উল্টোযাত্রা
কাফি কামাল
....................
কাফ্রির মতো ঘন কালো রাত্রীর হৃদয় ধরে দিলবেজার বানু বিড়াল পায়ে হেঁটে চলছেন। গন্তব্য তার পদুয়ার হাতির দীঘি। বাপের বাড়ি, ঠাণ্ডা মৌলভির ঘর। মেঠোপথের দুইপাশে কালো কালো স্তুপের মত ঝোপঝাড়। নানা রকম পোকা মাকড়ের বিদঘুটে আওয়াজ একটি ভৌতিক আবহের সৃষ্টি করছে। মুখে তার আল্লাহ-রসুলের পাক কালাম আর কাঁধে বিয়াল্লিশ সেরের যমদূত; বেটে মৌলভি। পরণে জোলার শাড়ি, চরণে রেঙ্গুনের চপ্পল।
সুখছড়ির বেটে মৌলভির বাড়ি থেকে হাতির দীঘির ঠাণ্ডা মৌলভির বাড়ির দূরত্ব পাক্কা সাড়ে তিনমাইল। দূরত্বের একপ্রান্তে বটবৃক্ষের স্নিগ্ধ আশ্রয় অন্যপ্রান্তে গরম তাওয়ার উষ্ণতা। মধ্যখানে বয়ে গেছে খরস্রোতা টংকাবতী নদী।
সাদী মোবারকের একযুগ ধরে প্রতিটি ক্ষণ দিল বেজার বানু তা হাড়ে হাড়ে অনুভব করেছে। বারবার মনে পড়ে সুখছড়ির বেটে মৌলভিকে কবুল বলার সে চুপচাপ জবরদস্তির কথাটি। শ্বশুরবাড়ির প্রথমদিন থেকে গরম তাওয়ায় ভাজা লালমরিচের মত পুড়ে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছেন। কিন্তু নিয়তির পরশ পাথরের অপেক্ষায় কেটে গেছে দীর্ঘসময়। এরই মধ্যে তার নাড়িছেঁড়া ধন মোহাম্মদ শাকুরের বয়স এগারো পূর্ণ হয়ে বারোতে পড়েছে। বিয়ের ১১মাসের মাথায় দিল বেজারের কোল আলো করে এসেছিল শাকুর।
বিয়ের পর মেয়েরা পায় একজন মাতৃতুল্য শাশুড়ি। কিন্তু দিল বেজারের কপালে আল্লাহপাক লিখে দিয়েছেন একটি কুটনি বুড়ি। সে কুটনি বুড়ির ঘেরোবন্দী হন ঠাণ্ডা মৌলভির শান্ত স্বভাবের মেয়েটি। কথায় কথায় ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, অবহেলা। শাশুড়ির তাচ্ছিল্য দিয়েই শুরু হয় তার সংসার জীবন। গভীর রাতে ওয়াজ মাহফিল থেকে বাড়ি ফিরেন বেটে মৌলভি। ফেরা মানেই কুটনি বুড়ির হঠাৎ নাকিকান্নার সুর ওঠা, মায়ের কান্নায় মৌলভির তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠা। তারপর চারফুট উচ্চতার মাওলানা আবদুস সালাম ওরফে বেটে মৌলভির বিচারসভা। ছেঁড়া জুতা জোড়া থেকে পুরোনো ঝাড়–র উপুর্যুপরী আঘাত। অবশেষে দিল বেজারের রক্তাক্ত দেহ, বিছানায় ছটফট করার দৃশ্য। যদিও দিল বেজারের আব্বাজান নেয়ামত উল্লাহ ওরফে ঠাণ্ডা মৌলভির বিবেচনায় এটা একটি শয়তান বিতাড়ন প্রক্রিয়া। তিনি দিলকে বারবার সান্তনা দেন, স্ত্রীর শরীরে যেখানে স্বামীর আঘাত লেগেছে সেখানে দোযকের আগুন স্পর্শ করবে না। সত্যিই কি তাই! তাহলে তো দোজকের আগুনে দিল বেজারের খুব একটা কষ্ট হবে না। এতটুকু মেনে নিলেও শেষ রাতে বিক্ষত শরীর নিয়ে বেটে মৌলভির একতরফা নির্যাতনে সে সত্যিই বেদনাহত হয়েছে। ফুলে ওঠা স্থানে দোযকের আগুন স্পর্শ না করার একটি বিশ্বাসগত সম্ভাবনা থাকলেও মৌলভির স্পর্শ নির্যাতন থেকে রেহাই মিলেনি।
বাবা-মা’র আদরের মেয়ে দিল খোশ বানু এক সময় হয়ে ওঠেছে বেটে মৌলভির দিল বেজার। এখন সে সত্যিকারেরই দিল বেজার। বিয়ের দীর্ঘ এক সময়েও কখনো বিজলীর মত দুই একটি মুহুর্ত ছাড়া দিল তার বেজারই থেকেছে। খোশ হয়ে ওঠতে পারেনি। তার বেদনার্ত গুমড়া মুখের দিকে তাকিয়ে এক ভোর বেলা তাকে এ অপবাদই দিয়েছে বেটে মৌলভি। সে থেকেই দিল খোশ বানু হয়ে ওঠেছেন দিল বেজার ওরফে দিল বেজু।
খ.
অগ্রহায়নের শেষ সপ্তাহেই ঝেকে বসেছে পৌষের শীত। কৃষকের ধান কাটা প্রায় শেষ। নতুন ধানের ধেনো গন্ধে মৌ মৌ করছে চারদিক। চাষা ভুষো গ্রামীণ মানুষ আল্লাহর শোকর জানাতে পাড়ায় পাড়ায় ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করছে। পাড়ায় পাড়ায় মসজিদ মাদ্রাসায়গুলোর কোষাগার ফুলে ফেপে স্ফিত হচ্ছে। নাখোদা’রা বলে, অগ্রহায়ন হচ্ছে মসজিদ মাদ্রাসার কোষাগার স্ফীতির মওসুম। মৌলভির ওয়াজে ধর্মীয় গল্প বলার ফাঁকে-ফোঁকরে দরাজ গলায় লোকজনের কাছে চাদা তুলছে। মারহাবা মারহাবা শব্দে বাড়ছে চাঁদার পরিমান আর মহিমা। কেউ নতুন ধান বিক্রির কড়কড়ে নোট, কেউ বা আড়ি আড়ি ধান চাউল দান করছে। মৃত বাবা-মা আত্মার শান্তি কামনা, সংসারের সুখ সমৃদ্ধি ও দোজাহানের নেকি অর্জনে সবাই এখন কম বেশি উদার হস্ত। এলাকার উঠতি পয়সাওয়ালারা তো রীতিমতো প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠেন। এ সময় ঘন ঘন ওয়াজের দাওয়াত আসে মৌলভির। দিনে দু’তিনটিও থাকে। নজরানাও কম নয়। এক একটি ওয়াজের জন্য তাকে দিতে হয় হাজার টাকা। ভাল মানের খাবার দাবার তো আছেই। কেউ কেউ যাতায়াতের জন্য রিক্সার ও ব্যবস্থা করেন। তিন চার ক্রোশ দূর থেকে বেটে মৌলভির ওয়াজের দাওয়াত আসে। এ সময় কাপড়-চোপড়ে একটু যতœবান হতে হয়। তাই ইস্ত্রির ভাজ দেয়া পাঞ্জাবী ছাড়া ওয়াজ মাহফিলে যান না বেটে মৌলভি। সেদিন সুখছড়ি ওয়াজ মাহফিলে গিয়ে খাবার সময় আর্দি কাপড়ের পাঞ্জাবীতে গরুর গোশতের ঝোল পড়ে দাগ হয়ে যায়। তাই দাগ উঠাতে সেটি বাজারের লণ্ড্রিতে দেয় মৌলভি। আরেকটি পাঞ্জাবী আধোয়া। সেদিন সকালে মাদ্রাসায় যাওয়ার সময় মৌলভি দিল বেজারকে কড়া নির্দেশ দেয়। দিল বেজু- আমার কোর্তাটা ধুয়ে রাখবা। বিকালে ওয়াজে যেতে হবে। সেখান থেকে রাতে আরেকটি দাওয়াত আছে। কিন্তু সারাদিন বাড়ির কাজে দিল বেজু কোর্তা ধোয়ার কথা ভুলে যায়। দুপুরে মাদ্রাসা থেকে বাড়ি ফিরে মৌলভি দেখে যেখানের কাপড় সেখানেই আছে, ধোয়া হয়নি। দেখেই মাথায় রক্ত ওঠে যায় তার। মুখ দিয়ে গালির ফোয়ারা ছুটে- ওই খানকি মাগির ঝি, কি বলে গিয়েছিলাম মনে নেই।
দিল বেজু হন্তদন্ত হয়ে রান্নাঘর থেকে ছুটে আসে। কি হয়েছে?
তোর মাকে .....।
এভাবে কুত্তা বিলাইয়ের মত গালি দিচ্ছেন কেন।
জানিস না- তোরে যে ওয়াজের সুরে কোর্তা ধুইতে বলেছিলাম।
ততক্ষণে শুরু হয়ে যায় চুল ধরে মারপিট। দিল বেজু সহ্য করতে পারে না। সে ভুল করেছে সত্য তবে ঘরে তো আর বসে ছিল না। বাড়িতে মেহমান এসেছে। তাদের জন্য রান্নার পাশাপাশি বাড়ির ভেতর ধান চালের মওসুমী কাজ তো আছেই।
মুখের গালি আর হাতের ঢালি খেয়ে, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে দিল বেজার বানু। দুপুরে বেতের বাড়ি হজম করতে করতে সে বলেই ফেলে- আমি আর আপনার ঘর করবো না। আপনার ঘরে থাকবো না।
কোন নাগরের কাছে যাবি? বেটে মৌলভির শ্লেষ।
অত আর আল্লাদ নেই।
তাহলে কোথায় যাবি- হারামজাদি।
মুখ সামলে কথা বলেন। আব্বাজানের গজব পড়বে।
খানকি তুই তালিম দিস না। বেটে মৌলভি আরেক ঘা লাটির আঘাত করে।
কোথায় কোন বারাম খানায় যেতে চাস বল।
বাপের বাড়িই যাব। আপনারে ঘুমে রেখেই যাব। নিবুর্দ্ধিতা করে নিজের গোপন পরিকল্পনাটি ফাঁস করে দেয়- দিল। তবে চালাক বেটে মৌলভি সতর্ক হয়ে পড়ে। লোকে তো এমনি বলে না- ‘বেটে হচ্ছে শয়তানের লাঠি।’ দেহে যারা বেটে বুদ্ধিতে সে তারা দীর্ঘ। ফলে মৌলভি বুঝে নেয়- এবার একটা অঘটন ঘটবে। খাঁচার পাখির মুখে বোল ফুটেছে। এবার উড়াল দিতে চাইবে। কয়েকদিন আগের কথাগুলো এবার ভাবতে থাকে মৌলভি।
সবকিছুতেই শাকুরের কৌতূহল। সবকিছুই যেন তাকে বুঝতে হবে, জানতে হবে। কিছুদিন আগে জেটাতো ভাইয়ের সাইকেল নিয়ে সে হঠাৎ উধাও হয়ে যায়। সে যে সাইকেল চালাতে পারে সেটাই বাড়ির কেউ জানতো না। সাইকেল খুঁজে না পেয়ে শাকুরের জেটাতো ভাই গফুর যখন গালাগালি করতে করতে খুঁজছে তখনই খবরটি পাওয়া গেল। উত্তরপাড়ার করিম সরকার জানালো, তিনি নিজের চোখে দেখেছেন। শাকুর কাত হয়ে হয়ে সাইকেলের প্যাডেল মেরে উত্তরদিকে চলে গেছে। করিমের কথা শুনে সবাই অবাক। শাকুর সাইকেল চালাতে শিখলো কখন? কেউতো শাকুরকে চালানো শেখায়নি। সবার মুখে জিজ্ঞাসা? সে প্যাডলের নাগাল পায়তো?
