Saturday, March 9, 2013

মানবজমিন পরিবারের ৫ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন
স্টাফ রিপোর্টার: দৈনিক মানবজমিন পরিবারের সদস্যদের প্রকাশিত পাঁচটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়েছে। মোড়ক উন্মোচন করেছেন দৈনিক মানবজমিন প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী ও সম্পাদক মাহবুবা চৌধুরী। যুগ্ম সম্পাদক কবি সাযযাদ কাদিরের প্রবন্ধের বই ‘বাংলা আমার’ প্রকাশ করেছে প্রিয়মুখ প্রকাশনী। জয়তী প্রকাশ করেছে বার্তা সম্পাদক শামীমুল হকের রম্যরচনা ‘সবজান্তার দেশে’, সিনিয়র রিপোর্টার কাফি কামালের ভ্রমণকাহিনী ‘কুতুব মিনার থেকে কন্যাকুমারী’ ও গল্পগ্রন্থ ‘কন্যাযাত্রী’। কামরুল বুকস হাউস মেলায় এনেছে ওয়ান ইলেভেন-পরবর্তী গঠিত বিশেষ আদালতে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচার কার্যক্রম নিয়ে সিনিয়র রিপোর্টার কাজী সোহাগের বই ‘কাঠগড়ায় শেখ হাসিনা’। মোড়ক উন্মোচনকালে মতিউর রহমান চৌধুরী ও মাহবুবা চৌধুরী বইগুলোর বহুল প্রচার ও সাফল্য কামনা করেন। মানবজমিন কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এ মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে প্রধান প্রতিবেদক কাজল ঘোষ, জয়তীর প্রকাশক মাজেদুল হাসান ও মানবজমিন পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। অমর একুশে গ্রন্থমেলায় বইগুলো পাওয়া যাবে প্রিয়মুখ প্রকাশনীর ১১৬ এবং জয়তী’র ২৮২ নম্বর স্টলে। 

কাফি কামাল-এর গল্পগ্রন্থ ‘কন্যাযাত্রী’


