গিয়ে ডাক দেয়- আশিক। কখন এলি?
এই তো কয়েক মুহূর্ত। তা তুই শালার আসার সময় হলো এখন। মোহাম্মদপুর তাজমহল রোড থেকে মানিকমিয়া এভিনিউ আসতে এত সময় লাগলে, সম্রাজ্য রক্ষা করবি কেমনে?
না তোকে একটু বেশী সময়ই দিলাম।
মঞ্জু মৃদু হাসে। তখন পাশের চা ওয়ালার কেটলিতে গরমপানির বাষ্প উড়তে শুরু করেছে।

শুক্রবার দুপুর থেকে মুন্নীর মনটা বেশ ফুরফুরা। প্রজাপতির মতো উড়ছে। কিন্তু বুঝতে পারছে না কার সঙ্গে তার ক্ষুদেবার্তার লেনাদেনা চলছে। মানুষ কখনো কখনো এমনসব তুচ্ছ ঘটনায়ও আনন্দে উদ্বেল হয়। আবার অনেক বড় ঘটনায়ও হাসি লুকোতে ঠোঁট চেপে রাখে। রবিবার দুপুরে কলেজ থেকে ফেরার পথে গাড়ি বসেই একটি বার্তা পাঠায় সে নাম্বারে।
‘কই? কেমন?’
বার্তাটি পাঠিয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে সে। কিন্তু কোন সাড়া শব্দ নেই। কি হলো? ব্যস্ত নাকি বিরক্ত? ভাল লাসে না। কৌতুহল মজে আসে, উত্তর আসে না। বাসায় ফিরে খাওয়া-দাওয়া সেরে বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছিল মুন্নী। তখনই ফোনটি বেজে ওঠে। ক্ষুদেবার্তার রিং টোন। মুন্নী দেখে- যথাপ্রশ্ন তথা উত্তর। ‘রেখেছো যেমন!’
দ্রুত ফিরতি বার্তা লেখে সে- ‘মানে?’
উত্তর আসে- ‘দুর থেকে...’
মুন্নীর দুষ্টুমি জাগে- ‘কাছে আসবো?’
উত্তর আসে- ‘কেন নয়?’
মুন্নী হেয়ালী করে- ‘আসবো আমি তোমার কাছে স্বপ্নের মতো।’
উত্তর আসে- ‘কখন?’
মুন্নীর হালকা চাল- ‘জ্বালাবো তোমায় মিসকলের মতো, যখন তখন...’
উত্তরে নির্লিপ্ততা ‘তাই...’
মুন্নীর আকাঙ্খা- ‘সারাক্ষণ বাজবো তোমার মনে টোনের মতো।’
উত্তরে সারল্য ‘ভালো...’
মুন্নী লেখে- ‘আমাদের ভালোবাসা ফুরোবো নাÑ ব্যালেন্সের মতো।’
উত্তর আসে- ‘হা হা হা’

সেদিন বিকালে বান্ধবীদের সঙ্গে টিএসসিতে গিয়ে গিয়েছিল মুন্নী। সন্ধ্যায় ফেরার সময় কলেজের বন্ধু রকিবের সঙ্গে এক রিক্সায় চড়ছিল। অন্য দুই রিক্সায় তার বান্ধবীরা। ইস্কাটনের সব্জিবাগান পৌছার পর তাদের রিক্সাটি পাশ কাটিয়ে যায় মিঠু। বন্ধুর বাইকে করে ধানমণ্ডি যাচ্ছিল সে। চকিত দৃষ্টিতে সে দেখে মুন্নী একটি ছেলের সঙ্গে রিক্সায় গল্প করতে করতে ফিরছে। দেখেই তাকে মনে মনে কষে গালি দেয় মিঠু- শালি পল্টিবাজ। সে জানে মুন্নীর দিন রাতের রুটিন। তাই রাতে বাসায় ফিরেই অন্য নাম্বার থেকে তাকে ফোন দেয়। রিং ধরতেই মিঠুর রাগ ঝরে পড়ে- শালি মরদ পাল্টাও না। তোমার নতুন মরদকে দেখে নেব।
শুনেই শব্দ করে হেসে ওঠে মুন্নী। আর বলেই লাইনটি কেটে দেয় মিঠু।

রবিবার দুপুরে শুয়ে শুয়ে রূপচর্চার বইটির পাতা উল্টাচ্ছিল মুন্নী। এ সময় মোবাইল বেজে উঠে। ওই নাম্বার থেকে একটি ক্ষুদেবার্তা এসেছে। খুবই ছোট্ট- ‘কই?’।
মুন্নী বুঝতে পারে পাখির ডানা ঝাপটানি শুরু হয়েছে। অপেক্ষা করছে তার ক্ষুদেবার্তার। পুরুষ মানুষ এরকমই। তুচ্ছতার মাঝেও মহৎ কিছু খুঁজে। মনে মনে হাসতে হাসতে সে উত্তর দেয়- ‘দিচ্ছি’।
মুহুর্তেই জবাব আসে- ‘কখন?’