এরই মধ্যে করিম অদৃশ্য সাইকেল চোরের জ্ঞাতিগোষ্ঠী তুলে গালাগালি করেছে। এখন খবর পাওয়ার পর সে লজ্জিত মুখে উত্তরদিকে হাঁটা দিল। করিম সরকারের কথায় দিল বেজার বানুর মনটা দ্বিখণ্ডিত হয়ে পড়েছে। একমনে ছেলের সাইকেল চালনা শেখার কৃতিত্বে আনন্দিত অন্যমনে গফুরের গালাগালিতে ছেলের প্রতি ক্ষোভ দানা বাঁধছে। গফুরের গালিগুলো তার অন্তরে এসে বিধঁছে। যদি ছেলের একটি সাইকেল থাকতো তাহলে নিশ্চয়ই তাকে এভাবে গালি শুনতে হতো না। নানা কাজে এদিক ওদিক পাঠানোও যেতো।
খানিকক্ষণ পর শাকুরকে পাওয়া গেলো কাজির বিলে। সাইকেলে শরীর বাকিয়ে প্যাডল মারছে আর কখনো হাত ছেড়ে দিচ্ছে কখনো পা প্যাডল থেকে তুলে নিচ্ছে। গফুর তাকে ডাক দেয়- এ্যাই শাকুর। গফুরকে দেখেই অবশ্যই শাকুর সাইকেল দাঁড় করিয়ে কাঁপতে থাকে। তবে গফুর তাকে কটু কিছু বলে না। শুধু মিষ্টি হেসে বলে- এ্যাই বজ্জাত বলে আনতে পারতি না। শাকুর লজ্জা ও ভয়ে নিশ্চুপ। এতক্ষণ পর বুঝতে পারছে সে খুব একটা অপরাধ করে ফেলেছে।
রাতে বাড়ি ফিরেই আগুন চোখে বেটে মৌলভি ছেলেকে ঘুম থেকে তুলে। কোন কৈয়ফিত জানতে না চেয়েই চড়-থাপ্পড়ে শাকুরের গাল লাল করে ফেলে। ঠোঁট ফেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোয়। সহ্য করতে না পেরে দিল বেজার বানু ঠেকাতে যায়।
কি করছেন আপনি। ছোট্ট অপরাধে এমনভাবে পেঠাতে হয়।
মুখে কোন কথা নয়, সঙ্গে সঙ্গে শাকুরকে ছেড়ে দিল বেজারকে পেঠাতে শুরু করে মৌলভি।
টানা তিনদিন জ্বরে ভোগার পর বিছানা ছাড়ে শাকুর। ছেলের ফ্যাকাসে মুখ দেখে মায়ের মন মানে না। দিল বেজারের চোখ দিয়ে শ্রাবণের বারি ঝরেছে এইতিনদিন।
ছেলে সুস্থ হওয়ার পর একদিনে দিল বেজার স্বামীর কাছে একটি আবদার করে বলে- একটি কথা বলব, রাখবেন?
কি কথা- মৌলভির কণ্ঠে কোমলতা।
ভরসা পেয়ে দিল বেজার আর্জিটা পেশ করে- আমাদের শাকুরকে একটি সাইকেল কিনে দেন না।
শুনে মুহূর্তের মধ্যেই রেগে আগুন হয়ে ওঠে মৌলভি। তার মুখ দিয়ে বেরুতে থাকে, রাগের লাভা। তপ্ত এবং হন্তারক। খানকি, বৈতাল- ছেলেকে গাণ্ডু বানাতে ছাস। আবার বলবি তো, চুলের ঝুঁটি ধরে হাতিরদীঘি পাঠাব।
দিল বেজার স্বামীর মেজাজের আকস্মিকতায় খানিকটা ভড়কে যায়। পরক্ষণে তার মনটা খুবই খারাপ হয়ে যায়। প্রায়ই সে এটা-ওটা আবদার করে না। বাড়ির প্রয়োজনীয় জিনিষের বাইরে কবে কি আবদার করেছিল তার মনেই পড়ে না। তাই এক পর্যায়ে তার জেদ হয়। যাই হোক, যেভাবেই হোক ছেলেকে সাইকেল সে কিনে দেবেই।
কয়েকদিন পর জীবনে প্রথমবারের মতো চুরি করে দিল বেজার। পাড়ার সোলায়মানকে দিয়ে গোলা থেকে ধান নামিয়ে গোপনে বিক্রি করে। সোলায়মান তিনটি পাঁচশ টাকার নোট তার হাতে গুঁজে দেয়। বাড়ির খরচ থেকে বাঁচিয়েও সে বাড়ির বাঁশের খোড়লে কিছু টাকা জমিয়েছিল। খোড়ল কেটে নানা অংকের নতুন-পুরোনো নোট মিলিয়ে দেখে আটশ ঊননব্বই টাকা জমেছে। সে এরই মধ্যে খবর নিয়ে দেখেছে একটি মাঝারি উচ্চতার সাইকেল কিনতে দুইহাজার টাকা লাগে। এই কয়দিন স্বামীর কাছে যতই অপমানিত হোক না কেন তার চোখে ভেসেছে একটি দৃশ্য। শাকুর সাইকেল চালিয়ে মাদ্রাসায় যাচ্ছে আর বাতাসে ওড়ছে তার পাঞ্জাবীর খুট।
পরদিন ভাসুরপুত গফুরকে আমিরাবাদ পাঠিয়ে একটি সাইকেল নিয়ে আসে। লাল রঙের ফনিক্স সাইকেল। সাইকেল পেয়ে শাকুরের আনন্দ যেন আর ধরে না। সাইকেল নিয়ে সে উঠোন পেরিয়ে রাস্তার দিকে চলে যায়। সেটা দেখে দিল বেজারের মন বহুদিন পর খোশ হয়। নিজের আসল নামের কথা তার মনে পড়ে। মুহূর্তের তার মুখ দিয়ে ফিক করে হাসির শব্দ বেরুয়।
সকালে ঘরের দাওয়ায় নতুন সাইকেল দেখে অবাক হয় মৌলভি। খর্বত্বের কারণে নিজের সাইকেল চালানো শেখা হয়ে ওঠেনি। তার ছেলে সাইকেল চালাবে তার সামনে দিয়ে! মৌলভি কল্পনাই করতে পারছে না।
দিল বেজারকে হাঁক দেয়- এই দিল বেজু, এদিকে আয়।
দিল সামনে আসতেই সাইকেল দেখিয়ে মৌলভির প্রশ্ন- এটি কার?
মুখে হাসি ফুটিয়ে দিল বেজার বলে- শাকুরের জন্য কিনে আনিয়েছি।
কে কিনে দিয়েছে?
জ্বি, আমি কিনে আনিয়েছি, গফুরকে দিয়ে।
বৈতাল তুই, টাকা কোথায় পেলি? মৌলভির মেজাজ চড়তে শুরু করেছে।
হাতে কিছু টাকা ছিল আর...
আর কি?
কয়েক আড়ি ধান বিক্রি করেছি।
দিল বেজুর কথা শেষ হওয়ার আগেই ‘ছেলেকে গাণ্ডু বানানোর পায়তারা করছিস’ এই স্বগোক্তির করতে করতে মৌলভির হাত-পায়ের ব্যবহার শুরু হয়ে যায়। সেই সঙ্গে যা তোকে আমি ‘এক তালাক’ দিলাম বলে মৌলভি এ সংক্রান্ত তিনটি শক্তির একটি ব্যয় করে ফেলেন। এখনও তার হাতে দুইটি শক্তি, দিল বেজুর সামনেও দুইটি রক্ষা কবচ। শব্দটি আর মাত্র দুইবার উচ্চারণ করলেই মৌলভি হারাবেন তার ক্ষমতা আর দিল হারাবেন তার স্ত্রী পরিচয়। তবে দ্রুত সামলে নেন মৌলভি। দুপুরেই তিনি সাইকেলটি দুইশ টাকা বাট্টা দিয়ে ফেরত দিয়ে আসেন। সারাদিনের পিটুনী আর গালাগালির চেয়ে এ বিষয়টিই বেশী কষ্ট দেয় দিলকে। সংসারের পাক্কা একযুগের ভিত যেন দ্রুতই ক্ষয়ে যেতে থাকে।
দিল বেজারের মন আবারও দ্বিখণ্ডিত হয়। একদিকে সংস্কার অন্যদিকে স্বাধীনতা। স্বামীর বাড়ি ছেড়ে বাপের বাড়ি গেলে লোকে মন্দ বলবে। সবচেয়ে বড় কথা বাবা কষ্ট পাবেন। মৃত্যুপর পর আল্লাহর শাস্তি নিয়েও সে দ্বিধান্বিত। কি জবাব দেবেন আল্লাহকে। মৌলভি তো শুধু নির্যাতনই করে না। মাঝে মধ্যে আদরের আতিশয্যও দেখায়। কথাটি ভাবতে ভাবতেই তার চোখে ভেসে ওঠে বহু স্মৃতি।
ওয়াজ মাহফিল থেকে ফেরার সময় বহুদিন বহু জিনিষ নিয়ে এসেছে তার জন্য। কখনো কমলা-আপেল, কখনো বা পোটলা বেঁধে তরকারি। আবার সেসব তিনি দিল বেজারকে খাইয়ে দিয়েছেন নিজ হাতে। খুব মজা করে, আদর করে। স্বামী হিসাবে মৌলভি একরোখা। বিয়ের পর থেকে কেবল অপবিত্রের মওসুম ছাড়া দিলকে কখনো নিস্তার দেননি মৌলভি। বহুবার রাতে মৌলভির অতি আদরে সৃষ্ঠ মুখের দাগগুলো ঢাকতে দিল বেজুকে মুখে শাড়ির আচল পেচিয়ে বাড়ির কাজকর্ম করতে হয়েছে। এ রকম দিনগুলোতে প্রতিবেশী ননদ-ভাবীরা আড়ালে আবড়ালে হেসেছে। তখন মুখে লজ্জা থাকলেও আনন্দ গৌরবে তার বুক ভরে গেছে।
তবে সবসময়ই মৌলভির আদরের অত্যাচারে মন ভরে না দিল বেজুর। অভ্যাসে পরিণত হলেও ভেতর থেকে সাড়া জাগে না। খারাপ লাগে যখন দিল বেজুর কোন ভাললাগা, খারাপলাগা কিংবা মতামতের তোয়াক্কাই করে না মৌলভি। দিনের পর দিন সহ্য করলেও সাইকেল কাণ্ডটি দিলের দিল ভেঙে দেয়।
বিয়ের পর থেকে এভাবেই দিল বেজার নতুন করে আবিস্কার করতে থাকে বেটে মৌলভিকে। মানুষের সামনে লোকটি খুবই আমলদার আলেম। কিন্তু নিজস্ব পারিবারিক জগতে প্রায় বিপরীত। রেগে গেলে তার মুখে গালি ফুটতে থাকে ওয়াজের মতোই। দিল বেজারের মা-বাপ কেউই বাদ পড়ে না সে বিষ বর্ষণ থেকে। তখন দিল বেজার মৌলভির সঙ্গে পাড়ার অন্য চাষাভুষোর থেকে কোন পার্থক্য দেখতে পান না। বিয়ের ছয় মাসের মাথায় প্রথম গায়ে হাত তুলেছিল বেটে মৌলভি। ওজুর পানি দিতে দেরি করায় দিল বেজারের পিটে কষে একটা কিল মেরেছিল।
একদিন এক অদ্ভুত কাণ্ড করেছিলেন বেটে মৌলভি। উত্তেজিত হয়ে একটি কাঠের টুল নিয়ে এসেছিল। তারপর সে টুলে দাঁড়িয়ে টাশ-টাশ কয়েক ঘা চড় বসিয়ে দিয়েছিল দিলকে। এ ধরনের শাস্তিতে একধরনের মজা পেয়ে গিয়েছিল মৌলভি। ঘনঘন টুলের উপর দাঁড়িয়ে মুখে চড়-থাপ্পড় মারা রেওয়াজে পরিণত করে ফেলেছিল। আরেকদিন আরও অদ্ভুত একটি কাণ্ড করেছিলেন তিনি। দিল বেজারের স্তন দু’টি আঁকড়ে ধরে ঝুলে পড়েছিল মৌলভি। ব্যথায় ককিয়ে ওঠে মাটিতে গড়িয়ে পড়েছিল দিল বেজার। চোখে মুখে অন্ধকার নেমে এসেছিল। দিলের অবস্থা দেখে মুহুর্তের মধ্যে পাল্টে গিয়েছিল মৌলভি। তরা করে মাটির কলসি থেকে জল এনে তার চোখে মুখে ছিটিয়ে দিয়েছিল।
তবে বেশীর ভাগ সময় মৌলভির নির্যাতন নেমে এসেছে দিলের দীঘল চুল বেয়ে। রাগান্বিত অবস্থায় দিল বেজারের চুলের নাগাল পেরে তো কোন কথাই নেই। সোজা চুলের তোড়া পেচিয়ে ধরে শরীরটা ঝুকিয়ে নিয়ে ইচ্ছেমত চড় থাপ্পড় কিল ঘুষি বুৃষ্টির মত শুরু হয়। তখন ধর্মভীরু বেচারি দিলের কান্না ছাড়া কিছুই করার থাকে না। তাও আবার উচ্চস্বরে নয়, মৃদুস্বরে-নিরবে। কারণ একবার উচ্চস্বরে কান্না করতে গিয়ে তাকে তালাকের হুমকি দিয়েছিল মৌলভি। বলেছিল, পরপুরুষে পরনারীর কণ্ঠ শুনলে দোজকে জলতে হবে। আর তালাকের ভয় তো গ্রামীন ধর্মভীরু নারীর বিরুদ্ধে কার্যকর অস্ত্র। আর বেটে মৌলভি এসব অ™ভুত কাজ করতেন তার খর্বত্বের কারণে। স্বাভাবিকভাবে সে দিলের মুখমণ্ডলের নাগাল পেতো না। অবশ্য মানসিকভাবেও মৌলভি কখনো স্ত্রীর মনের নাগালটি পায়নি।
গ.