‘কন্যাযাত্রী’
গল্প শুধু গল্পই নয়, ভিন্ন কিছু। কাফি কামাল গল্পচ্ছলে বর্ণনা করেন সময় ও সমাজের ঘটমান চিত্রমালা। যেখানে কেবল হাতের নিশানা পরীক্ষা করতেই নিরীহ ব্যক্তির প্রাণ কেড়ে নেয় দাঙ্গাবাজ। মাহফিলে ধর্ম বয়ান শেষে ঘরে ফিরে বউ পেটান দরাজ কণ্ঠের মৌলভী। দীর্ঘদেহী স্ত্রী বয়ে বেড়ান হ্রস্বদৈর্ঘ্য স্বামীর শরীর। কুড়িয়ে পাওয়া মুঠোফোন নাম্বারই কাল হয় কৌতূহলী তরুণীর। যেখানে বিয়ে বাড়িতে ধুমধাম, আনন্দ-উল্লাস নিষিদ্ধ। বরবিহীন বরযাত্রীর কাছে সঁপে দেয়া হয় কন্যা। বরযাত্রীর সঙ্গী হন কন্যাযাত্রী। যে দেশে নিত্য সমস্যার চিল-চিৎকারে ঝালাপালা হয়ে ওঠা কানে দেয়া হয় ভুভুজেলা চিকিৎসা। পোড়াবাড়িতে উড়ে আসে অজানা দানপত্রের দলিল। জমি দখলের দাঙ্গায় জড়িয়ে নিঃস্ব হয় সম্পন্ন গৃহস্থ। কাফি কামালের গল্প শুধু গল্প নয়, এ সময়ের জীবনছবি।
ভাষাতাত্ত্বিক স্বাতন্ত্রে চট্টগ্রামী
কাফি কামাল
ভাষা মানুষের গাত্রবর্ণের মতো। ভেতরে ভাবপ্রকাশের একই রঙের রক্তধারা বইছে, বাইরে বহুরঙের গাত্রবর্ণ হয়ে ফুটছে ভাষা। গাত্রবর্ণ যেমন সাদা, কালো, বাদামী, মিশ্র তেমন ভাষাও শব্দ-বর্ণে-উচ্চারণে স্বতন্ত্র। কিন্তু উদ্দেশ্য তো একটাই, ভাবপ্রকাশ। পৃথিবীতে হাজার হাজার ভাষার অস্তিত্ব বিদ্যমান। সৃষ্টির প্রথম পর্যায় থেকে মানুষের সংখ্যাবৃদ্ধি ও চারদিকে ছড়িয়ে পড়ার মাধ্যমে এসব ভাষার সৃষ্টি। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে পৃথিবী এখন ছোট হয়ে আসছে। এতে একদিকে মৃত্যু হচ্ছে একের পর এক ভাষার। অন্যদিকে মাত্র কয়েকটি ভাষাই প্রসার পাচ্ছে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ দেশের ভাষাই প্রচার-প্রসারে পাচ্ছে অগ্রাধিকার। যেমন: ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ, স্পেনিশ, জাপানী, আরবি... ইত্যাদি। উল্টোভাবে বললে, দরিদ্র দেশগুলোর ভাষা অব্যাহতভাবে সংকুচিত হয়ে আসছে। সে সব দেশের মানুষ অর্থনৈতিক উন্নতির লক্ষ্যে আয়ত্ব করছে উন্নত দেশের ভাষা, ভুলে যাচ্ছে মাতৃভাষা। বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের মুখের ভাষা এ যুক্তিকে গ্রহণযোগ্য করে তোলে। আবার রাষ্ট্রক্ষমতার নিয়ন্ত্রণের কারণে অনেকভাষা সংকুচিত ও মৃত্যুমুখে পতিত হয়। চট্টগ্রামী তেমন একটি ভাষা। রাষ্ট্রভাষা বাংলার প্রভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা বৃহত্তর চট্টগ্রামের ভাষাকে কোণঠাসা করে ফেলেছে। যেখানে মাত্র কয়েক হাজার লোকের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষাকে পূর্ণাঙ্গ রূপ সেখানে প্রায় কোটি লোকের মুখের ভাষা রক্ষার কোন উদ্যোগ নেই রাষ্ট্রের। উদ্যোগ তো দূরের কথা নূন্যতম শ্রদ্ধাবোধ, ভালোবাসাও নেই। নানামুখী প্রতিবন্ধকতার দেয়াল বন্দি হয়েও আপন স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের কারণে টিকে আছে চট্টগ্রামী। কিন্তু সম্ভাবনাময় এ ভাষাটির আয়ু কতদিন তা এখন প্রশ্নবোধক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চট্টগ্রামী ভাষাকে স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে স্বীকার করতে বড় দ্বিধা বাংলাভাষী পণ্ডিতদের। বাংলাভাষাভাষীরা তো বটেই। কিন্তু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য তো স্বীকৃতির ধার ধারে না। আপন বৈশিষ্ট্যই তাকে স্বতন্ত্র করেছে, টিকেয়ে রেখেছে। বাংলা ভাষায় নেই বা বিরল এমন বহুবৈশিষ্ট্যর অধিকারী চট্টগ্রামী। বাংলাভাষায় বিরল কিন্তু চট্টগ্রামীতে গুরুত্বপূর্ণ এমন বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে রয়েছে- উচ্চারণ বৈচিত্র্য, শব্দার্থ বৈচিত্র্য, শব্দায়ব সংক্ষেপ পদ্ধতি ও শব্দ যোজন রীতি।
ক. উচ্চারণ বৈচিত্র্য: চট্টগ্রামীর উচ্চারণ বৈশিষ্ট্য স্বল্পপরিসরে আলোচনা অসম্ভব। সপ্তমি বিভক্তিযুক্ত ও অসমাপিকা ক্রিয়ার ‘এ-কার’ লোপ পেয়ে শেষের বর্ণটি হসন্তযুক্ত হয়ে যায়। সপ্তমি বিভক্তিযুক্ত ও অসমাপিকা ক্রিয়ার ‘এ-কার’ লোপ পেয়ে শেষের বর্ণটি হসন্তযুক্ত হয়ে যায়। উদাহরণ- বাড়িতে>বাড়িৎ, ঘরেতে> ঘরৎ, নদীতে>নদীৎ। শব্দের শুরুতে ক, শ, ষ, স, থাকলে অনেক সময় ‘হ/অ/ফ’ বর্ণে রূপান্তরিত হয়। যেমনÑ কাকু>হাক্কু/আক্কু, কাজ>হাজ, কাগজ>হাগজ/হঅজ, শালী>হালি/আলি, শ্বশুর>হউর/অউর, ষাট>হাইট/আইট, শাক>হাগ/আক, সকল>হক্কল/অক্কর, সুতা>ফুতা... ইতাদি। একই শব্দ উচ্চারণের দীর্ঘ-হ্রস্বের কারণে অর্থ পাল্টে যায়। আনুনাসিক ব্যঞ্জনাও এ ভাষার একটা নিয়মিত ফলশ্রুতি। ‘মামু’ শব্দের সবগুলি স্বর আবার কেব ‘ম’ এই ডাকে এসে দাঁড়ায়, তখন বেকল তাতে আশ্চর্যই হতে হয়। চট্টগ্রামী ও চাকমা ভাষায় আন্তঃস্বরীয় অঘোষ ধ্বনি লুপ্ত হয়। চাকমা ভাষাকে স্বতন্ত্র স্বীকৃতি দিলেও চট্টগ্রামীর ব্যাপারে রয়েছে ভাষাবিদদের দ্বিধা।
খ. শব্দার্থ বৈচিত্র্য: বাংলা মান ভাষায় ব্যবহৃত একই শব্দ অনেক সময় চট্টগ্রামীতে এসে ভিন্ন অর্থ তৈরি করে। কোন বিশিষ্ট দীর্ঘভাবকে সুন্দরভাবে এক বা অল্পকথায় প্রকাশ করার বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে চট্টগ্রামীর। চট্টগ্রামীর শব্দার্থ বৈচিত্র্যের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে- প্রতিশব্দের আধিক্য। যেমন- ব্যথা= বিষ, চিচ্চিয়ানী, ধরপরানী, ইরইরানী ইত্যাদি। এখানে বাংলা ভাষায় জ্বর, কেটে যাওয়া, আঘাত পাওয়া সব ধরনের বেদনাদায়ক অনুভূতিকে ব্যথা একটি শব্দ দিয়ে প্রকাশ করতে হয়। কিন্তু চট্টগ্রামীতে কেটে যাওয়া, কাটা ফুটা, জ্বর, আঘাতসহ নানা বেদনাদায়ক অনুভূতি প্রকাশের জন্য একাধিক প্রতিশব্দ রয়েছে। শব্দার্থ বৈচিত্রের দিক থেকে বিচার করলে দেখা যাবে চট্টগ্রামী ভাষা ‘মান বাংলা ভাষা’ থেকে অনেক জায়গায় বেশ স্বতন্ত্র। এ স্বাতন্ত্র্যটুকু দু’ভাগে ভাগ করা যায়। (১) বাংলা মান ভাষায় ব্যবহৃত একই শব্দ চট্টগ্রামীতে এসে ভিন্ন অর্থ পায়। অবশ্য মান ভাষার শব্দ উপভাষায় গিয়ে অর্থ পরিবর্তনের বৈশিষ্ট্য পৃথিবীর প্রায় সব জীবন্ত ভাষায় পরিলক্ষিত হয়। উদারণ হিসাবে আমরা কয়েকটা শব্দের কথা চিন্তা করতে পারি। যেমন- ‘আঁতুর’ বাংলা মান এবং চলিত ভাষায় ‘আঁতুর’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘সূতিকাগৃহ’। কিন্তু চট্টগ্রামীতে এর অর্থ পরিবর্তিত হয়ে অর্থ পেয়েছে ‘খোঁড়া’। একইভাবে ‘আধার’ মানে হচ্ছে ‘স্থান, পাত্র’। কিন্তু চট্টগ্রামীতে ‘আধার’ এর অর্থ হয়ে গেছে ‘মাছের খাদ্য’। তবে চন্দ্রবিন্দুর ব্যবহারের ফলে আঁধার অর্থ পেয়েছে অন্ধকার। মান বাংলায় ‘ফুট’ অর্থ ’১২ ইঞ্চি পরিমিত পরিমাপ’। চট্টগ্রামীতে ‘ফুট’ শব্দের অর্থ হয়ে গেছে ‘কাদা’। বিষয়টি বাংলার ক্ষেত্রেও মাঝে মধ্যে প্রযোজ্য। হিন্দী ‘বাল’ যেখানে চুলের অর্থ প্রকাশ করে সেখানে বাংলায় অর্থ দাঁড়ায় গুপ্তকেশ। হিন্দী এ শব্দটি বাংলার মতো একই অর্থ প্রকাশ করে চট্টগ্রামীতেও।