এবার মুন্নীর দুষ্টামীর খেয়াল চাপে- ‘সকালে দু’বার।’
জবাব আসে- ‘ওফ!’
মুন্নী কৌতুহল বাড়ায়- ‘দুপুরে দ্বিগুন।’
জবাব আসে- ‘বলো কি!’
মুন্নী লেখে করে- ‘বিকালে অসংখ্যবার।’
জবাব আসে- ‘সত্যি!’
মুন্নী লেখে- ‘রাত্রে একাকার।’
জবাবে আসে- ‘ওহ্’
মুন্নী লেখে- ‘এমন ঋণী করবো...’
জবাব আসে- ‘কেমন?’
মুন্নী লেখে- ‘শোধের সুযোগ পাবে না।’
জবাব আসে- ‘কিন্তু কি দেবে, জান?’
মুন্নী লেখে- ‘মিসডকল।’
এ প্রথম ‘জান’ শব্দটি লিখলো মঞ্জু। সহজে এমন অন্তর্গত শব্দটি ব্যবহার করে নিজেই লজ্জ্বা পেল। আর বিছানায় শুয়ে শুয়ে মুন্নী হাসে। নিরবে। আহা, পুরুষের মন। 

সকালে মায়ের সঙ্গে নাস্তা তৈরি করছিল মুন্নী। তখনই মোবাইলটি বেজে উঠলো। মেসেজ টোন কানে আসতেই কলজেটা ধক করে উঠলো তার। তাহলে কি রহস্যময় নে নাম্বার থেকে? কিন্তু মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে অন্যজিনিষ। সাতসকালে মোবাইল কোম্পানীর প্যাকেজ সুবিধার বিজ্ঞাপন। মুন্নী রহস্যময় নাম্বারকে লেখা মেসেজের কথা রাখে। পরপর দু’টি মিসকল দেয়। একটু অপেক্ষা করে দেখে কোন সাড়া নেই।
দুপুরে সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে মায়ের সঙ্গে টিভি দেখছিল মুন্নী। বড়লোকের পারিবারিক কুটনামি নিয়ে গন্তব্যহীন ধারাবাহিকটি তাদের খুব পছন্দের। সেখানে বাড়ির বড় মেয়েটি গোপনে প্রেমিকের কাছে ফোন করতে গিয়ে ধরা পড়েছে চাচির কাছে। মেয়েটি চেপে যাওয়ার চেষ্টা করছে আর চাচি কুটনামি করার একটি উপলক্ষ পেয়ে মনে মনে ফন্দি আটছে। তখন মুন্নীর রহস্যময় নাম্বারের কথা মনে পড়ে। গুনে গুনে চারটি মিসকল দেয়। কিন্তু শেষ কলটি মিস থাকে না মিসেস হয়ে যায়। মঞ্জু ধরে ফেলে। মুন্নী কাটতে গিয়ে দেখে এক সেকেন্ড ব্যয় হয়ে গেছে।
অফিসে অডিট চলছে। কিন্তু কিছু খরচের সঠিক তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। প্রধান হিসাব রক্ষক বিদেশ থাকাকালে এসব খরচ হয়েছে। ফলে হিসাবটা উপ-হিসাব রক্ষকেরই দেয়ার কথা। কিন্তু তিনি ধুনপুন করছেন। এ নিয়ে দুইজনের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে। কিন্তু