দুপুর থেকেই মনে মনে প্রস্তুতি নেয় দিল। রাত যখন বাড়বে, মৌলভি ওয়াজ মাহফিলে যাবে তখনই কলিজার টুকরো শাকুরকে নিয়ে বাপের বাড়ি রওনা দেবে সে। রাতের আধারে, আব্রু ঢেকে। দিল চিন্তা করে দেখেছে- ঠাণ্ডা মৌলভির সম্মান পুরো তল্লাটে। তার মেয়ে স্বামীর অবাধ্য হওয়ায় অজুহাতে তালাক পেলে সে সম্মান ধুলোয় লুটোবে। স্বামীর ইজ্জাতটাও কি কম? হাজার হোক কলেমা পড়া স্বামীতো। দুনিয়ার না পাওয়া যায় আখেরাতে তো ফল পাওয়া যাবে।
দুপুরে শাকুরকে ডেকে পুকুর ঘাটে নিয়ে যায় দিল। বাড়ির মধ্যে বললে আবার ফাঁস হয়ে যেতে পারে। এমনিতেই শাশুড়ি হল কুটনি বুড়ি। আশপাশের লোকজনরে বিশ্বাস করা যায় না। পুকুর ঘাটে গিয়ে ছেলেকে বলে- শাকুর বাপ আমার, তোর বাপের নির্যাতন আর সহ্য হয় না। চল আজ রাতে পালাই। তোর নানা বাড়িতে চলে যাই। তোর বাপ সবাইরে ওয়াজ নসিহত করে এবার তাকে একটা এলেম দিতে হবে।
অনেকটা বোকার মতই চুপচাপ ঘাড় নেড়ে মায়ের কথায় সায় দেয় শাকুর। বাবাকে প্রচণ্ড ভয় পায় ছেলেটি। আবার মায়ের জন্যও দুঃখ লাগে। মনে মনে ভাবে- বড় হলে বাপরে শায়েস্তা করতে হবে। কিন্তু মায়ের প্রস্তাবে সে এক ধরনের দ্বন্দ্বে পড়ে যায়। জগতে সবার উপরে মায়ের সম্মান। আল্লাহর রাসুল নাকি সে স্বীকৃতি দিয়েছেন। যদিও বাবার মুখেই তার এসব কথা শোনা। যাহোক, দিল ছেলেকে রাজী করাতে পারে।
সে প্রশ্ন করে- কিন্তু কিভাবে যাবেন আম্মা।
কেন হেঁটে, রাতের আঁধারে।
আব্বাজান তো জেনে যাবে। তখন তো কেরাপ বেতের বাড়ি একটিও মাটিতে পড়বে না।
দিল তাকে অভয় দেয়। আজ রাতে নতুন জামা পরেই শুয়ে থাকবি। রাতে যখন তোকে শরীর ঝাকিয়ে ইশারা করব তখন চুপচাপ আমার সঙ্গে বেরিয়ে পড়বি।
মায়ের পরিকল্পনা অনুযায়ী ছেলে সন্ধ্যা রাতেই ঘুমিয়ে পড়ে। পরনে তার নতুন জামা।
ঘরের ভেতর পাশাপাশি কক্ষ। আগে শাকুরকে একই বিছানায় রাখতেন মৌলভি। আটবছর বয়সের পর থেকে তাকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে পাশের কক্ষে। তবে দুই কক্ষের মধ্যখানের দরজা সবসময় খোলাই থাকে। মৌলভি মাঝেমধ্যে ছেলের পাশেই শোয়। বিশেষ করে দিলবেজারের ঋতুর মওসুমে।
জামাই বিকালে ওয়াজে যাওয়ার পর থেকে দিল বেজার বানু অপেক্ষার প্রহর গুনছে। সন্ধ্যারাতে শাশুড়িকে খাইয়ে দাইয়ে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছে দিল। যেচে শ্বাশুড়ির মাথার চুল টেনে দিচ্ছে, পা টিপে দিচ্ছে আর বেদনানাশক তেল মালিশ করে দিচ্ছে। মনে মনে কামনা করছে- বুড়ির চোখ দু’টি বুঝে আসুক। শীতের রাত। অনেক দীর্ঘ। মৌলভির ঘুম কাতুরে চোখকে ফাঁকি দেয়ার এটাই উপযুক্ত সময়। ওয়াজ মাহফিল থেকে ফিরতে ফিরতে কুয়াশায় আবছা অন্ধকারে লোকজনের চোখকে ফাঁকি দিয়ে বিলপাতারি হেঁটে পদুয়া বাপের বাড়ি যাবার। রাত আরেকটু গভীর হলেই বেরিয়ে পড়তে চায় সে। বেটে মৌলভি বাড়ি ফিরতে ফিরতে পৌছাতে চায় বাপের বাড়ি। লোকজনের চলাফেরা থাকতে সে যেতে পারবে না। কারণ পথে তাকে কেউ চিনে ফেললে নানারকম বিপদ। একে মৌলভির কন্যা তার ওপর মৌলভির স্ত্রী। লোকজনের সামনে দিয়ে একাকি গভীর রাতে চলাফেরা বড় অশোভন হবে। লোকজন শেখায়েত করবে।
কিন্তু বুড়ির আর চোখ বুঝে না। মাঝে মাঝে চোখ বুঝে এলেই ধড়পড়িয়ে ওঠে বুড়ি। তার কাছে কি যেন লুকোতে চায়। হঠাৎ চা খেতে চায়। অথচ বুড়ি সচরাচর চা খায় না। পিঠে গরম পানির ছ্যাকা দিতে বলে। বুড়ির হলো কি আজকে। তাহলে কি তার পরিকল্পনা জেনে গেছে বুড়ি? দিল বেজারের দিলে নানারকম দোলাচল।
ঘ.
স্ত্রীর পরিকল্পনা জানার পর ওয়াজ মাহফিলে মন বসে না বেটে মৌলভির। ওয়াজে নামাজের ‘একমন তত্ত্ব’ বয়ান করতে গিয়ে তার মনই দুইভাগে ভাগ হয়ে পড়ে। একমন ওয়াজে মনোযোগ দেয় আরেকমন বাড়িতে স্ত্রীর গতিবিধি আন্দাজ করে। রাতে ওয়াজ মাহফিল থেকে আগে বাগেই বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নেয়। অবশ্যই ওয়াজে বের হবার আগে বুড়ি মাকে সতর্ক করে এসেছে। বলেছে- দিলকে চোখে চোখে রাখতে। তারপরও মন মানে না। তাই তড়িঘড়ি ওয়াজ শেষ করে বাড়ি পথ ধরেন মৌলভি।
রাত দ্বিপ্রহরে হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ফিরেন তিনি। উঠোনে ঢুকেই হাক দেয়- কই রে দিল বেজু। মাঝে মধ্যে মৌলভি আদর করে দ্বিতীয় অপভ্রংশে- তাকে দিল বেজু নামে ডাকে। প্রথম ডাকে সাড়া দেয় না দিল। দ্বিতীয় ডাকে ছোট্ট করে উত্তর দেয়- আসছি। ছোট্ট হলেও বিবির সাড়া তাকে স্বস্তি দেয়। অন্যদিন সে ঘরে ফিরে আগে মা’র কাছেই বসতেন। আজ সোজা বিবির কাছে।
এ বছর অগ্রহায়নের মাঝামাঝি থেকে শীত ঝেকে বসেছে। শীতের পোষাক ছাড়া বাইরে বেরুনো দূরের কথা বিছানায় ঘুমানো পর্যন্ত অসম্ভব হয়ে ওঠেছে। তাই রাতে পালানোর প্রস্তুতি হিসাবে নতুন জামার ওপর শীতের কাপড় আর গলা অব্দি মাথার কানটুপি পরিয়ে ছেলে শাকুরকে ঘুম পাড়ায় দিল বেজু। তার চোখ-নাক ছাড়া প্রায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আর শীতের রাতে গরমের ওম পেয়ে সেও দ্রুত ঘুমের জগতে পাড়ি দিয়েছে। বেটে মৌলভিও ওয়াজ শেষে শীতের রাতে ঠাণ্ডা থেকে বাঁচতে পাঞ্জাবীর ওপর শীতের পোষাক আর গলা অব্দি কানটুপি ঢেকে বাড়ি ফিরেছে। ফিরেই ওই অবস্থাতেই শুয়ে পড়েছে ছেলের পাশে।
দিল বেজার বানু রাগে ফুলতে থাকে। বুড়ির কারণে স্বামীর বাড়ি ফেরার আগেই পালাতে পারেনি সে। এখন মনে হচ্ছে- বুড়িকে গলা টিপে মেরে ফেলাই ভাল ছিল। মৌলভি কাপড়-ছোপড় পাল্টে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। তার আশংকা বিবিকে আন্দাজ করতে দেয় না। যেন অন্য দশটি দিনের মতোই সবকিছু স্বাভাবিক। কিন্তু কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারছে না দিল। মনটা কেবল পালাই পালাই করছে। করবেই তো। বহুদিনের ছাইছাপা আগুন হঠাৎ জ্বলে ওঠেছে তার মনে।
নিজের বিছানায় দিলবেজার। পাশের কক্ষে ছেলে শাকুরের পাশে বেটে মৌলভি। দুইজনেরই কানখাড়া। একজন অপেক্ষা করছে অন্যজনে পাহারা দিচ্ছে।
শাকুরের বয়স এগারো হলে কি হবে দেখতে সে বাপেরই সমান। লোকে বলে- শাকুর হয়েছে নানার মতো। যেমন টকটকে ফর্সা তেমন শোল মাছের মতো লম্বা একহারা গঠনের শরীর। ছেলের জন্মের পর মৌলভি দু’একবার স্ত্রীর কাছে কৈফিয়তও চেয়েছে। এ ছেলে কার? তবে প্রতিবারই দিল বেজার চোখের জলে বুক ভাসিয়ে পবিত্র কালামে পাকের নামে শপথ করেছে- জীবনে সে একজন পুরুষের বুকেই আশ্রয় নিয়েছেন আর তিনি হলেন বেটে মৌলভি। মৌলভি তার এ কথা বিশ্বাস করুক আর না করুক জবরদস্তি করতে যায়নি। এতে পক্ষান্তরে তারই বদনাম। লোকজন তাকে তার খর্বত্ব নিয়ে এখন বেটে মৌলভি বলে তখন বলবে আটকুড়ো মৌলভি।
সারাদিনের দেহ মনে বেদনার্ত দিল বেজার বানু কাৎ হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই চোখে রাজ্যের ঘুমে নেসে আসে। জোর করে জেগে থাকতে গিয়ে কিছুক্ষণ এপাশ-ওপাশ করেছেন বোকার মতো। এতে মৌলভি আরও সচেতন হয়ে গেছে। আরও গভীর রাতে যখন ঘনরাত্রীর গাঢ় অন্ধকার ফ্যাকাশে হয়ে ওঠেছে। এমন সময় হঠাৎ করেই ঘুম ভেঙে যায় দিলের। মৌলভির হালকা চালের নাক ডাকার শব্দে সে নিশ্চিত হয় তিনি এখন ঘুমোচ্ছেন। মৌলভির ঘুম ভারী, গাঢ়। বিছানায় গা এলিয়ে দিলে আর খবর থাকে না। কিন্তু মৌলভি ধরে আছে ভান। স্ত্রীর প্রতিটি পদক্ষেপ তার সন্দেহ গাঢ় থেকে আশংকার তৈরি হচ্ছে। কিন্তু বোকা দিল তার কিছুই টের পায় না। দিল ঘুমিয়ে পড়ার পর মৌলভি ছেলের সঙ্গে স্থান পরিবর্তন করে নিয়েছে। ঘুমন্ত শাকুরকে সরিয়ে বিছানার প্রান্তবদল করে মৌলভি।
ঙ.