প্রতিটি ভাষায় অন্য ভাষার বহু শব্দ নিজের অবস্থান করে নেয়। কখনও অনুপ্রবেশের মাধ্যমে, কখনও নিমন্ত্রিত হয়ে। চট্টগ্রামী ভাষাও ব্যতিক্রম নয়। এ ভাষায় নিজের অবস্থান পোক্ত করেছে আরবী, ফার্সি, উর্দু, হিন্দী, বাংলাসহ বহু ভাষার শব্দ। আলোচ্য বিষয় যেহেতু বাংলা থেকে চট্টগ্রামীর স্বতন্ত্র নির্ধারণ সেহেতু অন্যভাষার শব্দ গ্রহনে বাংলা এবং চট্টগ্রামের কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করছি। বাংলা যেখানে ভিন ভাষার বিকৃত রূপটি গ্রহণ করেছে সেখানে চট্টগ্রামী নিয়েছে হুবহু বা সামান্য বিকৃতটি। হিন্দী থেকেÑ চনা>ছোলা>চনাবুট>, বহিন>বোন>বইন, টাংগ>ঠ্যাং>ঠেং... ইত্যাদি। আবার বাংলা যেখানে মূলটি নিয়েছে সেখানে চট্টগ্রামী নিয়েছে বিকৃতটি। যেমন: ফারসী থেকেÑ য়খনী>আখনি>আন্নি, আওয়াজ>আওয়াজ>আবাজ, আরযু>আরজু>আজ্জু, যারযার>জরজর>যজ্জরাই (বিগলিত ধারায়), নাখানদাহ>নাখান্দা>নান্দা; আরবী থেকেÑ অক্বীক>আকিকা>আকিয়া, অক্কদ>আকদ>আক্ত, ছল্য); হিন্দী থেকেÑ হিন্দী থেকেÑ চরখা>চরকা>চরহা, চিটঠী>চিঠি>চিড়ি, ঠমক>ঠমক>ঠঅক, পরত>পরত>পরল... ইত্যাদি। আবার বাংলা যেখানে কোন শব্দ নিয়ে বর্জন করেছে বা নেয়নি তেমন বহু শব্দ হুবহু বা সামাস্য বিকৃত অবস্থায় আত্মস্থ করেছে চট্টগ্রামী। যেমন: হিন্দী থেকেÑ খাটা>খাট্টা (টক), দুলা>দুলা (বর), রুই>রুই (তুলা), কেয়াড়>কেবার (দরজা), ক্যা>কেয়া (কেন), গেঁহু>গেউ>(গম), গঁওয়ার>গোয়ার (একগুয়ে), ঘীরনা>ঘিরা (বেড়া), চরখা>চরহা, চান্দি>চান্দি (রূপা), চন্দওয়া>চাদোয়া (শামিয়ানা), চনা>চনাবুট (ছোলা), চারা>চারা (মাছের খাবার), চিটঠী>চিড়ি, ছিলকা>ছিলকা (গাছের ছাল), জও>জও (যব), জোলাহ>জোলা (তাঁতী), বহিন>বইন (বোন), টট্টি>টাট্টি, টাংগ>ঠেং, টোকরি>টুরি, টোনা>টোনা, টোপী>টুপি, ঠমক>ঠঅক, ডর>ডর, তরকারী>তরহারী, তানজাম>থানজাম (পাল্কি), থোড়া>থোরা, দঙ্গা>দাঙ্গা, দাদা>দাদা, দেরি>দেরি (বিলম্ব), দোনো>দোনো (উভয়ই), দহাই>দোয়াই (শপথ), নয়া>নোয়া (নতুন), পরত>পরল (ভাজ), পাতা>পাত্তা; আরবী থেকেÑ আক্কল>আক্কল (আক্কেল); ফারসী থেকেÑ আসূদহ>আছুদা, অয়ব>আয়েব, য়গানহ>এগানা, কুব্>কুব, গিরহ>গিরা, র্প> পরই>পাখা; তুর্কি- আপা>আপা, চিলমচি>চিলমচি, বহাদুর>বহাদুর, বুলাক>বুলাক>নোলক... ইত্যাদি। আবার কোন কোন শব্দের মূল অর্থটাই পাল্টে গেছে চট্টগ্রামীতে। যেমন: হিন্দী চুতিয়া শব্দের অর্থ মুর্খ কিন্তু চট্টগ্রামীতে চুতিয়া শব্দের অর্থ খারাপ লোক; হিন্দী ঠেস শব্দের অর্থ হেলান দেয়া কিন্তু চট্টগ্রামী মূল অর্থ যেমন নিয়েছে তেমনি নতুন অর্থ করেছে তাচ্ছিল্য করা; হিন্দী ঢীলা’র অর্থ শিথিল কিন্তু চট্টগ্রামীতে যার মাথা ঠিকমতো কাজ করে না, হিন্দী ধোলাই শব্দের মূল অর্থ কাপড় ধোয়াই নিয়েছে চট্টগ্রামী কিন্তু বাংলা নিয়েছে মারপিট অর্থে; হিন্দী পরখ শব্দের অর্থ পরীক্ষা কিন্তু চট্টগ্রামী নিয়েছে আলাদা অর্থে; ফারসী দরমিয়ান শব্দের মূল অর্থ মধ্যবর্তী কিন্তু চট্টগ্রামী নিয়েছে কোমরব্যাগ অর্থে, ফারসী নাখানদাহ অর্থ অনাহুত বা অপ্রিয় কিন্তু চট্টগ্রামী নিয়েছে অযোগ্য অর্থে; ফারসী নাদান অর্থ অবুঝ বা অজ্ঞান কিন্তু চট্টগ্রামী নিয়েছে পেটুক অর্থে; আরবী ইন্কার অর্থ অস্বীকার কিন্তু চট্টগ্রামী নিয়েছে আচ্ছিল্য অর্থে; আরবী খউফ অর্থ শঙ্কা বা ভীতি কিন্তু চট্টগ্রামী নিয়েছে স্বপ্ন অর্থে; বাংলা গম অর্থ একটি খাদ্যশষ্য কিন্তু চট্টগ্রামী নিয়েছে ভাল অর্থে। এরকম আরও অনেক শব্দ বাংলা মান চলিত ভাষা থেকে চট্টগ্রামী ভাষায় হুবহু এসে তাদের অর্থ পরিবর্তন করে ফেলে। আবার বাংলা যেখানে ভূঁই (জমি)’র মতো আপন শব্দ তাড়িয়ে দিয়েছে সেখানে চট্টগ্রামী তা আত্মস্থ করেছে।
(২) চট্টগ্রামীভাষার রয়েছে কোন বিশিষ্ট দীর্ঘভাবকে এক বা অল্পকথায় সুন্দরভাবে প্রকাশ করার ক্ষমতা। বাংলায় অল্পকথায় দীর্ঘভাব প্রকাশের শক্তি তেমনভাবে পরিলক্ষিত হয় না। চট্টগ্রামী ভাষা এ শক্তির উৎস নিয়ে ভাষাবিদদের মধ্যে ভিন্নমত রয়েছে। আর উদাহরণ স্বরূপ কিছু শব্দ দেয়া হলো যেগুলো অদ্ভুতভাবে সঙ্কুচিত হয়ে আশ্চর্য রূপে উদ্দিষ্টভাব প্রকাশ করে। যেমন: এই মুহূর্তে> ইত্তার, সেই সময়ের/তখনকার> এ্যাত্তিয়ার, যন্ত্রণায় ছটফট করা/মানসিকভাবে অস্থিরতা কাজ করা>কৈছালি (ছাই মেখে কাটাকুটির পর রুদ্ধ ইন্দ্রিয় কই মাছ যেমন ছট ফট করে, সে সঙ্কটময় অস্থির অবস্থা)। শুধু ‘কৈ’ এবং ‘ছালি’ এ দু’টি শব্দ মিলে এ অপূর্ব ভাবব্যঞ্জক শব্দের সৃষ্টি। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে চট্টগ্রামীতে একাধিক প্রতিশব্দ আছে। যেমন- ব্যথা। বাংলাভাষী একজন (জ্বর হলে, কাটা গেলে, ছিলে গেলে, পোড়া গেলে...) তার যন্ত্রনা বোঝাতে আগে-পরে (তীব্র ব্যথা, অল্প ব্যথা ইত্যাদি) যুক্ত করে ‘ব্যথা’ শব্দটি ব্যবহার করে। কিন্তু চট্টগ্রামীতে ধরপরার, ছৈটগরার, ধরহার, চিনচিনার, হোট মারের, ইরইরার ইত্যাদি প্রতিশব্দ দিয়ে যন্ত্রনার ধরণ ও তীব্রতা বোঝাতে পারেন। মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসী চট্টগ্রামের শ্রমিকদের চিকিৎসা নিয়ে জটিলতার কারণে চট্টগ্রামীভাষী চিকিৎসকদের উচ্চ বেতনে মধ্যপ্রাচ্যে নেয়া শুরু হয়।
গ. শব্দায়ব সংক্ষেপ: মান ভাষার দীর্ঘ বাংলা শব্দের সংক্ষিপ্ত অবয়ব বা শব্দায়ব সংক্ষেপ পদ্ধতি চট্টগ্রামী ভাষার আরেকটি বৈশিষ্ট্য। চট্টগ্রামবাসীদের উচ্চারণ-ত্রস্ততার কারণে এ রকম হয়ে থাকে। এ বৈশিষ্ট্যের পিছনে দায়ী কিছু ঐতিহাসিক কারণ। চট্টগ্রাম একটি বিখ্যাত সমুদ্রবন্দর। এ সমুদ্রবন্দরে নাও ভিড়িয়েছে পৃথিবীর বহুপ্রান্তের নাবিক, ব্যবসায়ী, ধর্মপ্রচারক, ভবঘুরে। তারা প্রত্যেকেই বয়ে এনেছেন নতুন শব্দ। তাদের সঙ্গে ভাব বিনিময় করতে গিয়ে চট্টগ্রামের সমুদ্রতীরবর্তী মানুষকে কসরৎ করতে হয়েছে ভিন্নভাষা ও শব্দ আওড়ানোর। এমনকি নিজের ভাষাটি তাদের মতো করে উচ্চারণ করে ভাবপ্রকাশের। এছাড়া প্রাচীনকাল থেকেই চট্টগ্রাম একটি ব্যবসা-বাণিজ্য কেন্দ্র। ব্যবসায়ীদের ধীরে সুস্থে কথা বলার মত অবসর হয় না। এ উচ্চারণ-ত্রস্ততার কারণে অর্জিত গুনের কারণে ভাষার দীর্ঘ শব্দের সংক্ষিপ্ত অবয়ব বা শব্দায়ব সংক্ষেপ পদ্ধতি তৈরি হয়েছে এ ভাষায়। এর কারণে দ্রুত কথা বলার তাগিদে শব্দায়ব সংক্ষেপ হয়ে যায়। যেমন: বৃহস্পতি> বিসিৎ, হরতকি> হট্টই, জোনাকি> জুনি, মঙ্গল>মঁল, আবদুল রহিম>আদ্দুরইম, মামা>ম, থামো>থিঅ.. ইত্যাদি। উচ্চারনের একটি দ্রুতি বা ধীর লয়ের কারণে পাল্টে যায় বহু শব্দের অর্থ। উদাহারণ দেয়া যায়- অ্যা, আ, অ্যা.. ইত্যাদি। আবার শব্দযোজন রীতির দিক থেকে চট্টগ্রামী বাংলার চেয়ে স্বতন্ত্র। বাংলাদেশের অন্যান্য আঞ্চলিক বা উপভাষার মত পরম্মুখ নয়। চট্টগ্রামীতে দুই বা একাধিক শব্দ মিলে সংক্ষিপ্ত নতুন শব্দ তৈরির গুন চট্টগ্রামীর উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। যেমন: উন্দি- ওই খান দিয়ে, ইন্দি- এই খান দিয়ে... ইত্যাদি। এছাড়া চট্টগ্রামী ভাষায় ঋণাত্বক পদ ক্রিয়ার আগে-পরে দুদিকেই বসে। যেমন: যাবো না> যাইতাম ন, যামু না>ন যাইয়্যম, খাবো না>হাইতাম ন, খামু না>ন হাইয়ুম... ইত্যাদি।