মধ্যখান থেকে সবচেয়ে জুরিয়র হয়েও মঞ্জু জড়িয়ে পড়েছে। সেদিন সকালে প্রধান হিসাবরক্ষক জামিল সাহেব তাকে উপ-হিসাবরক্ষকের কক্ষে পাঠিয়েছেন। ওইসব কাগজপত্র আনতে। মঞ্জু কথাটি তোলতেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন উপহিসাবরক্ষক রবিন সাহেব। তাকে জামিল সাহেবের দালাল বলে বকাঝকা শুরু করে। জবাব দিতে গেলে সেটা তর্কাতর্কিতে গড়ায়। রবিন সাহেব মঞ্জুকে দেখে নেয়ার হুমকি দেয়।
এমন মনখারাপের সময়ে রহস্যময় নাম্বারটি থেকে উপযুর্পরী মিসকল দিতে থাকলে মঞ্জু খানিকটা বিরক্ত হয়। সব মুহুর্তে সবকিছু আনন্দ দেয় না। সে বিরক্তি নিয়েই রিংটি ধরতে গেছে। কিন্তু এক সেকেন্ডের মাথায় কেটে দিয়েছে ওইপ্রাপ্ত থেকে। রাসে ফোনটি টেবিলের উপর আচড়ে ফেলে ক্যান্টিনে সিগারেট টানতে যায় সে। বহুদিন ধরে এটাই যেন তার টেনশন কমানোর ঔষুধ হয়ে উঠেছে। জোরে কয়েকটি টান দিলেই মাথাটা কেমন ফাকা ফাকা হয়ে যায়। তবে তার আধুনিক (আমরা ধুমপান নিবারণ করি) বন্ধু সাজিদ বলে- আসলে নেশা মানুষের নিউরণকে দূর্বল করে। আর বোকা মানুষ সেটার অনূভূতি নেয়ার চেষ্টা করে। যাকগে...।

সময় তো হাওয়ার মতো। হাল্কা ছোয়া দিয়ে অগোচরে বয়ে যায়। সময়ের হাত ধরে মুন্নীর অগোচরে মিসকলগুলো মিসেস কল থেকে অবশেষে পোয়াতি হয়ে উঠে। সপ্তাহ ব্যবধানে জমে উঠে আলাপ। সকাল-সন্ধ্যা। বেলা-অবেলায়। রাতের আলাপ লতায় পাতায় দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে। পরস্পরের ভেতর-বাহির শিমুল তুলোর মতো ফেটে পড়ে। ফুলে ফেপে বাতাসে ছড়িয়ে যায়।
তবে আলাপের প্রারম্ভকালে কৌতুহল চেপে রাখতে পারে না মঞ্জু। মুন্নীর কাছে জানতে চায়- আপনি আমার নাম্বার পেলেন কোথায়?
কোন নাম্বার পাওয়া কি কঠিন?
সেটা অবশ্যই কঠিন না। তবে আমার মতো তুচ্ছ কেরানীর নাম্বার কোন উচ্ছল তরুনীর মোবাইলে ঢুকে পড়া তো কিছুটা হলেও আশ্চর্যজনক।
ধরুন নাম্বারটি এমনি আমার মোবাইলে ঢুকে পড়েছে।
সেটা কি করে হয়!
এই যে আমাদের মধ্যে যেভাবে আলাপ জমে উঠলো।
তা ঠিক, তবে ...।
আচ্ছা ঠিক আছে- আপনি কি কখনো কোটিপতি হওয়ার স্বপ্ন দেখেছেন?