রাত ত্রিপ্রহরে, ঘুম ভাঙার পর দিল বেজার বানু বিছানা থেকে ওঠে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। পর্দা সরিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে আন্দাজ করলেন ফজরের আজানের কিছুক্ষণ বাকি আছে। এখনই রওনা দেয়া দরকার। এখন রওনা দিলে ফজরের আজানের সময় বাপের বাড়ি পৌছানো যাবে। বাপের মত ছেলে শাকুরেরও ঘুম ভারি। তাই খুব সতর্ক পায়ে দিল বেজার দরজার ছিটকানি খুলে দেয়। এবার সেগুন কাঠের আলনা থেকে বোরকাটা গায়ে চাপিয়ে বিছানার দিকে যায়। মৌলভির ঘুম ভেঙে যাওয়ার ভয়ে দিল বেজার বানু। সিথানে টিমটিম করে জ্বলা হারিকেনটি বড় করে না। আলো-আধারীর মধ্যেই বিছানার দিকে যায়। বিছানার যে পাশে শাকুর শুয়েছিল সে পাশে গিয়ে আলতোভাবে শাকুরকে হালকা ধাক্কা দিয়ে ঘুম ভাঙায়। তারপর দ্রুতপদে ঘর থেকে বেরিয়ে অতিসর্ন্তপনে বাইরের শিকলটি লাগিয়ে দেয়।
একটু আগে যখন ছেলের পাশাপাশি শুয়েছিল মৌলভি তখনকার ঘটনাগুলো ভাবে, আর মনে মনে হাসে। দিল বেজার বানু বিছানায় ফিরেই পাশে শোয়া শাকুর মনে করে বেটে মৌলভিকে গা ঝাকিয়ে ইশারা করে। কিরে নানা বাড়ি যাবি না? ঘুমের ভান ধরা বেটে মৌলভি পরিস্কার বুঝে ফেলে- দিল পালাচ্ছে। তখন সে দুইবার হু-হু করে? দিল পালানোর উত্তেজনায় সবকিছু ভুলে যায়। পোশাক-শারীরিক কাঠামো এবং আগাম পরিকল্পনার কারণে শাকুর আর বেটের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না। বউয়ের পালানোর ইশারায় পেয়ে সে মাথা নিচু করে বউয়ের পিছু নেয়। দরজাটা পার হয়েই টপ করে বউয়ের পিঠে চড়ে বসে। দিল বেজু ছেলের কাণ্ড দেখে বলে- বেটা হাঁটতেও পারবি না। তোর বাপ জীবনটা পুইড়া অঙ্গার করলো তুইও দেখি বাপের মতোই হইছিস। মাকে কষ্ট দিস। বলতে বলতে মৌলভির ভারী দেহটা নেড়ে চেড়ে কাঁধ ঝাঁকিয়ে পিঠের উপর ঠিকমতো বসিয়ে নেয়। বলে, তুই তো দেখি তোর আব্বাজানের চেয়েও ভারী। তারপর পেছন থেকে তার দুইপা নিজের কোমরের সঙ্গে পেছিয়ে ধরে হাটা দেয়। ছেলে সেজে পিঠে চড়া মৌলভি কোন শব্দ করে না। বরং ছেলের মত করে স্ত্রীর কাঁধের মধ্যে নিজের মাথাটি ফেলে দেয় ঘুমের ভান করে।
বেটে মৌলভি বিছানায় সরে শুয়ে ছিলেন স্ত্রীর গতিবিধি সম্পর্কে সতর্ক হতে। কিন্তু নিজের স্ত্রীর পিঠে ছেলের মতো চড়ে বসতে পারবে এটা কল্পনাও করতে পারেনি। যখনই স্ত্রী তাকে ছেলে মনে করে পিঠে তুলে নেয়- তখনই তাকে একটি রোমাঞ্চকর অনুভুতিতে পেয়ে বসে। দেখতে চায়- বেচারী শেষ পর্যন্ত কি করে। ঘুমের ঘোরে বেচারি বুঝতেই পারেনি। এমনকি দাড়িগুলোর অনূভূতিই টের পায়নি। এতে বেটে মৌলভি নিজেই বিস্মিত।
বেটে মৌলভি ছেলেকে খুবই আদর করে। প্রতিবার জামা বানানোর সময় একই কাপড় দিয়ে একই ডিজাইনে ছেলে শাকুরের জন্য ও জামা বানিয়ে নেয়। দুইজনের মাপও প্রায় একই। ফলে তারা বাপ-বেটা যখন কোথাও বেড়াতে যান তখন অনেকেই তাদের ভাই বলে ভুল করে। আবার দুইজনের বয়সের ব্যবধানও সে দ্বন্দ্বকে আরও জটিলতর করে তোলে। বেটে মৌলভি ও তার ছেলে শাকুরের কণ্ঠও প্রায় একই রকম। ফলে অনেক সময় আড়াল থেকে কথা বললে বাড়ির লোকজনও দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ে। এমন অনেকবার ঘটেছে যে, শাকুর মাদ্রাসা থেকে ফিরেই উঠোনে কারও সঙ্গে কথা বলছে- কিন্তু বেটে মৌলভি মনে করে দিল মাথার কাপড় টেনে দিয়েছেন। অন্যদের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। শাকুর তার আব্বাজানের শারীরিক গঠনটি না পেলেও পেয়েছে কণ্ঠটি।
বেটে মৌলভির সঙ্গে দিল বেজারের বিয়ে হওয়ার তেমন কোন যুক্তি ছিল না। কিন্তু অন্ধবিশ্বাস আর একটি অঙ্গীকারের কাছে পরাজিত হয়েছে যুক্তি। দিল বেজারের আগে ঠাণ্ডা মৌলভির আরও দুইটি মেয়ের জন্ম হলেও তারা খুব ছোটবেলাতেই মৃত্যুবরণ করে। কিন্তু ঠাণ্ডা মৌলভির একটির মেয়ের শখ ছিল। তাই তিনি দিল বেজারের জন্মের পর অঙ্গিকার করেছিলেন- মেয়েটিকে কোন আলেমের কাছে বিয়ে দেবেন। সে গরিব-গুর্বা, অন্ধ-খোঁড়া যাই হোক না কেন।
দরদি কণ্ঠের জন্য ছোট বেলা থেকেই সুনাম ছড়িয়ে পড়ে বেটে মৌলভির। ফলে মেয়ে দিল খোশ বানুর জন্য বিয়ের প্রস্তাব পেতেই একবাক্যে ‘হ্যাঁ’ করেছেন তিনি। একবার চিন্তা করার সময়ই পাননি তাদের শারীরিক অসামঞ্জস্যতা। বেটে মৌলভির কাছে তিনি মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। আর গোড়া মৌলভি বাড়ির মেয়ে হিসেবে পারিবারিক সম্মান দেখাতে গিয়ে সে বিয়েতে রাজী চুপচাপ সম্মতি দিয়েছিল দিল বেজার।
কারণ পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চি উচ্চতার সুঠামদেহী দিলের বিপরীতে চার ফিট উচ্চতার বেটে মৌলভির সামঞ্জস্যতা হয় না। এমনিতেই আদরের প্রতিবন্ধকতা তার উপর এ বৈষম্য তাদের সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে দাওয়াত কবুলের পথও সংকুচিত করে। তবে ঠাণ্ডা মৌলভি মেয়ের জামাই বেটে মৌলভিকে বিচার করে আধ্যাতিœক উচ্চতায়।
চ.
কৃষ্ণপক্ষের টানে চাদের আলো অনেকটাই ম্লান। আলোচ্ছায়ায় পথ স্পষ্ট দেখা গেলেও মাঝে মধ্যে গা চমকানো নানা শব্দ চারদিকে, পাখির ডানা ঝাপটানি। কোনটি পোকার আর কোনটি পশুপাখির। গাজির বিলের বুক চিড়ে সুখছড়ি নদীর পাশ ধরে মেটোপথ চলে গেছে টংকাবতী কুলে। টংকাবতী পার হলেই মল্লিক চোয়াং হয়ে পদুয়া। জিনপরীতে ভয় করে না দিলবেজার। ছোটবেলায় বাপের কাছে শেখা দোয়া দরুদগুলো এখনও তার মনে আছে। ছোটবেলা থেকে অনেকের মুখে শুনে আসছে- তার বাবা ঠাণ্ডা মৌলভি নাকি রাত বিরাতে ওয়াজ মাহফিল বা দাওয়াত শেষে ফেরার পথে বেয়াদবি করার অপরাধে বহু জ্বিনপরিকে এসব দোয়া দরুদ পড়ে অন্ধ ও বোতলবন্দী করেছে।
ছেলে হয়ে পিঠে চড়ে বসা বেটে মৌলভির ওজন নিয়ে আর হাঁটতে পারে না দিল বেজু। পিঠে ভার, মনে ভয়। দুইয়ে মিলে তাকে আরও বেশী কান্ত করে ফেলে। এই সেদিন বউ হয়ে এসেছে বেটে মৌলভির বাড়িতে। সেদিন কোলে করে দুধ খাইয়েছে শাকুরকে। দিনদিন বাড়ন্ত ছেলেটা দেখতে বাপের সময় হয়ে ওঠেছে। সুখছড়ির বাঁশঝাড় আর ডাল ছড়ানো কড়ই গাছের ঘন ছায়া মাড়িয়ে দিল বেজু হাঁটে আর ভাবে। কি ভাবে! কি ভাবে না? অতীত স্মৃতি ভাবতে ভাবতে তার মন ছুটে যায় অকল্পনীয় ভবিষ্যতে। শুধু কি সে? মৌলভির মনের মধ্যেও চলছে নানা ভাংচুর। কৌতুহল আর রহস্যের খেলা।
অদূরে টংকাবতী নদী। অন্ধকারের মধ্যেও আবচা আবচা নদীতীরের বাঁশঝাড়গুলো দেখা যায়। খানিকটা উত্তরদিকে লালবিন্দুর মত কি একটা জ্বলছে। দিল বেজু আন্দাজ করে নেয়, লালবিন্দুটি নিশ্চয়ই ঢাইরকূল মসজিদের মিম্বরের আলোকবাতি। বেজু শাকুরের পায়ে চিমটি দিয়ে বলে- শাকুর, ওঁ শাকুর। শাকুরের কোন সাড়া নেই।
পিঠের ভারে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে ঢাইলকূল এসে পৌঁছে দিল বেজু। ছেলেকে পিঠ থেকে নামিয়ে দিয়ে বলে, আর পারছি না বাবা। এবার হেঁটে চল। এখনো অনেক পথ।
কথাটি বলেই টেনে নিঃশ্বাস নেয় বেজু। মুহূর্তের মধ্যেই মুখের কাপড় সরিয়ে নিজেকে প্রকাশ করে বেটে মৌলভি। নিঃশ্বাস ফেলেই ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে দিল বেজু। ঘটনার আকস্মিকতায় যেন একখণ্ড পাথরে পরিণত হয়।
মৌলভি কথা বলে ওঠে- বৈতাল, রাতের আঁধারে পালাচ্ছিস। বললেই তো হতো, পাল্কিতে করে ঠাণ্ডা মৌলভির ঘরে পৌছে দিয়ে আসতাম। ঠাণ্ডা মৌলভির মেয়ে, বেটে মৌলভির বউ হয়ে পালাতে তোর বুক কাঁপলো না। মৌলভির গলায় কোমল তাচ্ছিল্যের সুর।
মুখ দিয়ে কোন শব্দ বেরুয় না বেজুর। পাথরের মতো মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে কাঁপতে থাকে। স্ত্রীর ভয়ার্ত কাঁপুনি দেখে মৌলভির মন নরম হয়। পরক্ষণেই আরেকটি নতুন কাণ্ড ঘটায় মৌলভি। আলগি মেরে উঁচু হয়ে দিল বেজুর গলাটা জড়িয়ে ধরে নাগালে আনে। চকাস চকাস করে দু’গালে চুমো খেয়ে বলে- এবার কোথায় যাবি? বাপের বাড়ি না লাঙের বাড়ি?