ঘ. শব্দযোজন রীতি: চট্টগ্রামী বাংলাদেশের অন্যান্য আঞ্চলিক বা উপভাষার মত পরম্মুখ নয়। চট্টগ্রামীতে অনেক শব্দ মিলে এক শব্দ হয়ে নিজেই একটি শব্দ সৃষ্টি ও অর্থ তৈরি করে। ..... । তাছাড়া শোষণ ক্ষমতা চট্টগ্রামীর এক বিশেষ সম্পদ। অন্যান্য ভাষার শব্দ ও প্রয়োগকে সে নিজস্ব নিয়মে আত্মস্থ করে নিতে পারে। এই গুণ সজীব সচল ভাষার; যেসব ভাষার এমন গুণ নেই বা ছিল না, তারা এখন মৃত। এ শোষণ ক্ষমতার কারণে চট্টগ্রামী আত্মস্থ করে নিয়েছে- বহু পর্তুগিজ, ইংরেজি, হিন্দী, আরকানি, সংস্কৃত, আরবী, উর্দু, ফার্সি, দ্রাবিড়ীয় পিল্লা, গুজরাটি শব্দ। হিন্দী থেকেÑ রুই>রুই (তুলা), ক্যা>কেয়া, গেঁহু>গেউ(গম), ঘীরনা>ঘিরা (বেড়া), চান্দি>চান্দি (রূপা), চনা>চনাবুট (ছোলা), জও>জও (যব), জোলাহ>জোলা (তাঁতী), টট্টি>টাট্টি, ঠেস>ঠেস, তানজাম>থানজাম (পাল্কি), দোনো>দোনো (উভয়ই), পাতা>পাত্তা; তুর্কি থেকে- আপা>আপা, চিলমচি>চিলমচি, বহাদুর>বহাদুর, বুলাক>বুলাক (নোলক); ফারসী থেকে- আসূদহ>আছুদা (পরিতৃপ্ত), অয়ব>আয়েব (ত্রুটিধরা), য়গানহ>এগানা, কুব্>কুব, গিরহ>গিরা (কাপড়ের মাপ), দরমিয়ান>দরমিয়ান (মধ্যবর্তী/কোমরব্যাগÑঅর্থপাল্টে), নাদান (অবুঝ,অজ্ঞান/পেটুক- অর্থপাল্টেছে), র্প> ফইর (পাখা); আরবী থেকে- ইন্কার>ইংকার (অস্বীকার/আচ্ছিল্য), য়াদ>ইয়াদ, ইরাদহ>এরাদা, ইলাজ>এলাজ, ক্ববালহ>কবলা, গুরবা>গরবা, ফুলানো>ফলানা, ফারগ>ফারক, বয়জা>বজা, তযীম>তাযিম>সমাদর, তুফান>তুয়ান; ক্ষেমারজাত শব্দ- গম (ভালো), লাঙ (ভাতার); বার্মিজ থেকেÑ লঙ্গি (অর্থসহ মূল উচ্চারণ), থাই (অর্থসহ মূল উচ্চারণ)... ইত্যাদি।
আইরিশ ইংরেজি ও মূল দ্বীপের ইংরেজিতে খানিকটা ব্যকরনী ভেদও দু®প্রাপ্য নয়, তেমনি বাংলা উপভাষাতেও চট্টগ্রামী বাংলায় বাক্যগঠন রীতি অপর প্রান্তীয় ভাষা রংপুরী বাক্যগঠন রীতির সাথে মিললেও (আঁই ন যাই/না জাঁও মুই ইত্যাদি) এই পদক্রম রীতির ঐতিহাসিক সংরক্ষণ অন্য কোনও উপভাষায় দুর্লভ। অধ্যাপক ড. মনিরুজ্জামান তার ‘উপভাষা চর্চার ভূমিকা’ গ্রন্থে বলেন, ‘চট্টগ্রামীর অক্ষর-ঝোঁক, হ-উহ্যতা এবং আন্তঃস্বরীয় ব্যঞ্জন ধ্বনির লোপ বা দ্বিত্বতা ও তৎসহ শব্দগঠনে সংকোচন সংক্ষেপন প্রবণতাই বাংলাদেশের অপরাপর উপভাষা থেকে একে পৃথক করেছে। ... চট্টগ্রামীকে পৃথক উপশ্রেণীভুক্ত করার যুক্তি এই উপভাষার মধ্যেই নিহিত: ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যে পূর্ববঙ্গীয় উপভাষা থেকে তার পার্থক্যটি স্পষ্ট। যথা, স্পর্শ ক, প এর উষ্মী এবং ঘোষী রূপ, আন্তঃস্বরীয় ব্যঞ্জন লোপ, আন্তঃস্বরীয় নাসিক্যব্যঞ্জন লোপে পূর্বস্বরের সানুনাসিকতালাভ, শব্দের মাত্রা বা অক্ষরভাগের সংকোচন, ক্রিয়ার পূর্বে নিষেধাত্মক অব্যয় যোগ, এবং প্রাচীন (ধৎপযধরপ) কিছু শব্দ (ও শব্দরূপের) সংরক্ষন বা ব্যবহার প্রবণতাÑ প্রভৃতি এ ভাষাকে বিশিষ্ট করেছে। যাইহোক, পূর্ববঙ্গীয় উপভাষার সাথে এর মিলও আছে বহু ক্ষেত্রে, তন্মধ্যে অপি’র ব্যবহার প্রধান।’ ড. মনিরুজ্জামান তার উপভাষা চর্চার ভূমিকা গ্রন্থে লিখেছেন- ‘বাংলা ভাষার উপভাষাগুলির মধ্যে সিলেট, নোয়াখালী ও চাঁটগার উপভাষা কিছু স্বাতন্ত্রের অধিকারী। সিলেটি ভাষা ‘টানের’ দিক থেকে, নোয়াখালি দ্রুততার দিক থেকে ও চট্টগ্রামের ভাষা স্বরধ্বনি বহুলতা ও শব্দ সংকোচন বা সংক্ষেপিকণের দিক থেকে আবার ভিন্ন। ... অনুমান করা যায় যে, সিলেট ও নোয়াখালি ভাষা অপেক্ষা চট্টগ্রামের ভাষায় সংঘাত এসেছে প্রচুর। সংঘাত বলতে আমরা একটি নদী-বন্দর কেন্দ্রে ও তার পশ্চাৎ ভূমিতে ভাষা-সংযোগ (খধহমঁধমব পড়হঃধপঃ) ঘটিত পরিবর্তন ও ঋণায়ন তথা (অংংরসরষধঃরড়হ, ফরংংরসরষধঃরড়হ, পড়হঃধসরহধঃরড়হ) ও ধ্বনি-অভিঘাত প্রাপ্তির অন্যান্য কারণও ঘটনাকেও বুঝবো। ধ্বনি-উচ্চারণগত প্রক্রিয়ায় বাধা না দিয়ে ধ্বনিগঠনে একটা ‘বিলোপ-পন্থা’ও সম্ভবত একটা (নু-ঢ়ৎড়ফঁপঃ) হিসাবে এখান থেকেই জন্ম লাভ করে থাকবে। তাই এ ভাষায় (ঊঁঢ়যড়হরপ পড়সনরহধঃরড়হ, উড়ঁনষরহম ংড়ঁহফ ওহঃৎঁংরাব ংড়ঁহফ) (প্রবেশি দ্রুতধ্বনি) বড় মোহকারী। Ñএ্যাত্তর (এতই), কঁত্যে (কখন), কডেত্তন (কোথা থেকে), কইন্য পার (কইতে পার না), কিয়েল্যাই (কিসের লাগিয়া), শতান শতীন্যা (শয়তান বা শয়তানী) প্রভৃতি উদাহরণ আনা যেতে পারে। স্থানের নামে, সময়ের উল্লেখে, প্রিয়বস্তুর নির্দেশে এমনকি রেগে গেলে সাধারণ কথাতেও এই ‘বিলোপ-পন্থা’ দ্রুত কাজ করে। ফলে বাগধারায় ‘ধ্বনি’ বিচিত্র রূপে ক্রিয়া করে কিন্তু শেষ ‘ধ্বনিগুন’ ক্রমে ভাবানুসঙ্গতায় নির্দিষ্ট হয়ে যায়। বিশেষ শব্দের ধ্বনি বিশেষ ধ্বনিগুনের অধিকারী- সিলেটির মত যে কোন বাক্যের প্রথম ও শেষ শব্দের টান রাখার নিয়ম এখানে অচল, কিংবা নোয়াখালির মত কতকগুলি অব্যয় ধ্বনি সংযোগও এখানে বৃথা। কৃতঋণ শব্দের মত কিছু প্রাচীন শব্দ (এমনকি পোশাকী শব্দ) এ ভাষায় বহুল ব্যবহৃত, কিন্তু বাগধারার বিপুল স্রোতে তার স্থান এ ভাষার খেয়াল মত হয়ে থাকে। বহু সংস্কৃত ও হিন্দী শব্দ এ ভাষা ঘোট পাকিয়ে ও নানা ছদ্মরূপে এ ভাষায় অবস্থান করছে। অথচ অন্যান্য উপভাষায় মূল শব্দের আদি উচ্চারণ ঠিক থাকে, পরবর্তী উচ্চারণেই শুধু বিকৃতি ঘটে থাকে। চট্টগ্রামের ভাষা সম্ভবত এই কারণেই রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। বাইরে থেকে কোন বাঙালীর পক্ষেই এই ভাষা বোঝা বা আয়ত্ত করা খুব সহজ নয়। প্রফেসর ড. মনিরুজ্জামান লিখেছেনÑ ‘আঞ্চলিক ভাষারই যদি লেখ্যরূপ গড়ে ওঠে (যেমন জাপান) তবে তার সমৃদ্ধি সকলকে ছাপিয়ে যায়। চট্টগ্রামের ভাষা সবাইকে ছাপিয়ে উঠতে পারে নি, তবে স্বতন্ত্র হতে পেরেছে। ধ্বনি উচ্চারণের নিয়ম, শব্দসৃষ্টি ও কৃতঋণ শব্দের ব্যবহার এবং বাক্য গঠনের বিভিন্ন পর্যায়ে এদের অনুসরন সাধারণ বাঙালির পক্ষে আজ দুঃসাধ্য। কিছু উদাহারণ সংযোগে এই উপযোগীতার কথা উল্লেখ করা যাক। ইংরেজিতে এর চাটগোঁয়ে- ‘আঁই ন যাই’। রূপতত্ত্বের দিক থেকে বাক্যগঠনের এই ভঙ্গিটি তাৎপর্যপূর্ণ। প্রদেশের উপভাষায় ‘আমি’ বড় জোর ‘আমি-এ’ অর্থাৎ অন্তঃস্বরের ভঙ্গি একটা থাকে, আবার থাকেও না। (উল্লেখ্য, ঐতিহাসিক শব্দটি বহুবচন এবং মহাপ্রাণান্তিক ছিল।)’
চট্টগ্রামীকে সবাই বাংলার উপভাষা বা আঞ্চলিকভাষা বলে চালিয়ে দেন। হিন্দী এবং উর্দুর মধ্যেও এক সময় এমন যুদ্ধ ছিল। বাংলা ভাষায় আরবী ফারসী তুর্কী হিন্দী উর্দু শব্দের অভিধান-এর ভূমিকায় সম্পাদক কাজী রফিকুল হক লিখেছেনÑ আঠারো শতকে উর্দু গদ্য ‘হিন্দী’ নামে এবং উর্দু কবিতা ‘রিখ্তা’ নামে পরিচিত ছিল। হিন্দী ও উর্দুুর মধ্যে রেষারেষি ছিল উনিশ শতকের শেষার্ধ পর্যন্ত। এখন এখন দুইটি ভাষায় পরস্পরকে স্বতন্ত্র বলে স্বীকার করে নিয়েছে। একথাও সত্য যে, চট্টগ্রামের ভাষা মূল ভাষা থেকে বিচ্ছিন্ন হবার সুবিধা পেয়েছে ঢের অথচ আপন নিয়মকে প্রকাশ করতে গিয়ে হাতের উপাদানগুলিকেই ব্যবহার করেছে বেশি। শিষ্ট ভাষার বিকল্পে সৃষ্ট এই ‘নব ভাষা’ ক্রমে ক্রমে তার ভঙ্গিকে পরীক্ষামূলক অবস্থা থেকে অনেকদূরে নিয়ে এসেছে। চীন-কোরিয়া থেকে সরে যেতে জাপানী ভাষা অথবা জার্মান থেকে সরে যেতে ইংরাজি ভাষারও বোধহয় এমনি সুবিধা ছিল। চট্টগ্রামের ভাষার তুলনায় আমাদের অন্যান্য উপভাষায় অর্জিত রূপের প্রতিষ্ঠার সাধনা অল্প।