হ্যাঁ, তবে আকাশ কুসুম।
তাহলে নিশ্চয় কুইজের ব্যাপারে আগ্রহ আছে।
হ্যাঁ কিছুটা তো অবশ্যই।
তাহলে দিলাম চারটি অপশন। বেছে নিন আপনার উত্তর।
কুইজ: ক. ম্যাগাজিন খ. পার্কে ইউকিপটাস গাছ গ. টাকা ঘ. অন্য ভিজিটিং কার্ড বা কোথাও।
মঞ্জু বুঝে উঠতে পারে না। প্রায় নানা রকমারী ম্যাগাজিন সে উল্টে দেখে। কিন্তু কখনো কোন ম্যাগাজিনে তো সে কিছু লেখেনি যে মোবাইল নাম্বার ছাপা হবে। তাহলে অপশন ‘ক’ বাদ। মুন্নী ঢাকার মেয়ে। ফলে সে ঢাকার কোন পার্কে পেতে পারে। কিন্তু পার্কে মাঝে-মধ্যে ঢু মারলেও কখনো গাছে কিছু লেখেনি মঞ্জু। তাহলে অপশন ‘খ’ বাদ। টাকায় তো কোন কিছু লেখার প্রশ্নই আসে না। ফলে অপশন ‘গ’ও বাদ। তাহলে রইল অন্যান্য। কিন্তু অন্যান্যের মধ্যে কি হতে পারে? মঞ্জু এলোপাতাড়ি স্মৃতি হাতড়াতে থাকে। সহসা মনে পড়ে না। মনে সন্দেহ জাগে। তাহলে কি দুষ্টামি করে তার বন্ধু বা পরিচিত জনের মধ্যে কেউ এ অকাজটি করেছে? হঠাৎ মনে পড়ে- টাকা। সে প্রায় আধঘন্টা পর জবাবে দেয়- ‘গ’ ।
গেলোবার ঈদের বাড়ি ফেরার সময় একবাণ্ডিল ব্যাংক পাড়ায় দীর্ঘলাইনে দাঁড়াতে তাকে কিন্তু ঈদের দিন ছোট বাচ্চাদের হাতে নতুন নোট তুলে মধ্যদিয়ে আনন্দ ভাগাভাগি করার আগাম সুখে তার সে লাইনে দাঁড়ানো। চাচা মহিতুলের সঙ্গে। মহিতুল তাকে বুকে জড়িয়ে জিজ্ঞাসা করে- কাকু কেমন আসিস। তবে সবার আসে তোর ফোন নাম্বারটা দে।
না না একটি কার্ড হলেও দে। মঞ্জু পকেট হাতড়ে দেখে মানিব্যাসে তার কার্ড নেই। চান্দরাতে নানাজনকে দিতে দিতে শেষ হয়ে গেছে। পকেট হাতড়ে দেখে কাগজও নেই। তখন সে একটি দশটাকার কড়কড়ে একটি নোটের ওপর মোবাইল নম্বরটি লিখে দেয়। মহিতুল নম্বরের অতিরিক্ত একটি নোট পেয়ে হাসে।
মঞ্জুর মনে পড়ে। কিছুটা বিস্মায়াভূত হয়। তাহলে কি সে টাকাই মানুষের হাত-পকেট ঘুরতে ঘুরতে মুন্নীর কাছে এসে পৌছেছে। হতেও পারে!