কাফি কামাল
....................
কাফ্রির মতো ঘন কালো রাত্রীর হৃদয় ধরে দিলবেজার বানু বিড়াল পায়ে হেঁটে চলছেন। গন্তব্য তার পদুয়ার হাতির দীঘি। বাপের বাড়ি, ঠাণ্ডা মৌলভির ঘর। মেঠোপথের দুইপাশে কালো কালো স্তুপের মত ঝোপঝাড়। নানা রকম পোকা মাকড়ের বিদঘুটে আওয়াজ একটি ভৌতিক আবহের সৃষ্টি করছে। মুখে তার আল্লাহ-রসুলের পাক কালাম আর কাঁধে বিয়াল্লিশ সেরের যমদূত; বেটে মৌলভি। পরণে জোলার শাড়ি, চরণে রেঙ্গুনের চপ্পল।
সুখছড়ির বেটে মৌলভির বাড়ি থেকে হাতির দীঘির ঠাণ্ডা মৌলভির বাড়ির দূরত্ব পাক্কা সাড়ে তিনমাইল। দূরত্বের একপ্রান্তে বটবৃক্ষের স্নিগ্ধ আশ্রয় অন্যপ্রান্তে গরম তাওয়ার উষ্ণতা। মধ্যখানে বয়ে গেছে খরস্রোতা টংকাবতী নদী।
সাদী মোবারকের একযুগ ধরে প্রতিটি ক্ষণ দিল বেজার বানু তা হাড়ে হাড়ে অনুভব করেছে। বারবার মনে পড়ে সুখছড়ির বেটে মৌলভিকে কবুল বলার সে চুপচাপ জবরদস্তির কথাটি। শ্বশুরবাড়ির প্রথমদিন থেকে গরম তাওয়ায় ভাজা লালমরিচের মত পুড়ে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছেন। কিন্তু নিয়তির পরশ পাথরের অপেক্ষায় কেটে গেছে দীর্ঘসময়। এরই মধ্যে তার নাড়িছেঁড়া ধন মোহাম্মদ শাকুরের বয়স এগারো পূর্ণ হয়ে বারোতে পড়েছে। বিয়ের ১১মাসের মাথায় দিল বেজারের কোল আলো করে এসেছিল শাকুর।
বিয়ের পর মেয়েরা পায় একজন মাতৃতুল্য শাশুড়ি। কিন্তু দিল বেজারের কপালে আল্লাহপাক লিখে দিয়েছেন একটি কুটনি বুড়ি। সে কুটনি বুড়ির ঘেরোবন্দী হন ঠাণ্ডা মৌলভির শান্ত স্বভাবের মেয়েটি। কথায় কথায় ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, অবহেলা। শাশুড়ির তাচ্ছিল্য দিয়েই শুরু হয় তার সংসার জীবন। গভীর রাতে ওয়াজ মাহফিল থেকে বাড়ি ফিরেন বেটে মৌলভি। ফেরা মানেই কুটনি বুড়ির হঠাৎ নাকিকান্নার সুর ওঠা, মায়ের কান্নায় মৌলভির তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠা। তারপর চারফুট উচ্চতার মাওলানা আবদুস সালাম ওরফে বেটে মৌলভির বিচারসভা। ছেঁড়া জুতা জোড়া থেকে পুরোনো ঝাড়–র উপুর্যুপরী আঘাত। অবশেষে দিল বেজারের রক্তাক্ত দেহ, বিছানায় ছটফট করার দৃশ্য। যদিও দিল বেজারের আব্বাজান নেয়ামত উল্লাহ ওরফে ঠাণ্ডা মৌলভির বিবেচনায় এটা একটি শয়তান বিতাড়ন প্রক্রিয়া। তিনি দিলকে বারবার সান্তনা দেন, স্ত্রীর শরীরে যেখানে স্বামীর আঘাত লেগেছে সেখানে দোযকের আগুন স্পর্শ করবে না। সত্যিই কি তাই! তাহলে তো দোজকের আগুনে দিল বেজারের খুব একটা কষ্ট হবে না। এতটুকু মেনে নিলেও শেষ রাতে বিক্ষত শরীর নিয়ে বেটে মৌলভির একতরফা নির্যাতনে সে সত্যিই বেদনাহত হয়েছে। ফুলে ওঠা স্থানে দোযকের আগুন স্পর্শ না করার একটি বিশ্বাসগত সম্ভাবনা থাকলেও মৌলভির স্পর্শ নির্যাতন থেকে রেহাই মিলেনি।
বাবা-মা’র আদরের মেয়ে দিল খোশ বানু এক সময় হয়ে ওঠেছে বেটে মৌলভির দিল বেজার। এখন সে সত্যিকারেরই দিল বেজার। বিয়ের দীর্ঘ এক সময়েও কখনো বিজলীর মত দুই একটি মুহুর্ত ছাড়া দিল তার বেজারই থেকেছে। খোশ হয়ে ওঠতে পারেনি। তার বেদনার্ত গুমড়া মুখের দিকে তাকিয়ে এক ভোর বেলা তাকে এ অপবাদই দিয়েছে বেটে মৌলভি। সে থেকেই দিল খোশ বানু হয়ে ওঠেছেন দিল বেজার ওরফে দিল বেজু।
খ.
অগ্রহায়নের শেষ সপ্তাহেই ঝেকে বসেছে পৌষের শীত। কৃষকের ধান কাটা প্রায় শেষ। নতুন ধানের ধেনো গন্ধে মৌ মৌ করছে চারদিক। চাষা ভুষো গ্রামীণ মানুষ আল্লাহর শোকর জানাতে পাড়ায় পাড়ায় ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করছে। পাড়ায় পাড়ায় মসজিদ মাদ্রাসায়গুলোর কোষাগার ফুলে ফেপে স্ফিত হচ্ছে। নাখোদা’রা বলে, অগ্রহায়ন হচ্ছে মসজিদ মাদ্রাসার কোষাগার স্ফীতির মওসুম। মৌলভির ওয়াজে ধর্মীয় গল্প বলার ফাঁকে-ফোঁকরে দরাজ গলায় লোকজনের কাছে চাদা তুলছে। মারহাবা মারহাবা শব্দে বাড়ছে চাঁদার পরিমান আর মহিমা। কেউ নতুন ধান বিক্রির কড়কড়ে নোট, কেউ বা আড়ি আড়ি ধান চাউল দান করছে। মৃত বাবা-মা আত্মার শান্তি কামনা, সংসারের সুখ সমৃদ্ধি ও দোজাহানের নেকি অর্জনে সবাই এখন কম বেশি উদার হস্ত। এলাকার উঠতি পয়সাওয়ালারা তো রীতিমতো প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠেন। এ সময় ঘন ঘন ওয়াজের দাওয়াত আসে মৌলভির। দিনে দু’তিনটিও থাকে। নজরানাও কম নয়। এক একটি ওয়াজের জন্য তাকে দিতে হয় হাজার টাকা। ভাল মানের খাবার দাবার তো আছেই। কেউ কেউ যাতায়াতের জন্য রিক্সার ও ব্যবস্থা করেন। তিন চার ক্রোশ দূর থেকে বেটে মৌলভির ওয়াজের দাওয়াত আসে। এ সময় কাপড়-চোপড়ে একটু যতœবান হতে হয়। তাই ইস্ত্রির ভাজ দেয়া পাঞ্জাবী ছাড়া ওয়াজ মাহফিলে যান না বেটে মৌলভি। সেদিন সুখছড়ি ওয়াজ মাহফিলে গিয়ে খাবার সময় আর্দি কাপড়ের পাঞ্জাবীতে গরুর গোশতের ঝোল পড়ে দাগ হয়ে যায়। তাই দাগ উঠাতে সেটি বাজারের লণ্ড্রিতে দেয় মৌলভি। আরেকটি পাঞ্জাবী আধোয়া। সেদিন সকালে মাদ্রাসায় যাওয়ার সময় মৌলভি দিল বেজারকে কড়া নির্দেশ দেয়। দিল বেজু- আমার কোর্তাটা ধুয়ে রাখবা। বিকালে ওয়াজে যেতে হবে। সেখান থেকে রাতে আরেকটি দাওয়াত আছে। কিন্তু সারাদিন বাড়ির কাজে দিল বেজু কোর্তা ধোয়ার কথা ভুলে যায়। দুপুরে মাদ্রাসা থেকে বাড়ি ফিরে মৌলভি দেখে যেখানের কাপড় সেখানেই আছে, ধোয়া হয়নি। দেখেই মাথায় রক্ত ওঠে যায় তার। মুখ দিয়ে গালির ফোয়ারা ছুটে- ওই খানকি মাগির ঝি, কি বলে গিয়েছিলাম মনে নেই।
দিল বেজু হন্তদন্ত হয়ে রান্নাঘর থেকে ছুটে আসে। কি হয়েছে?
তোর মাকে .....।
এভাবে কুত্তা বিলাইয়ের মত গালি দিচ্ছেন কেন।
জানিস না- তোরে যে ওয়াজের সুরে কোর্তা ধুইতে বলেছিলাম।
ততক্ষণে শুরু হয়ে যায় চুল ধরে মারপিট। দিল বেজু সহ্য করতে পারে না। সে ভুল করেছে সত্য তবে ঘরে তো আর বসে ছিল না। বাড়িতে মেহমান এসেছে। তাদের জন্য রান্নার পাশাপাশি বাড়ির ভেতর ধান চালের মওসুমী কাজ তো আছেই।
মুখের গালি আর হাতের ঢালি খেয়ে, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে দিল বেজার বানু। দুপুরে বেতের বাড়ি হজম করতে করতে সে বলেই ফেলে- আমি আর আপনার ঘর করবো না। আপনার ঘরে থাকবো না।
কোন নাগরের কাছে যাবি? বেটে মৌলভির শ্লেষ।
অত আর আল্লাদ নেই।
তাহলে কোথায় যাবি- হারামজাদি।
মুখ সামলে কথা বলেন। আব্বাজানের গজব পড়বে।
খানকি তুই তালিম দিস না। বেটে মৌলভি আরেক ঘা লাটির আঘাত করে।
কোথায় কোন বারাম খানায় যেতে চাস বল।
বাপের বাড়িই যাব। আপনারে ঘুমে রেখেই যাব। নিবুর্দ্ধিতা করে নিজের গোপন পরিকল্পনাটি ফাঁস করে দেয়- দিল। তবে চালাক বেটে মৌলভি সতর্ক হয়ে পড়ে। লোকে তো এমনি বলে না- ‘বেটে হচ্ছে শয়তানের লাঠি।’ দেহে যারা বেটে বুদ্ধিতে সে তারা দীর্ঘ। ফলে মৌলভি বুঝে নেয়- এবার একটা অঘটন ঘটবে। খাঁচার পাখির মুখে বোল ফুটেছে। এবার উড়াল দিতে চাইবে। কয়েকদিন আগের কথাগুলো এবার ভাবতে থাকে মৌলভি।
সবকিছুতেই শাকুরের কৌতূহল। সবকিছুই যেন তাকে বুঝতে হবে, জানতে হবে। কিছুদিন আগে জেটাতো ভাইয়ের সাইকেল নিয়ে সে হঠাৎ উধাও হয়ে যায়। সে যে সাইকেল চালাতে পারে সেটাই বাড়ির কেউ জানতো না। সাইকেল খুঁজে না পেয়ে শাকুরের জেটাতো ভাই গফুর যখন গালাগালি করতে করতে খুঁজছে তখনই খবরটি পাওয়া গেল। উত্তরপাড়ার করিম সরকার জানালো, তিনি নিজের চোখে দেখেছেন। শাকুর কাত হয়ে হয়ে সাইকেলের প্যাডেল মেরে উত্তরদিকে চলে গেছে। করিমের কথা শুনে সবাই অবাক। শাকুর সাইকেল চালাতে শিখলো কখন? কেউতো শাকুরকে চালানো শেখায়নি। সবার মুখে জিজ্ঞাসা? সে প্যাডলের নাগাল পায়তো?