Saturday, May 19, 2012

খুন
কাফি কামাল

বৃষ্টি ঝরছে। সদ্য বিধবা তরুণীর বউয়ের মতোন। ফুপিয়ে ফুপিয়ে বিরতীহীন। বৃষ্টির এমন আচরণে ভেতরের বিরক্তিটা ধীরে ধীরে রাসে রূপান্তর ঘটছে মুন্নীর। চৈত মাসের মরিচের মতো। 
কথা ছিল মুন্নী আর মিঠু সিনেমা দেখতে যাবে। বেইলী রোডের সাগর পাবলিসার্সের সামনে থেকে তারা অটোরিক্সা ধরবে। কিন্তু অকারণ বৃষ্টি ঝামেলা পাকিয়ে দিয়েছে। ঘড়ির কাটা চারটার ঘর পেরিয়ে গেছে। বৃষ্টি থামছে না। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে পাশে শাড়ীর দোকানে আশ্রয় নিয়েছে মুন্নী। অনেকক্ষণ ধরে শাড়ি নেড়ে চেড়ে দেখছে মুন্নী। কিছুক্ষন পর পর হাতঘড়ির দিয়ে এক পলকে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছেন। মনে মনে উদ্ধার করছে হৃদয়ের চৌদ্দগোষ্ঠী। বাইরে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। জল আর যানজটে একাকার হয়ে গেছে বেইলী রোড। হঠাৎ বৃষ্টি নামায় ক্রেতার সংখ্যা এমনিতেই কম।
এতক্ষণে খেয়াল করল দোকানের ছেলেটা তার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে। ছেলেটি কি মুন্নীকে অন্যরকম কিছু ভাবছে। আশপাশে কোন রেস্টুরেন্টও নেই যে সেখানে বসে। তাই বারবার ফোন করছে মিঠুকে। কয়েকবার সে জবাব দিয়েছে- হোয়াইট হাউজের সামনে বৃষ্টিতে আটকা পড়েছে। ছাতা নেই, রিক্সাও মিলছে না। একই কথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে, নানা ভঙ্গিতে। আর এখন রিংও ধরছে না। তাই সমস্ত রাগ জমছে বৃষ্টির ওপর। কবি কালিদাসের ওপরও। তিনি কাব্য করতে গিয়ে মেঘকে বানিয়েছিলেন ‘দূত’। কিন্তু এখন বৃষ্টি তার জীবনে এনেছে বিচ্ছেদের ঘটঘটা। বৃষ্টি কি রসিকতা জানে!
অনেকক্ষণ পর মুন্নির মোবাইল বেজে উঠে। স্ক্রিনে ভাসছে মিঠুর ছবি। কি বলবে সেÑ আবার সে ফ্যানফানানি? একটু অপেক্ষা করো জান। বৃষ্টি কমলেই আসছি। স্যরি... ইত্যাদি। দেরি করেই ফোন রিসিভ করে মুন্নি, বলো। ছোট্ট জিজ্ঞাসা।
আমি বাসায় ফিরছি।
মানে! মুন্নির কণ্ঠে বিস্ময়।
বাসায় জরুরি তলব। নিশ্চিত কোন ঝামেলা।
তাহলে আমি? এবার অসহায়ত্ব ফুটে উঠে মুন্নির কণ্ঠেÑ বলার মতো কোন কথা খুঁজে পায় না। দীর্ঘ দুইঘন্টা অপেক্ষার পর মিঠুর এমন কাণ্ডে কিইবা বলার থাকতে পারে। কিন্তু তাকে কিছুই বলতে হয় না। ওইপ্রান্ত থেকে লাইনটি কেটে গেছে।
অঘোর বৃষ্টির মধ্যে এমন একগুয়ে পরিবেশে তাকে অপেক্ষায় রেখেছে পাক্কা দুইঘন্টা। এখন দেখা না করেই পালিয়ে যাচ্ছে বাসায়। অথচ তিনদিন ধরেই মোবাইলে অনুনয়-বিনয়। তোমাকে নিয়ে সিনেমা দেখতে ইচ্ছা করছে। আগের দিনে নাকি কপোত-কপোতীরা চুপিচুপি একসঙ্গে সিনেমা দেখতো। আমারই তোমাকে নিয়ে... জানো, বসুন্ধরা সিনেপ্লেক্সে চলছেÑ ...। দুপুরে বেইলী রোডে আসবে কিন্তু। এখন বলছে কিনা, বাসায় জরুরি তলব!
মুন্নীর মনে সন্দেহ উঁকি দেয়। মিঠু কি হঠাৎ শায়লার ফোন পেয়েছে? ঝালঝোল রেস্টুরেন্টের ঘটনাটি তার মনে পড়ে। সেদিন ফার্মগেটের ঝালঝোল রেস্টুরেন্টে বসে আড্ডা দিচ্ছিল। হঠাৎ একটি ফোন পেয়ে মিঠু হন্তদন্ত হয়ে টেবিল থেকে উঠে দুরে গিয়ে কথা বলে। মুন্নী তাৎক্ষনিক কোন প্রতিক্রিয়া দেখায় না। মিঠু যেচে বলে- ভাই রিং দিয়েছিল। কিন্তু সে যখন ওয়াশ রুমে গেল তখন মুন্নী রিসিভ কলের নাম্বারটি টুকে নিল। রাতে ফোন করতেই ভেসে এলো একটি নারীর কণ্ঠস্বর। কৌশলে অন্য আরেকজনকে খুঁজতেই মহিলা বললেন- তিনি শায়লা, চাকুরি করেন। মুহুর্তেই যা বোঝার বুঝে নিয়েছে মুন্নী। কিন্তু বিষয়টি বেমালুম চেপে গেছে মিঠুর কাছে। আজকালের ছেলে মেয়েরা একাধিক সম্পর্ক রাখে। কিন্তু কেউ একজন শক্তভাবে চেপে ধরলে অন্যগুলো হারিয়ে যায়। কিন্তু আজ মিঠুর আকস্মিক সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে মুন্নীর সন্দেহ গাঢ় হয়।  
মোবাইল আবারও বেজে উঠে। স্ত্রিনে মিঠুর ছবি ভাসছে। বাজছে, বেজেই যাচ্ছে। মুন্নির রিসিভ করতে ইচ্ছে করছে না। কিছুক্ষণ পর রাগ করেই কলটি রিসিভ করলো সে। চুপচাপ...।
ওইপ্রান্ত থেকে মিঠু বলছে- রাগ করো না জান। কাল-পরশু সুযোগ করে আবার বেরুবো। এবার বাসায় চলে যাও।
মুন্নি বিরক্ত হয়ে রিং কেটে দেয়ার আসে বললো- হা করে থাকো।
কী অদ্ভুত! মিঠুর সঙ্গে কথা শেষ হতে না হতেই একটি খালি রিক্সা চোখে পড়লো মুন্নির। মুহূর্তেই ভুলে গেলো সে কোথায়। বাচ্চা মেয়ের মতো ডাক দিলে- এই রিক্সা।
চোকরা রিক্সাওয়ালা ঘুরে দোকানের সামনে এনে দাঁড় করায়। ভিজে একসা চোকরাটির থুতনি চুইয়ে ঝরছে অবিরল বৃষ্টিজল। তার মুখে কথা নেই, চোখে প্রশ্ন ভাসে- কোথায় যাবেন?
যাবে, ওয়ারলেস মোড়?
চোকরা মুখে কথা ফুটে না। ইশারায় রিক্সায় উঠতে বলে।
মুন্নি অনেকক্ষণ ধরে একগুয়ে পরিবেশ থেকে মুক্তি খুঁজছিল। তাই দরদাম না করেই হুড়মুড়িয়ে রিক্সায় চড়ে বসে। তাতেই বৃষ্টির ছাট ভিজিয়ে দিয়েছে তার ত্রিপিস। বৃষ্টির ঠাণ্ডা জল এখন কাপড় ভেদ করে শরীরে আলপিনের মতো বিঁধছে।
রিক্সা যখন মগবাজার ডাক্তার গলির মুখে পৌছালো ততক্ষণে বৃষ্টির তীব্রতা কমে এসেছে। মুন্নি হাতের পার্স খুলে দুইটি দশটাকার নোট বের করে আনে। হঠাৎ একটি নোটে তার দৃষ্টি আটকে যায়। সুন্দর হস্তাক্ষরে লেখা ‘প্রেম চাই’। নিচে একটি মোবাইল নম্বর। মুহূর্তেই কী এক কৌতুহল কম্পন তুলে তার নিউরণে। সে পাল্টে আরেকটি নোট রিক্সাওয়ালাকে দেয়।
ছোকরাটি গুনেও দেখে না। কোমরে গুঁজে রাখা পলিথিনের প্যাকেটে ঢুকিয়ে রিক্সা টান দেয়।
মুন্নি বাসায় ফিরতেই মা প্রশ্ন করে। এত দ্রুত ফিরলি যে, অনুষ্ঠানে যাসসি?
না মা, যাইনি।
এতক্ষণ কোথায় ছিলি? পাল্টা প্রশ্ন মায়েরÑ
বৃষ্টিতে আটকে পড়েছিলাম মৌচাকে।
বৃষ্টির দিন ছাতা নিলি না যে? রাবেয়া খাতুনের জিজ্ঞাসার যেন অন্ত নেই।
এতক্ষণ টানা বৃষ্টি হবে কে জানতÑ বলেই কথা না বাড়িয়ে মুন্নি নিজের কামরায় চলে যায়। মাত্র ক’ফোটা বৃষ্টি পড়েছে শরীরে। তাতেই শীত শীত লাগছে। দ্রুত কাপড় পাল্টে সে দুপুরের ঠাণ্ডা খাবার খেয়ে অসময়ে শুয়ে পড়ে।
সেদিন রাতে মুন্নীর মোবাইলটি অবিরত বেজে যায়। স্ক্রিণে মিঠুর নায়কোচিত ছবিটা যেন আর্তনাদ কর্ েকিন্তু মুন্নীর রাগ কমে না। ইচ্ছে করে মোবাইল সেটটি আচড়ে গুড়ো করে ফেলে। অনেক কষ্টে রাগ চেয়ে সে মিঠুর সঙ্গে সম্পর্কের দফারফা করার সিদ্ধান্ত নেয়। মেসেজ অপশনে গিয়ে তিন অক্ষরের ‘বাই’ শব্দটি লিখে পাঠিয়ে মিঠুর নাম্বারটি ব্লক করে দেয়।

রোববার দুপুর থেকে শুক্রবার দুপুর। একশ বিশ ঘন্টা পেরিয়ে গেছে। কিন্তু মুন্নীর মন থেকে রাগের ব্যথা সারছে না। পুরোনো ক্ষতের মতো থেকে থেকে জেসে উঠছে। কখনো অকাল বৃষ্টির উপর কখনো মিঠুর ওপর সে রাগ কালবোশেখীর ঝড়ের মতো বইতে থাকে। এরই মধ্যে অন্য নাম্বার থেকে একাধিকবার রিং দিয়েছে মিঠু। কিন্তু তার গলা শুনলেই মুন্নীর রাগের মাত্রা বেড়ে গেছে অবুঝের মতো। বৃষ্টি বা অপেক্ষা নয়, হঠাৎ বাসায় তলবের কথায় তার রাগ জমেছে। যে রাগের সহজ ক্ষরণ নেই।
দুপুরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে এলোমেলো ভাবতে থাকে মুন্নী। মিঠুর মুখটি চোখে ভাসে। রবিনের মুখটিও ভাসে। কলেজের আড্ডায় একবারে নির্জ্ঝাণ্ট ছেলেটি। হঠাৎ করে মোবাইল নাম্বার লেখা দশটাকার নোটটির কথা মনে পড়ে তার। পার্স থেকে ভাজ করা নোটটি বের করে আনে। তারপর কয়েকবার চোখ বুলায়। একবার মনে হয়- বোগাস। আরেকমন বলে- যেখানে দেখিবে ছাই...। মুন্নী ম্যাগাজিনে পড়েছে এরকম টাকা বা এখানে ওখানে পাওয়া নাম্বার থেকেই অনেক সম্পর্ক হয়েছে। এমন সব এলোমেলো ভাবতে ভাবতে সে সাহস করলো। সরাসরি ফোন করা নিরাপদ নয়। ক্ষুদেবার্তা পাঠানো যাক আগে। ভুল লোকের হাতে পড়লে কৌশলগতভাবে এড়িয়ে যাওয়া যাবে। বুড়ো হাবড়ার এবড়োথেবড়ো হৃদয়ে ঢুকে পড়লে ভুলে বলে সরে আসা যাবে।
ঘোরের মধ্যেই মুন্নী ক্ষুদেবার্তাটি লেখে- ‘দরজা খোলো’।
পরমুহুূর্তেই জবাব আসবে তা সে ভাবেনি। কিন্তু তাই হলো। পিলে চমকানো প্রশ্নের অতিক্ষুদ্র উত্তর- ‘কে’? মুন্নীর ভেতরটায় উতাল-পাতাল শুরু হয়ে গেল। মনে হচ্ছে- ব্যস্ত কেউ। ধুরন্ধর। কত কিছু...। ঘোরের মধ্যেই ক্ষুদেবার্তার লেনদেনে মেতে উঠলো দুইজন। কেউ কাউকে সরাসরি রিং দিচ্ছে না। কৌতুহল আর জমিয়ে তোলার মজাটা যখন তুঙ্গে উঠছে তখনই- বিরক্তি প্রকাশ করলো ওই নাম্বার। ক্ষুদে বার্তায় প্রকাশ পেল সে বিরক্তি। মুন্নী ছেড়ে দেয়ার পাত্রী নয়। আধার গেলা মাছ কে নিয়ে নিয়ে যেন শিকারী খেলা করছে।