রাতে মুন্নীর সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ আলাপ করে মঞ্জু। লোডশেড়িংয়ের কারণে ঘরে ভ্যাপসা গরম। দরোজা খোলা রেখেই বিছানায় গা এলিয়ে দেয় সে। মুুহুর্তেই দু'চোখে রাজ্যের ঘুম নেমে আসে। চোখের পাতা দু'টো মেলে রাখতে পারে না। এমন এক ক্লান্তিঘোরের মধ্যে সে ঘুমিয়ে পড়ে।
সকালের আমেজ না কাটতেই তাজমহল রোডের গন্ধবিলাস বিল্ডিংয়ে কৌতুহলী মানুষের একটি জটলা জমে উঠে। পুলিশ আসে। ক্যামেরা আর বুম হাতে সাংবাদিকরাও আসে। বাড়ির পাঁচতলায় উত্তর পাশের ফ্লাটের একটি ঘরে সাবলেট থাকতেন মঞ্জু নামের একটি ছেলে। একটি কোম্পানীতে সহকারি হিসাবরক্ষকের কাজ করতো। গতরাতেও তাকে যথাসময়ে বাসায় ফিরতে দেখেছে বাড়ির দারোয়ান। কিন্তু ছেলেটি আর নেই। রহস্যজনকভাবে খুন হয়েছে। সকালে রান্না করতে এসে কাজের বুড়িটি দেখে বিছানায় অসাড় পড়ে আসে ছেলেটি। তখন সে হৈ চৈ শুরু করলে বিল্ডিংয়ের ও আশপাশের লোকজন ছুটে এসেছে। কিভাবে খুন হলো, কেন খুন হলো, কারও সঙ্গে ঝগড়া ছিল কিনা- চারদিকে মুহুমুর্হু প্রশ্ন। কিন্তু কোন উত্তর নেই। ধারণা করছে সবাই- চিকন রশি জাতীয় কিছুর মাধ্যমে ফাঁস দিয়ে তাকে হত্যা করা হয়েছে।
ফ্লাটের মালিক থাকেন যশোরে। ব্যবসার প্রয়োজনে মাসে দু’চারবার ঢাকা এলে বাসায় থাকেন। অন্যসময় মঞ্জু একেলাই থাকেন ফ্ল্যাটের একপাশের আলাদা একটি ঘরে। দারোয়ানকে ইতিমধ্যেই কয়েকদফা জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। কিন্তু উল্লেখযোগ্য কোন তথ্য বের করতে পারেনি। ফলে আটক করে থানায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে কাজের বুড়ি মহিলাটিকেও। ফ্ল্যাটের মালিককে খবর দেয়া হয়েছে। বেলা সাড়ে এগারোটার দিকে লাশ মর্গে পাঠিয়ে দেয় পুলিশ।

সকালে কয়েকবার মঞ্জুকে ফোন করেছে মুন্নী। কিন্তু প্রতিবারই একই উত্তর- ‘আপনার ডায়ালকৃত নাম্বারে সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।’ সময় কাটছে না। ডিসলাইনে সমস্যা দেখা দিয়েছে। রাত থেকে টিভিও দেখা যাচ্ছে না। মাঝে-মধ্যে এরকম করে। তাই অনেকদিন পর আজ সকাল থেকেই মায়ের সঙ্গে বাড়ির ছোটখাট কাজে হাত লাগাচ্ছে।
সকাল থেকে আকাশ চমৎকার ফর্সা। বাইরে তেজি রোদ। মুন্নী মনে মনে ঠিক করে বিকালে বেইলী রোডের দিকে আড্ডা দিতে যাবে। কিন্তু হঠাৎ একটি দখিন হাওয়া সেটাও মাটি করে দেয়। হাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নামে বৃষ্টি। দুপুর থেকেই অঝোর ধারায় সৃষ্টি ঝরছে। আকাশের মন খারাপ? নাকি মেঘগুলো প্রসব বেদনায় ঝরে ঝরে পড়ছে! আষাঢ়ে বৃষ্টি বড্ড একঘেয়ে। একবার নামে তো থামতে চায় না। এমন বৃষ্টিতে বাইরে বেরুনে কঠিন। বৃষ্টিতে ভেজা নিশ্চিত। গলির মধ্যে হাঁটুপানি, রাস্তাঘাট জলে টইটম্বুর। কিন্তু বাসায় বসে থাকতেও ভালো লাসে না। মনে বসে না। মুন্নী বান্ধবীদের সঙ্গে প্রায় ঘুরে বেরুয়। মার্কেটে মার্কেটে ঘুরে বেড়ায়। কোথায় কোন ডিজাইনের পোষাক এসেছে, কোথায় কোন গহনা ইত্যাদিতে তাদের কৌতুহল। তারা এটা ওঠা দেখে দরদাম করে। কিন্তু কিনে না তেমন কিছুই। টুকটাক কালে ভদ্রে। দোকানীর হাকানো দামের এক পঞ্চমাংশ দাম করে বিক্রেতাকে নিরুৎসাহিত করে। ঝাঁক বাধা মেয়ে তরুনীদের ঘাটাতে যায় না বিক্রেতারা। তবে দোকানের কর্মচারীরা সুযোগ পেলেই মশকরা করে কথা বলে। যতসব ছোকরার দল।