এরই মধ্যে করিম অদৃশ্য সাইকেল চোরের জ্ঞাতিগোষ্ঠী তুলে গালাগালি করেছে। এখন খবর পাওয়ার পর সে লজ্জিত মুখে উত্তরদিকে হাঁটা দিল। করিম সরকারের কথায় দিল বেজার বানুর মনটা দ্বিখণ্ডিত হয়ে পড়েছে। একমনে ছেলের সাইকেল চালনা শেখার কৃতিত্বে আনন্দিত অন্যমনে গফুরের গালাগালিতে ছেলের প্রতি ক্ষোভ দানা বাঁধছে। গফুরের গালিগুলো তার অন্তরে এসে বিধঁছে। যদি ছেলের একটি সাইকেল থাকতো তাহলে নিশ্চয়ই তাকে এভাবে গালি শুনতে হতো না। নানা কাজে এদিক ওদিক পাঠানোও যেতো।
খানিকক্ষণ পর শাকুরকে পাওয়া গেলো কাজির বিলে। সাইকেলে শরীর বাকিয়ে প্যাডল মারছে আর কখনো হাত ছেড়ে দিচ্ছে কখনো পা প্যাডল থেকে তুলে নিচ্ছে। গফুর তাকে ডাক দেয়- এ্যাই শাকুর। গফুরকে দেখেই অবশ্যই শাকুর সাইকেল দাঁড় করিয়ে কাঁপতে থাকে। তবে গফুর তাকে কটু কিছু বলে না। শুধু মিষ্টি হেসে বলে- এ্যাই বজ্জাত বলে আনতে পারতি না। শাকুর লজ্জা ও ভয়ে নিশ্চুপ। এতক্ষণ পর বুঝতে পারছে সে খুব একটা অপরাধ করে ফেলেছে।
রাতে বাড়ি ফিরেই আগুন চোখে বেটে মৌলভি ছেলেকে ঘুম থেকে তুলে। কোন কৈয়ফিত জানতে না চেয়েই চড়-থাপ্পড়ে শাকুরের গাল লাল করে ফেলে। ঠোঁট ফেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোয়। সহ্য করতে না পেরে দিল বেজার বানু ঠেকাতে যায়।
কি করছেন আপনি। ছোট্ট অপরাধে এমনভাবে পেঠাতে হয়।
মুখে কোন কথা নয়, সঙ্গে সঙ্গে শাকুরকে ছেড়ে দিল বেজারকে পেঠাতে শুরু করে মৌলভি।
টানা তিনদিন জ্বরে ভোগার পর বিছানা ছাড়ে শাকুর। ছেলের ফ্যাকাসে মুখ দেখে মায়ের মন মানে না। দিল বেজারের চোখ দিয়ে শ্রাবণের বারি ঝরেছে এইতিনদিন।
ছেলে সুস্থ হওয়ার পর একদিনে দিল বেজার স্বামীর কাছে একটি আবদার করে বলে- একটি কথা বলব, রাখবেন?
কি কথা- মৌলভির কণ্ঠে কোমলতা।
ভরসা পেয়ে দিল বেজার আর্জিটা পেশ করে- আমাদের শাকুরকে একটি সাইকেল কিনে দেন না।
শুনে মুহূর্তের মধ্যেই রেগে আগুন হয়ে ওঠে মৌলভি। তার মুখ দিয়ে বেরুতে থাকে, রাগের লাভা। তপ্ত এবং হন্তারক। খানকি, বৈতাল- ছেলেকে গাণ্ডু বানাতে ছাস। আবার বলবি তো, চুলের ঝুঁটি ধরে হাতিরদীঘি পাঠাব।
দিল বেজার স্বামীর মেজাজের আকস্মিকতায় খানিকটা ভড়কে যায়। পরক্ষণে তার মনটা খুবই খারাপ হয়ে যায়। প্রায়ই সে এটা-ওটা আবদার করে না। বাড়ির প্রয়োজনীয় জিনিষের বাইরে কবে কি আবদার করেছিল তার মনেই পড়ে না। তাই এক পর্যায়ে তার জেদ হয়। যাই হোক, যেভাবেই হোক ছেলেকে সাইকেল সে কিনে দেবেই।
কয়েকদিন পর জীবনে প্রথমবারের মতো চুরি করে দিল বেজার। পাড়ার সোলায়মানকে দিয়ে গোলা থেকে ধান নামিয়ে গোপনে বিক্রি করে। সোলায়মান তিনটি পাঁচশ টাকার নোট তার হাতে গুঁজে দেয়। বাড়ির খরচ থেকে বাঁচিয়েও সে বাড়ির বাঁশের খোড়লে কিছু টাকা জমিয়েছিল। খোড়ল কেটে নানা অংকের নতুন-পুরোনো নোট মিলিয়ে দেখে আটশ ঊননব্বই টাকা জমেছে। সে এরই মধ্যে খবর নিয়ে দেখেছে একটি মাঝারি উচ্চতার সাইকেল কিনতে দুইহাজার টাকা লাগে। এই কয়দিন স্বামীর কাছে যতই অপমানিত হোক না কেন তার চোখে ভেসেছে একটি দৃশ্য। শাকুর সাইকেল চালিয়ে মাদ্রাসায় যাচ্ছে আর বাতাসে ওড়ছে তার পাঞ্জাবীর খুট।
পরদিন ভাসুরপুত গফুরকে আমিরাবাদ পাঠিয়ে একটি সাইকেল নিয়ে আসে। লাল রঙের ফনিক্স সাইকেল। সাইকেল পেয়ে শাকুরের আনন্দ যেন আর ধরে না। সাইকেল নিয়ে সে উঠোন পেরিয়ে রাস্তার দিকে চলে যায়। সেটা দেখে দিল বেজারের মন বহুদিন পর খোশ হয়। নিজের আসল নামের কথা তার মনে পড়ে। মুহূর্তের তার মুখ দিয়ে ফিক করে হাসির শব্দ বেরুয়।
সকালে ঘরের দাওয়ায় নতুন সাইকেল দেখে অবাক হয় মৌলভি। খর্বত্বের কারণে নিজের সাইকেল চালানো শেখা হয়ে ওঠেনি। তার ছেলে সাইকেল চালাবে তার সামনে দিয়ে! মৌলভি কল্পনাই করতে পারছে না।
দিল বেজারকে হাঁক দেয়- এই দিল বেজু, এদিকে আয়।
দিল সামনে আসতেই সাইকেল দেখিয়ে মৌলভির প্রশ্ন- এটি কার?
মুখে হাসি ফুটিয়ে দিল বেজার বলে- শাকুরের জন্য কিনে আনিয়েছি।
কে কিনে দিয়েছে?
জ্বি, আমি কিনে আনিয়েছি, গফুরকে দিয়ে।
বৈতাল তুই, টাকা কোথায় পেলি? মৌলভির মেজাজ চড়তে শুরু করেছে।
হাতে কিছু টাকা ছিল আর...
আর কি?
কয়েক আড়ি ধান বিক্রি করেছি।
দিল বেজুর কথা শেষ হওয়ার আগেই ‘ছেলেকে গাণ্ডু বানানোর পায়তারা করছিস’ এই স্বগোক্তির করতে করতে মৌলভির হাত-পায়ের ব্যবহার শুরু হয়ে যায়। সেই সঙ্গে যা তোকে আমি ‘এক তালাক’ দিলাম বলে মৌলভি এ সংক্রান্ত তিনটি শক্তির একটি ব্যয় করে ফেলেন। এখনও তার হাতে দুইটি শক্তি, দিল বেজুর সামনেও দুইটি রক্ষা কবচ। শব্দটি আর মাত্র দুইবার উচ্চারণ করলেই মৌলভি হারাবেন তার ক্ষমতা আর দিল হারাবেন তার স্ত্রী পরিচয়। তবে দ্রুত সামলে নেন মৌলভি। দুপুরেই তিনি সাইকেলটি দুইশ টাকা বাট্টা দিয়ে ফেরত দিয়ে আসেন। সারাদিনের পিটুনী আর গালাগালির চেয়ে এ বিষয়টিই বেশী কষ্ট দেয় দিলকে। সংসারের পাক্কা একযুগের ভিত যেন দ্রুতই ক্ষয়ে যেতে থাকে।
দিল বেজারের মন আবারও দ্বিখণ্ডিত হয়। একদিকে সংস্কার অন্যদিকে স্বাধীনতা। স্বামীর বাড়ি ছেড়ে বাপের বাড়ি গেলে লোকে মন্দ বলবে। সবচেয়ে বড় কথা বাবা কষ্ট পাবেন। মৃত্যুপর পর আল্লাহর শাস্তি নিয়েও সে দ্বিধান্বিত। কি জবাব দেবেন আল্লাহকে। মৌলভি তো শুধু নির্যাতনই করে না। মাঝে মধ্যে আদরের আতিশয্যও দেখায়। কথাটি ভাবতে ভাবতেই তার চোখে ভেসে ওঠে বহু স্মৃতি।
ওয়াজ মাহফিল থেকে ফেরার সময় বহুদিন বহু জিনিষ নিয়ে এসেছে তার জন্য। কখনো কমলা-আপেল, কখনো বা পোটলা বেঁধে তরকারি। আবার সেসব তিনি দিল বেজারকে খাইয়ে দিয়েছেন নিজ হাতে। খুব মজা করে, আদর করে। স্বামী হিসাবে মৌলভি একরোখা। বিয়ের পর থেকে কেবল অপবিত্রের মওসুম ছাড়া দিলকে কখনো নিস্তার দেননি মৌলভি। বহুবার রাতে মৌলভির অতি আদরে সৃষ্ঠ মুখের দাগগুলো ঢাকতে দিল বেজুকে মুখে শাড়ির আচল পেচিয়ে বাড়ির কাজকর্ম করতে হয়েছে। এ রকম দিনগুলোতে প্রতিবেশী ননদ-ভাবীরা আড়ালে আবড়ালে হেসেছে। তখন মুখে লজ্জা থাকলেও আনন্দ গৌরবে তার বুক ভরে গেছে।
তবে সবসময়ই মৌলভির আদরের অত্যাচারে মন ভরে না দিল বেজুর। অভ্যাসে পরিণত হলেও ভেতর থেকে সাড়া জাগে না। খারাপ লাগে যখন দিল বেজুর কোন ভাললাগা, খারাপলাগা কিংবা মতামতের তোয়াক্কাই করে না মৌলভি। দিনের পর দিন সহ্য করলেও সাইকেল কাণ্ডটি দিলের দিল ভেঙে দেয়।
বিয়ের পর থেকে এভাবেই দিল বেজার নতুন করে আবিস্কার করতে থাকে বেটে মৌলভিকে। মানুষের সামনে লোকটি খুবই আমলদার আলেম। কিন্তু নিজস্ব পারিবারিক জগতে প্রায় বিপরীত। রেগে গেলে তার মুখে গালি ফুটতে থাকে ওয়াজের মতোই। দিল বেজারের মা-বাপ কেউই বাদ পড়ে না সে বিষ বর্ষণ থেকে। তখন দিল বেজার মৌলভির সঙ্গে পাড়ার অন্য চাষাভুষোর থেকে কোন পার্থক্য দেখতে পান না। বিয়ের ছয় মাসের মাথায় প্রথম গায়ে হাত তুলেছিল বেটে মৌলভি। ওজুর পানি দিতে দেরি করায় দিল বেজারের পিটে কষে একটা কিল মেরেছিল।
একদিন এক অদ্ভুত কাণ্ড করেছিলেন বেটে মৌলভি। উত্তেজিত হয়ে একটি কাঠের টুল নিয়ে এসেছিল। তারপর সে টুলে দাঁড়িয়ে টাশ-টাশ কয়েক ঘা চড় বসিয়ে দিয়েছিল দিলকে। এ ধরনের শাস্তিতে একধরনের মজা পেয়ে গিয়েছিল মৌলভি। ঘনঘন টুলের উপর দাঁড়িয়ে মুখে চড়-থাপ্পড় মারা রেওয়াজে পরিণত করে ফেলেছিল। আরেকদিন আরও অদ্ভুত একটি কাণ্ড করেছিলেন তিনি। দিল বেজারের স্তন দু’টি আঁকড়ে ধরে ঝুলে পড়েছিল মৌলভি। ব্যথায় ককিয়ে ওঠে মাটিতে গড়িয়ে পড়েছিল দিল বেজার। চোখে মুখে অন্ধকার নেমে এসেছিল। দিলের অবস্থা দেখে মুহুর্তের মধ্যে পাল্টে গিয়েছিল মৌলভি। তরা করে মাটির কলসি থেকে জল এনে তার চোখে মুখে ছিটিয়ে দিয়েছিল।
তবে বেশীর ভাগ সময় মৌলভির নির্যাতন নেমে এসেছে দিলের দীঘল চুল বেয়ে। রাগান্বিত অবস্থায় দিল বেজারের চুলের নাগাল পেরে তো কোন কথাই নেই। সোজা চুলের তোড়া পেচিয়ে ধরে শরীরটা ঝুকিয়ে নিয়ে ইচ্ছেমত চড় থাপ্পড় কিল ঘুষি বুৃষ্টির মত শুরু হয়। তখন ধর্মভীরু বেচারি দিলের কান্না ছাড়া কিছুই করার থাকে না। তাও আবার উচ্চস্বরে নয়, মৃদুস্বরে-নিরবে। কারণ একবার উচ্চস্বরে কান্না করতে গিয়ে তাকে তালাকের হুমকি দিয়েছিল মৌলভি। বলেছিল, পরপুরুষে পরনারীর কণ্ঠ শুনলে দোজকে জলতে হবে। আর তালাকের ভয় তো গ্রামীন ধর্মভীরু নারীর বিরুদ্ধে কার্যকর অস্ত্র। আর বেটে মৌলভি এসব অ™ভুত কাজ করতেন তার খর্বত্বের কারণে। স্বাভাবিকভাবে সে দিলের মুখমণ্ডলের নাগাল পেতো না। অবশ্য মানসিকভাবেও মৌলভি কখনো স্ত্রীর মনের নাগালটি পায়নি।
গ.