বিশ্রামবার দুপুরে তাজমহল রোডের বাসা থেকে বেরিয়ে সংসদ ভবনের দিকে হাঁটছে মঞ্জু। মানিকমিয়া এভিনিউতে তার জন্য প্রেমিকাকে নিয়ে অপেক্ষা করছে তার স্কুল বন্ধু আশিক। আসলে তার প্রেমিকাকে দেখার লোভেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটছে মঞ্জু। লোকাল বাসের ভেতর চিড়ে-চ্যাপ্টা হওয়ার অস্বস্তি এড়াতে তার এ পদযাত্রা। যানজটে আটকে পড়া বাসের ভেতর মানুষের নানা ভঙ্গির মুখ। মেয়ে মানুষের আচল উড়িয়ে বাতাস খাওয়ার দৃশ্যে ফুটে ওঠছে গ্রীষ্মকাল। মঞ্জু সেসব উপভোগ করতে করতে চলছে আনমনে, কিন্তু দ্রুত।
ঘড়ির কাটা যখন চারটার পাথর ছুই ছুই করছে তখনই সে পৌছালো আসাদ গেটে আর বেঁজে ওঠলো মোবাইলের মেসেজ টোন। মনে মনে কষে একটি গালি দিলো আশিককে। শালা, প্রেমিকা নিয়েও সময় কাটে না। কিন্তু কি ভেবে যেন প্যান্টের চাপা পকেট থেকে মোবাইলটি বের করে। স্ক্রিনে ভেসে আছে একটি অচেনা নাম্বার। রবীন্দ্রনাথ কোম্পানীর। মঞ্জুর নিজের নাম্বারটিও একই কোম্পানীর। তাই থমকে দাঁড়িয়ে দু’সেকেন্ডের মধ্যেই মেসেজ অপশনে ঢুকে পড়ে।
দ্রুত পড়ে নেয়- দু’বাক্যের ছোট্ট মেসেজটি।
‘দরোজা খোলো’।
মজার তো! অপরিরিচত নম্বর। বলছে- দরোজা খুলে দিতে। মঞ্জুর মাথায় ধরে না। কে দিতে এমন ক্ষুদেবার্তা? সে তো দরোজায় তালা লাগিয়ে এসেছে। কেউ তার সঙ্গে দেখা করতে এলে তো দরোজায় তালা ঝুলতে দেখবে। চোখের মাথা খেয়েছো শালা। মঞ্জু মনে মনে গালি দেয়।
সেই সঙ্গে মনের ঘোরে ফিরতি বার্তাও লিখে- কে?
কয়েক মুর্হূতের মধ্যে ফিরতি ক্ষুদেবার্তার টোন বেজে উঠলো। এবার আরও সংক্ষেপে- ‘আমি’।
মঞ্জু কিছুটা বিরক্তি আর খানিকটা কৌতুহলী হয়ে পুনর্বার বার্তা ব্যাক করে। এক শব্দ বাড়িয়ে- ‘আমি কে রে বাবা?’
‘এসএমএস...’
‘কি চাও?’
জানতে চাইÑ ‘কেমন আছো?’
এবার কৌতুহল মিশ্রিত রাসে সে ফিরতি বার্তা পাঠায়- ভালো, ভালো এবং ভালো।
ক্ষুদেবার্তা আদান-প্রদানের ঘোরের মধ্যেই মঞ্জু মানিকমিয়া এভিনিউ ধরে সংসদের দক্ষিণচত্বরে পৌছালো। ঘোরটা কাটিয়ে দিলো একটি ‘সংসদ সদস্য’ স্টিকার সাটানো প্রাডো।
হার্ড ব্রেক কষে চালক পলকে সাইটগ্লাস নামালেন। মঞ্জু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সেদিকে তাকাতেই কড়া একটি ধমক এসে বিদ্ধ করে তাকে।
ওই মিয়া চোখের মাথা খাইছেন?
মঞ্জু কথা বাড়ায় না। অপরাধীর ভঙ্গিতে পাশ কাটিয়ে সামনে এগোয়। আকস্মিক সে বিব্রতবোধ করে। আশিক বা তার বান্ধবী দেখে ফেলেনি তো আবার। তারা এ ধমক খাওয়ার বিষয়টি দেখে ফেললে লজ্জ্বার মধ্যে পড়ে যাবে সে। তাই সে চোরা চোখে বন্ধু জুটির অনুসন্ধান করে। না কোথাও দেখা যাচ্ছে না। তখন তার মনে প্রশ্ন- তাহলে কি এখনও তারা এসে পৌছোয়নি?
মানিকমিয়া এভিনিউ’র উত্তরপাশে সংসদ আঙ্গিনার প্রান্তরেখায় বকুল গাছের সারি। ফুটপাতে ফুলে ফলে ভরা পাম গাছের সারি। গাছের নিচে ফুলের রেনু। সংসদমুখী হয়ে সে বকুল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে আশিক আর ইশা। নামেই অন্তমিল। মঞ্জু আগেই তাদের দেখে ফেলে। ভালোই তো! মেয়েটির পেছন দিকটা দেখে আনমনে মন্তব্য করে বসে।
মঞ্জু কাছে গিয়ে ডাক দেয়- আশিক। কখন এলি?
এই তো কয়েক মুহূর্ত। তা তুই শালার আসার সময় হলো এখন। মোহাম্মদপুর তাজমহল রোড থেকে মানিকমিয়া এভিনিউ আসতে এত সময় লাগলে, সম্রাজ্য রক্ষা করবি কেমনে?
না তোকে একটু বেশী সময়ই দিলাম।
মঞ্জু মৃদু হাসে। তখন পাশের চা ওয়ালার কেটলিতে গরমপানির বাষ্প উড়তে শুরু করেছে।

শুক্রবার দুপুর থেকে মুন্নীর মনটা বেশ ফুরফুরা। প্রজাপতির মতো উড়ছে। কিন্তু বুঝতে পারছে না কার সঙ্গে তার ক্ষুদেবার্তার লেনাদেনা চলছে। মানুষ কখনো কখনো এমনসব তুচ্ছ ঘটনায়ও আনন্দে উদ্বেল হয়। আবার অনেক বড় ঘটনায়ও হাসি লুকোতে ঠোঁট চেপে রাখে। রবিবার দুপুরে কলেজ থেকে ফেরার পথে গাড়ি বসেই একটি বার্তা পাঠায় সে নাম্বারে।
‘কই? কেমন?’
বার্তাটি পাঠিয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে সে। কিন্তু কোন সাড়া শব্দ নেই। কি হলো? ব্যস্ত নাকি বিরক্ত? ভাল লাসে না। কৌতুহল মজে আসে, উত্তর আসে না। বাসায় ফিরে খাওয়া-দাওয়া সেরে বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছিল মুন্নী। তখনই ফোনটি বেজে ওঠে। ক্ষুদেবার্তার রিং টোন। মুন্নী দেখে- যথাপ্রশ্ন তথা উত্তর। ‘রেখেছো যেমন!’
দ্রুত ফিরতি বার্তা লেখে সে- ‘মানে?’
উত্তর আসে- ‘দুর থেকে...’
মুন্নীর দুষ্টুমি জাগে- ‘কাছে আসবো?’
উত্তর আসে- ‘কেন নয়?’
মুন্নী হেয়ালী করে- ‘আসবো আমি তোমার কাছে স্বপ্নের মতো।’
উত্তর আসে- ‘কখন?’
মুন্নীর হালকা চাল- ‘জ্বালাবো তোমায় মিসকলের মতো, যখন তখন...’
উত্তরে নির্লিপ্ততা ‘তাই...’
মুন্নীর আকাঙ্খা- ‘সারাক্ষণ বাজবো তোমার মনে টোনের মতো।’
উত্তরে সারল্য ‘ভালো...’
মুন্নী লেখে- ‘আমাদের ভালোবাসা ফুরোবো নাÑ ব্যালেন্সের মতো।’
উত্তর আসে- ‘হা হা হা’

সেদিন বিকালে বান্ধবীদের সঙ্গে টিএসসিতে গিয়ে গিয়েছিল মুন্নী। সন্ধ্যায় ফেরার সময় কলেজের বন্ধু রকিবের সঙ্গে এক রিক্সায় চড়ছিল। অন্য দুই রিক্সায় তার বান্ধবীরা। ইস্কাটনের সব্জিবাগান পৌছার পর তাদের রিক্সাটি পাশ কাটিয়ে যায় মিঠু। বন্ধুর বাইকে করে ধানমণ্ডি যাচ্ছিল সে। চকিত দৃষ্টিতে সে দেখে মুন্নী একটি ছেলের সঙ্গে রিক্সায় গল্প করতে করতে ফিরছে। দেখেই তাকে মনে মনে কষে গালি দেয় মিঠু- শালি পল্টিবাজ। সে জানে মুন্নীর দিন রাতের রুটিন। তাই রাতে বাসায় ফিরেই অন্য নাম্বার থেকে তাকে ফোন দেয়। রিং ধরতেই মিঠুর রাগ ঝরে পড়ে- শালি মরদ পাল্টাও না। তোমার নতুন মরদকে দেখে নেব।
শুনেই শব্দ করে হেসে ওঠে মুন্নী। আর বলেই লাইনটি কেটে দেয় মিঠু।

রবিবার দুপুরে শুয়ে শুয়ে রূপচর্চার বইটির পাতা উল্টাচ্ছিল মুন্নী। এ সময় মোবাইল বেজে উঠে। ওই নাম্বার থেকে একটি ক্ষুদেবার্তা এসেছে। খুবই ছোট্ট- ‘কই?’।
মুন্নী বুঝতে পারে পাখির ডানা ঝাপটানি শুরু হয়েছে। অপেক্ষা করছে তার ক্ষুদেবার্তার। পুরুষ মানুষ এরকমই। তুচ্ছতার মাঝেও মহৎ কিছু খুঁজে। মনে মনে হাসতে হাসতে সে উত্তর দেয়- ‘দিচ্ছি’।
মুহুর্তেই জবাব আসে- ‘কখন?’
এবার মুন্নীর দুষ্টামীর খেয়াল চাপে- ‘সকালে দু’বার।’
জবাব আসে- ‘ওফ!’
মুন্নী কৌতুহল বাড়ায়- ‘দুপুরে দ্বিগুন।’
জবাব আসে- ‘বলো কি!’
মুন্নী লেখে করে- ‘বিকালে অসংখ্যবার।’
জবাব আসে- ‘সত্যি!’
মুন্নী লেখে- ‘রাত্রে একাকার।’
জবাবে আসে- ‘ওহ্’
মুন্নী লেখে- ‘এমন ঋণী করবো...’
জবাব আসে- ‘কেমন?’
মুন্নী লেখে- ‘শোধের সুযোগ পাবে না।’
জবাব আসে- ‘কিন্তু কি দেবে, জান?’
মুন্নী লেখে- ‘মিসডকল।’
এ প্রথম ‘জান’ শব্দটি লিখলো মঞ্জু। সহজে এমন অন্তর্গত শব্দটি ব্যবহার করে নিজেই লজ্জ্বা পেল। আর বিছানায় শুয়ে শুয়ে মুন্নী হাসে। নিরবে। আহা, পুরুষের মন। 