বিকালের দিকে বৃষ্টিটা একটু থেমেছে। ভেজা কাকগুলো ইলেকট্রিকের তারে বসে ডানা ঝাপটে শরীর শুকিয়ে নিচ্ছিল। ঠিক তখনই মুন্নীর মোবাইলে একটি রিং আসে। রিং ধরে মোবাইল কানে তুলতেই একটি মহিলার কণ্ঠ ভেসে আসে। মিলা কেমন আছো? মুন্নী বুঝতে পারে রং নাম্বার। কিন্তু মহিলা কণ্ঠে যেন স্নেহ ঝরে পড়ে। তাই সে উত্তর দেয়- জ্বি আমি শিলা নই। ওই প্রাপ্ত থেকে আরও দরদী কণ্ঠের জিজ্ঞাসা- কে শানু? মুন্নী হেসে বলে- নানা আমি শিলা-শানু নই, মুন্নী। ওই প্রান্তে থেকে মহিলা এক নিঃশ্বাসে বললেন- কিন্তু এ নাম্বারতো আমার ভাগ্নি শিলার, মগবাজারে বাসা। এবার খানিকটা বিরক্ত হয়েই মুন্নী বলে- দেখুন আমি আপনার ভাগ্নি না। তবে আমাদের বাসায়ও মগবাজারে। ওই প্রান্ত থেকে মহিলার কণ্ঠে হতাশার সুর ভেসে আসে- স্যরি, কিন্তু আপনাদের বাসাটা কোথায় বলবেন? মুন্নী বিরক্তির সুরেই বলে- ডাক্তার গলি, অট্টভিলা। সরি‌্য, বলেই লাইনটি কেটে দিলেন ওই প্রান্তের মহিলা।

ফোনটি রেখে দম নিতে পারেনি মুন্নী। বড়জোর কয়েক মিনিট। হঠাৎ দরোজায় টোকা পড়লো। সে দৌড়ে দিয়ে আইহোলে চোখ রেখে দেখে বাইরে কয়েকজন যোয়ান নারী-পুরুষ। অনেকটা কৌতুহলী হয়েই মুন্নী দরোজা খুলে। কিন্তু তার সে কৌতুহল স্থায়ীত্ব পায় না। প্রথমেই কড়া প্রশ্নÑ মুন্নী কে?
অবাক হয়েই সে প্রশ্ন-উত্তরে একাকার করে ফেলেÑ কেন আমি। কি ব্যাপার? আপনারা কারা?
আমরা বিশেষ বাহিনীর লোক। আপনি দ্রুত ব্যবহারের কিছু পোষাক নিয়ে আমাদের সঙ্গে চলুন।
মুন্নী হতবিহ্বল হয়ে প্রশ্ন করে- কোথায়?
ইতিমধ্যে তার মা রোশরানা বিবিও মেয়ের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। তিনি আগন্তুক শক্ত পেশীর নারী-পুরুষগুলোর কাছে জানতে চায়Ñ আমার মেয়ে কোথায় যাবে?
তাদের সংক্ষিপ্ত উত্তর- থানায়।
এবার মা-মেয়ে কিছুটা ভেঙে পড়ে প্রশ্ন করে- কেন?
কোন উত্তর না দিয়েই আগন্তুক এক মহিলা মুন্নীকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন ছুড়েÑ মঞ্জুকে চেনেন?
মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে, ঢোক গিলে বলে- চিনি।
পাল্টা প্রশ্নÑ কাল রাতে তার সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা হয়েছে না?
মুন্নী আবার মায়ের মুখের দিকে তাকায়। দেখে মায়ের মুখে বিস্ময়। কিন্তু তার মুখ দিয়ে মিথ্যা আসে না। মুন্নী জবাব দেয়Ñ হ্যাঁ।
এবার আগন্তুক পুুরুষদের একজন বলে- কাল রাতে সে খুন হয়েছে।
কথাটি শেষ না হতেই মা-মেয়ে আর্তনাদ করে উঠেÑ খুন!

kafi_bd80@yahoo.com


No comments:

Post a Comment