দুপুর থেকেই মনে মনে প্রস্তুতি নেয় দিল। রাত যখন বাড়বে, মৌলভি ওয়াজ মাহফিলে যাবে তখনই কলিজার টুকরো শাকুরকে নিয়ে বাপের বাড়ি রওনা দেবে সে। রাতের আধারে, আব্রু ঢেকে। দিল চিন্তা করে দেখেছে- ঠাণ্ডা মৌলভির সম্মান পুরো তল্লাটে। তার মেয়ে স্বামীর অবাধ্য হওয়ায় অজুহাতে তালাক পেলে সে সম্মান ধুলোয় লুটোবে। স্বামীর ইজ্জাতটাও কি কম? হাজার হোক কলেমা পড়া স্বামীতো। দুনিয়ার না পাওয়া যায় আখেরাতে তো ফল পাওয়া যাবে।
দুপুরে শাকুরকে ডেকে পুকুর ঘাটে নিয়ে যায় দিল। বাড়ির মধ্যে বললে আবার ফাঁস হয়ে যেতে পারে। এমনিতেই শাশুড়ি হল কুটনি বুড়ি। আশপাশের লোকজনরে বিশ্বাস করা যায় না। পুকুর ঘাটে গিয়ে ছেলেকে বলে- শাকুর বাপ আমার, তোর বাপের নির্যাতন আর সহ্য হয় না। চল আজ রাতে পালাই। তোর নানা বাড়িতে চলে যাই। তোর বাপ সবাইরে ওয়াজ নসিহত করে এবার তাকে একটা এলেম দিতে হবে।
অনেকটা বোকার মতই চুপচাপ ঘাড় নেড়ে মায়ের কথায় সায় দেয় শাকুর। বাবাকে প্রচণ্ড ভয় পায় ছেলেটি। আবার মায়ের জন্যও দুঃখ লাগে। মনে মনে ভাবে- বড় হলে বাপরে শায়েস্তা করতে হবে। কিন্তু মায়ের প্রস্তাবে সে এক ধরনের দ্বন্দ্বে পড়ে যায়। জগতে সবার উপরে মায়ের সম্মান। আল্লাহর রাসুল নাকি সে স্বীকৃতি দিয়েছেন। যদিও বাবার মুখেই তার এসব কথা শোনা। যাহোক, দিল ছেলেকে রাজী করাতে পারে।
সে প্রশ্ন করে- কিন্তু কিভাবে যাবেন আম্মা।
কেন হেঁটে, রাতের আঁধারে।
আব্বাজান তো জেনে যাবে। তখন তো কেরাপ বেতের বাড়ি একটিও মাটিতে পড়বে না।
দিল তাকে অভয় দেয়। আজ রাতে নতুন জামা পরেই শুয়ে থাকবি। রাতে যখন তোকে শরীর ঝাকিয়ে ইশারা করব তখন চুপচাপ আমার সঙ্গে বেরিয়ে পড়বি।
মায়ের পরিকল্পনা অনুযায়ী ছেলে সন্ধ্যা রাতেই ঘুমিয়ে পড়ে। পরনে তার নতুন জামা।
ঘরের ভেতর পাশাপাশি কক্ষ। আগে শাকুরকে একই বিছানায় রাখতেন মৌলভি। আটবছর বয়সের পর থেকে তাকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে পাশের কক্ষে। তবে দুই কক্ষের মধ্যখানের দরজা সবসময় খোলাই থাকে। মৌলভি মাঝেমধ্যে ছেলের পাশেই শোয়। বিশেষ করে দিলবেজারের ঋতুর মওসুমে।
জামাই বিকালে ওয়াজে যাওয়ার পর থেকে দিল বেজার বানু অপেক্ষার প্রহর গুনছে। সন্ধ্যারাতে শাশুড়িকে খাইয়ে দাইয়ে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছে দিল। যেচে শ্বাশুড়ির মাথার চুল টেনে দিচ্ছে, পা টিপে দিচ্ছে আর বেদনানাশক তেল মালিশ করে দিচ্ছে। মনে মনে কামনা করছে- বুড়ির চোখ দু’টি বুঝে আসুক। শীতের রাত। অনেক দীর্ঘ। মৌলভির ঘুম কাতুরে চোখকে ফাঁকি দেয়ার এটাই উপযুক্ত সময়। ওয়াজ মাহফিল থেকে ফিরতে ফিরতে কুয়াশায় আবছা অন্ধকারে লোকজনের চোখকে ফাঁকি দিয়ে বিলপাতারি হেঁটে পদুয়া বাপের বাড়ি যাবার। রাত আরেকটু গভীর হলেই বেরিয়ে পড়তে চায় সে। বেটে মৌলভি বাড়ি ফিরতে ফিরতে পৌছাতে চায় বাপের বাড়ি। লোকজনের চলাফেরা থাকতে সে যেতে পারবে না। কারণ পথে তাকে কেউ চিনে ফেললে নানারকম বিপদ। একে মৌলভির কন্যা তার ওপর মৌলভির স্ত্রী। লোকজনের সামনে দিয়ে একাকি গভীর রাতে চলাফেরা বড় অশোভন হবে। লোকজন শেখায়েত করবে।
কিন্তু বুড়ির আর চোখ বুঝে না। মাঝে মাঝে চোখ বুঝে এলেই ধড়পড়িয়ে ওঠে বুড়ি। তার কাছে কি যেন লুকোতে চায়। হঠাৎ চা খেতে চায়। অথচ বুড়ি সচরাচর চা খায় না। পিঠে গরম পানির ছ্যাকা দিতে বলে। বুড়ির হলো কি আজকে। তাহলে কি তার পরিকল্পনা জেনে গেছে বুড়ি? দিল বেজারের দিলে নানারকম দোলাচল।
ঘ.
স্ত্রীর পরিকল্পনা জানার পর ওয়াজ মাহফিলে মন বসে না বেটে মৌলভির। ওয়াজে নামাজের ‘একমন তত্ত্ব’ বয়ান করতে গিয়ে তার মনই দুইভাগে ভাগ হয়ে পড়ে। একমন ওয়াজে মনোযোগ দেয় আরেকমন বাড়িতে স্ত্রীর গতিবিধি আন্দাজ করে। রাতে ওয়াজ মাহফিল থেকে আগে বাগেই বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নেয়। অবশ্যই ওয়াজে বের হবার আগে বুড়ি মাকে সতর্ক করে এসেছে। বলেছে- দিলকে চোখে চোখে রাখতে। তারপরও মন মানে না। তাই তড়িঘড়ি ওয়াজ শেষ করে বাড়ি পথ ধরেন মৌলভি।
রাত দ্বিপ্রহরে হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ফিরেন তিনি। উঠোনে ঢুকেই হাক দেয়- কই রে দিল বেজু। মাঝে মধ্যে মৌলভি আদর করে দ্বিতীয় অপভ্রংশে- তাকে দিল বেজু নামে ডাকে। প্রথম ডাকে সাড়া দেয় না দিল। দ্বিতীয় ডাকে ছোট্ট করে উত্তর দেয়- আসছি। ছোট্ট হলেও বিবির সাড়া তাকে স্বস্তি দেয়। অন্যদিন সে ঘরে ফিরে আগে মা’র কাছেই বসতেন। আজ সোজা বিবির কাছে।
এ বছর অগ্রহায়নের মাঝামাঝি থেকে শীত ঝেকে বসেছে। শীতের পোষাক ছাড়া বাইরে বেরুনো দূরের কথা বিছানায় ঘুমানো পর্যন্ত অসম্ভব হয়ে ওঠেছে। তাই রাতে পালানোর প্রস্তুতি হিসাবে নতুন জামার ওপর শীতের কাপড় আর গলা অব্দি মাথার কানটুপি পরিয়ে ছেলে শাকুরকে ঘুম পাড়ায় দিল বেজু। তার চোখ-নাক ছাড়া প্রায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আর শীতের রাতে গরমের ওম পেয়ে সেও দ্রুত ঘুমের জগতে পাড়ি দিয়েছে। বেটে মৌলভিও ওয়াজ শেষে শীতের রাতে ঠাণ্ডা থেকে বাঁচতে পাঞ্জাবীর ওপর শীতের পোষাক আর গলা অব্দি কানটুপি ঢেকে বাড়ি ফিরেছে। ফিরেই ওই অবস্থাতেই শুয়ে পড়েছে ছেলের পাশে।
দিল বেজার বানু রাগে ফুলতে থাকে। বুড়ির কারণে স্বামীর বাড়ি ফেরার আগেই পালাতে পারেনি সে। এখন মনে হচ্ছে- বুড়িকে গলা টিপে মেরে ফেলাই ভাল ছিল। মৌলভি কাপড়-ছোপড় পাল্টে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। তার আশংকা বিবিকে আন্দাজ করতে দেয় না। যেন অন্য দশটি দিনের মতোই সবকিছু স্বাভাবিক। কিন্তু কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারছে না দিল। মনটা কেবল পালাই পালাই করছে। করবেই তো। বহুদিনের ছাইছাপা আগুন হঠাৎ জ্বলে ওঠেছে তার মনে।
নিজের বিছানায় দিলবেজার। পাশের কক্ষে ছেলে শাকুরের পাশে বেটে মৌলভি। দুইজনেরই কানখাড়া। একজন অপেক্ষা করছে অন্যজনে পাহারা দিচ্ছে।
শাকুরের বয়স এগারো হলে কি হবে দেখতে সে বাপেরই সমান। লোকে বলে- শাকুর হয়েছে নানার মতো। যেমন টকটকে ফর্সা তেমন শোল মাছের মতো লম্বা একহারা গঠনের শরীর। ছেলের জন্মের পর মৌলভি দু’একবার স্ত্রীর কাছে কৈফিয়তও চেয়েছে। এ ছেলে কার? তবে প্রতিবারই দিল বেজার চোখের জলে বুক ভাসিয়ে পবিত্র কালামে পাকের নামে শপথ করেছে- জীবনে সে একজন পুরুষের বুকেই আশ্রয় নিয়েছেন আর তিনি হলেন বেটে মৌলভি। মৌলভি তার এ কথা বিশ্বাস করুক আর না করুক জবরদস্তি করতে যায়নি। এতে পক্ষান্তরে তারই বদনাম। লোকজন তাকে তার খর্বত্ব নিয়ে এখন বেটে মৌলভি বলে তখন বলবে আটকুড়ো মৌলভি।
সারাদিনের দেহ মনে বেদনার্ত দিল বেজার বানু কাৎ হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই চোখে রাজ্যের ঘুমে নেসে আসে। জোর করে জেগে থাকতে গিয়ে কিছুক্ষণ এপাশ-ওপাশ করেছেন বোকার মতো। এতে মৌলভি আরও সচেতন হয়ে গেছে। আরও গভীর রাতে যখন ঘনরাত্রীর গাঢ় অন্ধকার ফ্যাকাশে হয়ে ওঠেছে। এমন সময় হঠাৎ করেই ঘুম ভেঙে যায় দিলের। মৌলভির হালকা চালের নাক ডাকার শব্দে সে নিশ্চিত হয় তিনি এখন ঘুমোচ্ছেন। মৌলভির ঘুম ভারী, গাঢ়। বিছানায় গা এলিয়ে দিলে আর খবর থাকে না। কিন্তু মৌলভি ধরে আছে ভান। স্ত্রীর প্রতিটি পদক্ষেপ তার সন্দেহ গাঢ় থেকে আশংকার তৈরি হচ্ছে। কিন্তু বোকা দিল তার কিছুই টের পায় না। দিল ঘুমিয়ে পড়ার পর মৌলভি ছেলের সঙ্গে স্থান পরিবর্তন করে নিয়েছে। ঘুমন্ত শাকুরকে সরিয়ে বিছানার প্রান্তবদল করে মৌলভি।
ঙ.