সকালে মায়ের সঙ্গে নাস্তা তৈরি করছিল মুন্নী। তখনই মোবাইলটি বেজে উঠলো। মেসেজ টোন কানে আসতেই কলজেটা ধক করে উঠলো তার। তাহলে কি রহস্যময় নে নাম্বার থেকে? কিন্তু মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে অন্যজিনিষ। সাতসকালে মোবাইল কোম্পানীর প্যাকেজ সুবিধার বিজ্ঞাপন। মুন্নী রহস্যময় নাম্বারকে লেখা মেসেজের কথা রাখে। পরপর দু’টি মিসকল দেয়। একটু অপেক্ষা করে দেখে কোন সাড়া নেই।
দুপুরে সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে মায়ের সঙ্গে টিভি দেখছিল মুন্নী। বড়লোকের পারিবারিক কুটনামি নিয়ে গন্তব্যহীন ধারাবাহিকটি তাদের খুব পছন্দের। সেখানে বাড়ির বড় মেয়েটি গোপনে প্রেমিকের কাছে ফোন করতে গিয়ে ধরা পড়েছে চাচির কাছে। মেয়েটি চেপে যাওয়ার চেষ্টা করছে আর চাচি কুটনামি করার একটি উপলক্ষ পেয়ে মনে মনে ফন্দি আটছে। তখন মুন্নীর রহস্যময় নাম্বারের কথা মনে পড়ে। গুনে গুনে চারটি মিসকল দেয়। কিন্তু শেষ কলটি মিস থাকে না মিসেস হয়ে যায়। মঞ্জু ধরে ফেলে। মুন্নী কাটতে গিয়ে দেখে এক সেকেন্ড ব্যয় হয়ে গেছে।
অফিসে অডিট চলছে। কিন্তু কিছু খরচের সঠিক তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। প্রধান হিসাব রক্ষক বিদেশ থাকাকালে এসব খরচ হয়েছে। ফলে হিসাবটা উপ-হিসাব রক্ষকেরই দেয়ার কথা। কিন্তু তিনি ধুনপুন করছেন। এ নিয়ে দুইজনের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে। কিন্তু মধ্যখান থেকে সবচেয়ে জুরিয়র হয়েও মঞ্জু জড়িয়ে পড়েছে। সেদিন সকালে প্রধান হিসাবরক্ষক জামিল সাহেব তাকে উপ-হিসাবরক্ষকের কক্ষে পাঠিয়েছেন। ওইসব কাগজপত্র আনতে। মঞ্জু কথাটি তোলতেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন উপহিসাবরক্ষক রবিন সাহেব। তাকে জামিল সাহেবের দালাল বলে বকাঝকা শুরু করে। জবাব দিতে গেলে সেটা তর্কাতর্কিতে গড়ায়। রবিন সাহেব মঞ্জুকে দেখে নেয়ার হুমকি দেয়।
এমন মনখারাপের সময়ে রহস্যময় নাম্বারটি থেকে উপযুর্পরী মিসকল দিতে থাকলে মঞ্জু খানিকটা বিরক্ত হয়। সব মুহুর্তে সবকিছু আনন্দ দেয় না। সে বিরক্তি নিয়েই রিংটি ধরতে গেছে। কিন্তু এক সেকেন্ডের মাথায় কেটে দিয়েছে ওইপ্রাপ্ত থেকে। রাসে ফোনটি টেবিলের উপর আচড়ে ফেলে ক্যান্টিনে সিগারেট টানতে যায় সে। বহুদিন ধরে এটাই যেন তার টেনশন কমানোর ঔষুধ হয়ে উঠেছে। জোরে কয়েকটি টান দিলেই মাথাটা কেমন ফাকা ফাকা হয়ে যায়। তবে তার আধুনিক (আমরা ধুমপান নিবারণ করি) বন্ধু সাজিদ বলে- আসলে নেশা মানুষের নিউরণকে দূর্বল করে। আর বোকা মানুষ সেটার অনূভূতি নেয়ার চেষ্টা করে। যাকগে...।

সময় তো হাওয়ার মতো। হাল্কা ছোয়া দিয়ে অগোচরে বয়ে যায়। সময়ের হাত ধরে মুন্নীর অগোচরে মিসকলগুলো মিসেস কল থেকে অবশেষে পোয়াতি হয়ে উঠে। সপ্তাহ ব্যবধানে জমে উঠে আলাপ। সকাল-সন্ধ্যা। বেলা-অবেলায়। রাতের আলাপ লতায় পাতায় দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে। পরস্পরের ভেতর-বাহির শিমুল তুলোর মতো ফেটে পড়ে। ফুলে ফেপে বাতাসে ছড়িয়ে যায়।
তবে আলাপের প্রারম্ভকালে কৌতুহল চেপে রাখতে পারে না মঞ্জু। মুন্নীর কাছে জানতে চায়- আপনি আমার নাম্বার পেলেন কোথায়?
কোন নাম্বার পাওয়া কি কঠিন?
সেটা অবশ্যই কঠিন না। তবে আমার মতো তুচ্ছ কেরানীর নাম্বার কোন উচ্ছল তরুনীর মোবাইলে ঢুকে পড়া তো কিছুটা হলেও আশ্চর্যজনক।
ধরুন নাম্বারটি এমনি আমার মোবাইলে ঢুকে পড়েছে।
সেটা কি করে হয়!
এই যে আমাদের মধ্যে যেভাবে আলাপ জমে উঠলো।
তা ঠিক, তবে ...।
আচ্ছা ঠিক আছে- আপনি কি কখনো কোটিপতি হওয়ার স্বপ্ন দেখেছেন?
হ্যাঁ, তবে আকাশ কুসুম।
তাহলে নিশ্চয় কুইজের ব্যাপারে আগ্রহ আছে।
হ্যাঁ কিছুটা তো অবশ্যই।
তাহলে দিলাম চারটি অপশন। বেছে নিন আপনার উত্তর।
কুইজ: ক. ম্যাগাজিন খ. পার্কে ইউকিপটাস গাছ গ. টাকা ঘ. অন্য ভিজিটিং কার্ড বা কোথাও।
মঞ্জু বুঝে উঠতে পারে না। প্রায় নানা রকমারী ম্যাগাজিন সে উল্টে দেখে। কিন্তু কখনো কোন ম্যাগাজিনে তো সে কিছু লেখেনি যে মোবাইল নাম্বার ছাপা হবে। তাহলে অপশন ‘ক’ বাদ। মুন্নী ঢাকার মেয়ে। ফলে সে ঢাকার কোন পার্কে পেতে পারে। কিন্তু পার্কে মাঝে-মধ্যে ঢু মারলেও কখনো গাছে কিছু লেখেনি মঞ্জু। তাহলে অপশন ‘খ’ বাদ। টাকায় তো কোন কিছু লেখার প্রশ্নই আসে না। ফলে অপশন ‘গ’ও বাদ। তাহলে রইল অন্যান্য। কিন্তু অন্যান্যের মধ্যে কি হতে পারে? মঞ্জু এলোপাতাড়ি স্মৃতি হাতড়াতে থাকে। সহসা মনে পড়ে না। মনে সন্দেহ জাগে। তাহলে কি দুষ্টামি করে তার বন্ধু বা পরিচিত জনের মধ্যে কেউ এ অকাজটি করেছে? হঠাৎ মনে পড়ে- টাকা। সে প্রায় আধঘন্টা পর জবাবে দেয়- ‘গ’ ।
গেলোবার ঈদের বাড়ি ফেরার সময় একবাণ্ডিল ব্যাংক পাড়ায় দীর্ঘলাইনে দাঁড়াতে তাকে কিন্তু ঈদের দিন ছোট বাচ্চাদের হাতে নতুন নোট তুলে মধ্যদিয়ে আনন্দ ভাগাভাগি করার আগাম সুখে তার সে লাইনে দাঁড়ানো। চাচা মহিতুলের সঙ্গে। মহিতুল তাকে বুকে জড়িয়ে জিজ্ঞাসা করে- কাকু কেমন আসিস। তবে সবার আসে তোর ফোন নাম্বারটা দে।
না না একটি কার্ড হলেও দে। মঞ্জু পকেট হাতড়ে দেখে মানিব্যাসে তার কার্ড নেই। চান্দরাতে নানাজনকে দিতে দিতে শেষ হয়ে গেছে। পকেট হাতড়ে দেখে কাগজও নেই। তখন সে একটি দশটাকার কড়কড়ে একটি নোটের ওপর মোবাইল নম্বরটি লিখে দেয়। মহিতুল নম্বরের অতিরিক্ত একটি নোট পেয়ে হাসে।
মঞ্জুর মনে পড়ে। কিছুটা বিস্মায়াভূত হয়। তাহলে কি সে টাকাই মানুষের হাত-পকেট ঘুরতে ঘুরতে মুন্নীর কাছে এসে পৌছেছে। হতেও পারে!
রাতে মুন্নীর সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ আলাপ করে মঞ্জু। লোডশেড়িংয়ের কারণে ঘরে ভ্যাপসা গরম। দরোজা খোলা রেখেই বিছানায় গা এলিয়ে দেয় সে। মুুহুর্তেই দু'চোখে রাজ্যের ঘুম নেমে আসে। চোখের পাতা দু'টো মেলে রাখতে পারে না। এমন এক ক্লান্তিঘোরের মধ্যে সে ঘুমিয়ে পড়ে।
সকালের আমেজ না কাটতেই তাজমহল রোডের গন্ধবিলাস বিল্ডিংয়ে কৌতুহলী মানুষের একটি জটলা জমে উঠে। পুলিশ আসে। ক্যামেরা আর বুম হাতে সাংবাদিকরাও আসে। বাড়ির পাঁচতলায় উত্তর পাশের ফ্লাটের একটি ঘরে সাবলেট থাকতেন মঞ্জু নামের একটি ছেলে। একটি কোম্পানীতে সহকারি হিসাবরক্ষকের কাজ করতো। গতরাতেও তাকে যথাসময়ে বাসায় ফিরতে দেখেছে বাড়ির দারোয়ান। কিন্তু ছেলেটি আর নেই। রহস্যজনকভাবে খুন হয়েছে। সকালে রান্না করতে এসে কাজের বুড়িটি দেখে বিছানায় অসাড় পড়ে আসে ছেলেটি। তখন সে হৈ চৈ শুরু করলে বিল্ডিংয়ের ও আশপাশের লোকজন ছুটে এসেছে। কিভাবে খুন হলো, কেন খুন হলো, কারও সঙ্গে ঝগড়া ছিল কিনা- চারদিকে মুহুমুর্হু প্রশ্ন। কিন্তু কোন উত্তর নেই। ধারণা করছে সবাই- চিকন রশি জাতীয় কিছুর মাধ্যমে ফাঁস দিয়ে তাকে হত্যা করা হয়েছে।
ফ্লাটের মালিক থাকেন যশোরে। ব্যবসার প্রয়োজনে মাসে দু’চারবার ঢাকা এলে বাসায় থাকেন। অন্যসময় মঞ্জু একেলাই থাকেন ফ্ল্যাটের একপাশের আলাদা একটি ঘরে। দারোয়ানকে ইতিমধ্যেই কয়েকদফা জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। কিন্তু উল্লেখযোগ্য কোন তথ্য বের করতে পারেনি। ফলে আটক করে থানায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে কাজের বুড়ি মহিলাটিকেও। ফ্ল্যাটের মালিককে খবর দেয়া হয়েছে। বেলা সাড়ে এগারোটার দিকে লাশ মর্গে পাঠিয়ে দেয় পুলিশ।