রাত ত্রিপ্রহরে, ঘুম ভাঙার পর দিল বেজার বানু বিছানা থেকে ওঠে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। পর্দা সরিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে আন্দাজ করলেন ফজরের আজানের কিছুক্ষণ বাকি আছে। এখনই রওনা দেয়া দরকার। এখন রওনা দিলে ফজরের আজানের সময় বাপের বাড়ি পৌছানো যাবে। বাপের মত ছেলে শাকুরেরও ঘুম ভারি। তাই খুব সতর্ক পায়ে দিল বেজার দরজার ছিটকানি খুলে দেয়। এবার সেগুন কাঠের আলনা থেকে বোরকাটা গায়ে চাপিয়ে বিছানার দিকে যায়। মৌলভির ঘুম ভেঙে যাওয়ার ভয়ে দিল বেজার বানু। সিথানে টিমটিম করে জ্বলা হারিকেনটি বড় করে না। আলো-আধারীর মধ্যেই বিছানার দিকে যায়। বিছানার যে পাশে শাকুর শুয়েছিল সে পাশে গিয়ে আলতোভাবে শাকুরকে হালকা ধাক্কা দিয়ে ঘুম ভাঙায়। তারপর দ্রুতপদে ঘর থেকে বেরিয়ে অতিসর্ন্তপনে বাইরের শিকলটি লাগিয়ে দেয়।
একটু আগে যখন ছেলের পাশাপাশি শুয়েছিল মৌলভি তখনকার ঘটনাগুলো ভাবে, আর মনে মনে হাসে। দিল বেজার বানু বিছানায় ফিরেই পাশে শোয়া শাকুর মনে করে বেটে মৌলভিকে গা ঝাকিয়ে ইশারা করে। কিরে নানা বাড়ি যাবি না? ঘুমের ভান ধরা বেটে মৌলভি পরিস্কার বুঝে ফেলে- দিল পালাচ্ছে। তখন সে দুইবার হু-হু করে? দিল পালানোর উত্তেজনায় সবকিছু ভুলে যায়। পোশাক-শারীরিক কাঠামো এবং আগাম পরিকল্পনার কারণে শাকুর আর বেটের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না। বউয়ের পালানোর ইশারায় পেয়ে সে মাথা নিচু করে বউয়ের পিছু নেয়। দরজাটা পার হয়েই টপ করে বউয়ের পিঠে চড়ে বসে। দিল বেজু ছেলের কাণ্ড দেখে বলে- বেটা হাঁটতেও পারবি না। তোর বাপ জীবনটা পুইড়া অঙ্গার করলো তুইও দেখি বাপের মতোই হইছিস। মাকে কষ্ট দিস। বলতে বলতে মৌলভির ভারী দেহটা নেড়ে চেড়ে কাঁধ ঝাঁকিয়ে পিঠের উপর ঠিকমতো বসিয়ে নেয়। বলে, তুই তো দেখি তোর আব্বাজানের চেয়েও ভারী। তারপর পেছন থেকে তার দুইপা নিজের কোমরের সঙ্গে পেছিয়ে ধরে হাটা দেয়। ছেলে সেজে পিঠে চড়া মৌলভি কোন শব্দ করে না। বরং ছেলের মত করে স্ত্রীর কাঁধের মধ্যে নিজের মাথাটি ফেলে দেয় ঘুমের ভান করে।
বেটে মৌলভি বিছানায় সরে শুয়ে ছিলেন স্ত্রীর গতিবিধি সম্পর্কে সতর্ক হতে। কিন্তু নিজের স্ত্রীর পিঠে ছেলের মতো চড়ে বসতে পারবে এটা কল্পনাও করতে পারেনি। যখনই স্ত্রী তাকে ছেলে মনে করে পিঠে তুলে নেয়- তখনই তাকে একটি রোমাঞ্চকর অনুভুতিতে পেয়ে বসে। দেখতে চায়- বেচারী শেষ পর্যন্ত কি করে। ঘুমের ঘোরে বেচারি বুঝতেই পারেনি। এমনকি দাড়িগুলোর অনূভূতিই টের পায়নি। এতে বেটে মৌলভি নিজেই বিস্মিত।
বেটে মৌলভি ছেলেকে খুবই আদর করে। প্রতিবার জামা বানানোর সময় একই কাপড় দিয়ে একই ডিজাইনে ছেলে শাকুরের জন্য ও জামা বানিয়ে নেয়। দুইজনের মাপও প্রায় একই। ফলে তারা বাপ-বেটা যখন কোথাও বেড়াতে যান তখন অনেকেই তাদের ভাই বলে ভুল করে। আবার দুইজনের বয়সের ব্যবধানও সে দ্বন্দ্বকে আরও জটিলতর করে তোলে। বেটে মৌলভি ও তার ছেলে শাকুরের কণ্ঠও প্রায় একই রকম। ফলে অনেক সময় আড়াল থেকে কথা বললে বাড়ির লোকজনও দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ে। এমন অনেকবার ঘটেছে যে, শাকুর মাদ্রাসা থেকে ফিরেই উঠোনে কারও সঙ্গে কথা বলছে- কিন্তু বেটে মৌলভি মনে করে দিল মাথার কাপড় টেনে দিয়েছেন। অন্যদের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। শাকুর তার আব্বাজানের শারীরিক গঠনটি না পেলেও পেয়েছে কণ্ঠটি।
বেটে মৌলভির সঙ্গে দিল বেজারের বিয়ে হওয়ার তেমন কোন যুক্তি ছিল না। কিন্তু অন্ধবিশ্বাস আর একটি অঙ্গীকারের কাছে পরাজিত হয়েছে যুক্তি। দিল বেজারের আগে ঠাণ্ডা মৌলভির আরও দুইটি মেয়ের জন্ম হলেও তারা খুব ছোটবেলাতেই মৃত্যুবরণ করে। কিন্তু ঠাণ্ডা মৌলভির একটির মেয়ের শখ ছিল। তাই তিনি দিল বেজারের জন্মের পর অঙ্গিকার করেছিলেন- মেয়েটিকে কোন আলেমের কাছে বিয়ে দেবেন। সে গরিব-গুর্বা, অন্ধ-খোঁড়া যাই হোক না কেন।
দরদি কণ্ঠের জন্য ছোট বেলা থেকেই সুনাম ছড়িয়ে পড়ে বেটে মৌলভির। ফলে মেয়ে দিল খোশ বানুর জন্য বিয়ের প্রস্তাব পেতেই একবাক্যে ‘হ্যাঁ’ করেছেন তিনি। একবার চিন্তা করার সময়ই পাননি তাদের শারীরিক অসামঞ্জস্যতা। বেটে মৌলভির কাছে তিনি মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। আর গোড়া মৌলভি বাড়ির মেয়ে হিসেবে পারিবারিক সম্মান দেখাতে গিয়ে সে বিয়েতে রাজী চুপচাপ সম্মতি দিয়েছিল দিল বেজার।
কারণ পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চি উচ্চতার সুঠামদেহী দিলের বিপরীতে চার ফিট উচ্চতার বেটে মৌলভির সামঞ্জস্যতা হয় না। এমনিতেই আদরের প্রতিবন্ধকতা তার উপর এ বৈষম্য তাদের সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে দাওয়াত কবুলের পথও সংকুচিত করে। তবে ঠাণ্ডা মৌলভি মেয়ের জামাই বেটে মৌলভিকে বিচার করে আধ্যাতিœক উচ্চতায়।
চ.
কৃষ্ণপক্ষের টানে চাদের আলো অনেকটাই ম্লান। আলোচ্ছায়ায় পথ স্পষ্ট দেখা গেলেও মাঝে মধ্যে গা চমকানো নানা শব্দ চারদিকে, পাখির ডানা ঝাপটানি। কোনটি পোকার আর কোনটি পশুপাখির। গাজির বিলের বুক চিড়ে সুখছড়ি নদীর পাশ ধরে মেটোপথ চলে গেছে টংকাবতী কুলে। টংকাবতী পার হলেই মল্লিক চোয়াং হয়ে পদুয়া। জিনপরীতে ভয় করে না দিলবেজার। ছোটবেলায় বাপের কাছে শেখা দোয়া দরুদগুলো এখনও তার মনে আছে। ছোটবেলা থেকে অনেকের মুখে শুনে আসছে- তার বাবা ঠাণ্ডা মৌলভি নাকি রাত বিরাতে ওয়াজ মাহফিল বা দাওয়াত শেষে ফেরার পথে বেয়াদবি করার অপরাধে বহু জ্বিনপরিকে এসব দোয়া দরুদ পড়ে অন্ধ ও বোতলবন্দী করেছে।
ছেলে হয়ে পিঠে চড়ে বসা বেটে মৌলভির ওজন নিয়ে আর হাঁটতে পারে না দিল বেজু। পিঠে ভার, মনে ভয়। দুইয়ে মিলে তাকে আরও বেশী কান্ত করে ফেলে। এই সেদিন বউ হয়ে এসেছে বেটে মৌলভির বাড়িতে। সেদিন কোলে করে দুধ খাইয়েছে শাকুরকে। দিনদিন বাড়ন্ত ছেলেটা দেখতে বাপের সময় হয়ে ওঠেছে। সুখছড়ির বাঁশঝাড় আর ডাল ছড়ানো কড়ই গাছের ঘন ছায়া মাড়িয়ে দিল বেজু হাঁটে আর ভাবে। কি ভাবে! কি ভাবে না? অতীত স্মৃতি ভাবতে ভাবতে তার মন ছুটে যায় অকল্পনীয় ভবিষ্যতে। শুধু কি সে? মৌলভির মনের মধ্যেও চলছে নানা ভাংচুর। কৌতুহল আর রহস্যের খেলা।
অদূরে টংকাবতী নদী। অন্ধকারের মধ্যেও আবচা আবচা নদীতীরের বাঁশঝাড়গুলো দেখা যায়। খানিকটা উত্তরদিকে লালবিন্দুর মত কি একটা জ্বলছে। দিল বেজু আন্দাজ করে নেয়, লালবিন্দুটি নিশ্চয়ই ঢাইরকূল মসজিদের মিম্বরের আলোকবাতি। বেজু শাকুরের পায়ে চিমটি দিয়ে বলে- শাকুর, ওঁ শাকুর। শাকুরের কোন সাড়া নেই।
পিঠের ভারে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে ঢাইলকূল এসে পৌঁছে দিল বেজু। ছেলেকে পিঠ থেকে নামিয়ে দিয়ে বলে, আর পারছি না বাবা। এবার হেঁটে চল। এখনো অনেক পথ।
কথাটি বলেই টেনে নিঃশ্বাস নেয় বেজু। মুহূর্তের মধ্যেই মুখের কাপড় সরিয়ে নিজেকে প্রকাশ করে বেটে মৌলভি। নিঃশ্বাস ফেলেই ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে দিল বেজু। ঘটনার আকস্মিকতায় যেন একখণ্ড পাথরে পরিণত হয়।
মৌলভি কথা বলে ওঠে- বৈতাল, রাতের আঁধারে পালাচ্ছিস। বললেই তো হতো, পাল্কিতে করে ঠাণ্ডা মৌলভির ঘরে পৌছে দিয়ে আসতাম। ঠাণ্ডা মৌলভির মেয়ে, বেটে মৌলভির বউ হয়ে পালাতে তোর বুক কাঁপলো না। মৌলভির গলায় কোমল তাচ্ছিল্যের সুর।
মুখ দিয়ে কোন শব্দ বেরুয় না বেজুর। পাথরের মতো মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে কাঁপতে থাকে। স্ত্রীর ভয়ার্ত কাঁপুনি দেখে মৌলভির মন নরম হয়। পরক্ষণেই আরেকটি নতুন কাণ্ড ঘটায় মৌলভি। আলগি মেরে উঁচু হয়ে দিল বেজুর গলাটা জড়িয়ে ধরে নাগালে আনে। চকাস চকাস করে দু’গালে চুমো খেয়ে বলে- এবার কোথায় যাবি? বাপের বাড়ি না লাঙের বাড়ি?
No comments:
Post a Comment