সকালে কয়েকবার মঞ্জুকে ফোন করেছে মুন্নী। কিন্তু প্রতিবারই একই উত্তর- ‘আপনার ডায়ালকৃত নাম্বারে সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।’ সময় কাটছে না। ডিসলাইনে সমস্যা দেখা দিয়েছে। রাত থেকে টিভিও দেখা যাচ্ছে না। মাঝে-মধ্যে এরকম করে। তাই অনেকদিন পর আজ সকাল থেকেই মায়ের সঙ্গে বাড়ির ছোটখাট কাজে হাত লাগাচ্ছে।
সকাল থেকে আকাশ চমৎকার ফর্সা। বাইরে তেজি রোদ। মুন্নী মনে মনে ঠিক করে বিকালে বেইলী রোডের দিকে আড্ডা দিতে যাবে। কিন্তু হঠাৎ একটি দখিন হাওয়া সেটাও মাটি করে দেয়। হাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নামে বৃষ্টি। দুপুর থেকেই অঝোর ধারায় সৃষ্টি ঝরছে। আকাশের মন খারাপ? নাকি মেঘগুলো প্রসব বেদনায় ঝরে ঝরে পড়ছে! আষাঢ়ে বৃষ্টি বড্ড একঘেয়ে। একবার নামে তো থামতে চায় না। এমন বৃষ্টিতে বাইরে বেরুনে কঠিন। বৃষ্টিতে ভেজা নিশ্চিত। গলির মধ্যে হাঁটুপানি, রাস্তাঘাট জলে টইটম্বুর। কিন্তু বাসায় বসে থাকতেও ভালো লাসে না। মনে বসে না। মুন্নী বান্ধবীদের সঙ্গে প্রায় ঘুরে বেরুয়। মার্কেটে মার্কেটে ঘুরে বেড়ায়। কোথায় কোন ডিজাইনের পোষাক এসেছে, কোথায় কোন গহনা ইত্যাদিতে তাদের কৌতুহল। তারা এটা ওঠা দেখে দরদাম করে। কিন্তু কিনে না তেমন কিছুই। টুকটাক কালে ভদ্রে। দোকানীর হাকানো দামের এক পঞ্চমাংশ দাম করে বিক্রেতাকে নিরুৎসাহিত করে। ঝাঁক বাধা মেয়ে তরুনীদের ঘাটাতে যায় না বিক্রেতারা। তবে দোকানের কর্মচারীরা সুযোগ পেলেই মশকরা করে কথা বলে। যতসব ছোকরার দল।
বিকালের দিকে বৃষ্টিটা একটু থেমেছে। ভেজা কাকগুলো ইলেকট্রিকের তারে বসে ডানা ঝাপটে শরীর শুকিয়ে নিচ্ছিল। ঠিক তখনই মুন্নীর মোবাইলে একটি রিং আসে। রিং ধরে মোবাইল কানে তুলতেই একটি মহিলার কণ্ঠ ভেসে আসে। মিলা কেমন আছো? মুন্নী বুঝতে পারে রং নাম্বার। কিন্তু মহিলা কণ্ঠে যেন স্নেহ ঝরে পড়ে। তাই সে উত্তর দেয়- জ্বি আমি শিলা নই। ওই প্রাপ্ত থেকে আরও দরদী কণ্ঠের জিজ্ঞাসা- কে শানু? মুন্নী হেসে বলে- নানা আমি শিলা-শানু নই, মুন্নী। ওই প্রান্তে থেকে মহিলা এক নিঃশ্বাসে বললেন- কিন্তু এ নাম্বারতো আমার ভাগ্নি শিলার, মগবাজারে বাসা। এবার খানিকটা বিরক্ত হয়েই মুন্নী বলে- দেখুন আমি আপনার ভাগ্নি না। তবে আমাদের বাসায়ও মগবাজারে। ওই প্রান্ত থেকে মহিলার কণ্ঠে হতাশার সুর ভেসে আসে- স্যরি, কিন্তু আপনাদের বাসাটা কোথায় বলবেন? মুন্নী বিরক্তির সুরেই বলে- ডাক্তার গলি, অট্টভিলা। সরি‌্য, বলেই লাইনটি কেটে দিলেন ওই প্রান্তের মহিলা।

ফোনটি রেখে দম নিতে পারেনি মুন্নী। বড়জোর কয়েক মিনিট। হঠাৎ দরোজায় টোকা পড়লো। সে দৌড়ে দিয়ে আইহোলে চোখ রেখে দেখে বাইরে কয়েকজন যোয়ান নারী-পুরুষ। অনেকটা কৌতুহলী হয়েই মুন্নী দরোজা খুলে। কিন্তু তার সে কৌতুহল স্থায়ীত্ব পায় না। প্রথমেই কড়া প্রশ্নÑ মুন্নী কে?
অবাক হয়েই সে প্রশ্ন-উত্তরে একাকার করে ফেলেÑ কেন আমি। কি ব্যাপার? আপনারা কারা?
আমরা বিশেষ বাহিনীর লোক। আপনি দ্রুত ব্যবহারের কিছু পোষাক নিয়ে আমাদের সঙ্গে চলুন।
মুন্নী হতবিহ্বল হয়ে প্রশ্ন করে- কোথায়?
ইতিমধ্যে তার মা রোশরানা বিবিও মেয়ের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। তিনি আগন্তুক শক্ত পেশীর নারী-পুরুষগুলোর কাছে জানতে চায়Ñ আমার মেয়ে কোথায় যাবে?
তাদের সংক্ষিপ্ত উত্তর- থানায়।
এবার মা-মেয়ে কিছুটা ভেঙে পড়ে প্রশ্ন করে- কেন?
কোন উত্তর না দিয়েই আগন্তুক এক মহিলা মুন্নীকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন ছুড়েÑ মঞ্জুকে চেনেন?
মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে, ঢোক গিলে বলে- চিনি।
পাল্টা প্রশ্নÑ কাল রাতে তার সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা হয়েছে না?
মুন্নী আবার মায়ের মুখের দিকে তাকায়। দেখে মায়ের মুখে বিস্ময়। কিন্তু তার মুখ দিয়ে মিথ্যা আসে না। মুন্নী জবাব দেয়Ñ হ্যাঁ।
এবার আগন্তুক পুুরুষদের একজন বলে- কাল রাতে সে খুন হয়েছে।
কথাটি শেষ না হতেই মা-মেয়ে আর্তনাদ করে উঠেÑ খুন!

kafi_bd80@yahoo.com


ভুভুজেলা
কাফি কামাল

চারদিকে এত আর্তনাদ! মানুষের মুখে মুখে, ঠোঁটের ডগায়। বুক কাঁপে, মনে ভয় জাগে। কোথাও কি খারাপ কিছু ঘটলো? কেউ কি হারিয়ে গেলো? নাকি ভিনগ্রহের কোন প্রাণীদল নেমে এলো আমাদের নগরে। ঢুকে পড়লো মানব সন্তানের দেহ-মনে, শিরায়-শিরায়। অনবরত ভোঁ ভোঁ শব্দে কি ভয়ংকর তাদের আর্তনাদ! উচ্চস্বরে হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের স্বস্তি। বাচ্চাদের কৌতুহলময় আনন্দ। যারা নববর্ষে উদ্যানে এসেছিল তারা কানে আঙুল দিয়ে হাঁটছে।
একদিন সন্ধ্যায় বাল্যবন্ধু ডাকুয়ার অফিসে গিয়ে খোকনের চোখে পড়ে হলুদ রঙের একটি ভুভুজেলা। আলমিরার উপর যতœ করে রাখা। খোকনের একদম অপছন্দের জিনিষ। বাজে শব্দসৃষ্টিকারী একটি পরিযায়ী যন্ত্র। আফ্রিকার মানুষ যেমন বদখত, তাদের আবিস্কৃত যন্ত্রটির শব্দও তেমন উগ্র-বিশ্রী। লোকে বলে আফ্রিকানরা নাকি বোকা এবং রাগী হয়। তাই তারা এসব যন্ত্র ব্যবহার করে। ভুভুজেলাটি দেখিয়ে ডাকুয়াকে খোকন বলেÑ কি আজেবাজে জিনিষ রেখেছিস অফিসে। ডাকুয়া মুচকি হাসে। এরপর বহুবার ডাকুয়ার অফিসে গেছে খোকন। কখনো ওই ভুভুজেলা নিয়ে বাক্যব্যয়ের আগ্রহ হয়নি। ডাকুয়াও হয়তো ভুলে গেছে খোকনের ভুভুজেলা এলার্জির কথা। 
রাতে মেসে ফেরার সময় গলির মোড়ের টং দোকানে থেমেছিল খোকন। রুটি আর কলা দিয়ে রাতের খাবারটা সেখানেই সেরে নিয়েছে। পাশেই খোশমেজাজে গল্প করছিল কয়েকজন। আজকাল গালগল্প ভালো লাসে না। নিজের জীবনটাই তো হঠাৎ গল্পের করুণ কাহিনী হয়ে উঠেছে। কানে এলো, একজন বলছে- বিরোধীদলের কোন নেতা যেন হাওয়া হয়ে গেছে। প্রতিবাদে আগামীকাল হরতাল ডেকেছে তারা। দিনটা একেবারে মন্দা যাবে। তাই ভাবছি ইলিশ-খিচুড়ির গন্ধে বাসাতেই সময় কাটাবো। খোকনের মন কিছুটা কৌতুহলী হলেও শরীর তাকে টেনে নিয়ে যায় মেসে।

সকালে বাসা থেকে বেরিয়েই একটু অবাক হয়েছিল খোকন। হরতালের কারণে রাজপথে গাড়ি নেই। হঠাৎ করেই যেন রাজধানীর ক্লান্তিকর যানজট উধাও। এমন খোলামেলা পরিবেশ এক মুহুর্তের জন্য তার মন ভালো করে দিয়েছিল। কিন্তু একটি চাকুরির খোঁজে তাকে নানা জায়গায় ধর্ণা দিতে হবে। মতিঝিল ব্যাংক পাড়া থেকে গুলশানের অফিস পাড়া, কত জায়গায়। মোহাম্মদপুর থেকে এগুলো কাছে পিঠে না। গাড়ি ছাড়া কোথাও যাওয়ার উপায় নেই। কাছে কেবল ধানমণ্ডিতে ছোটবেলার বন্ধু ডাকুয়ার সেল্ফমেইড অফিস। কুরিয়ার সার্ভিসের এজেন্ট। চাকরি-বাকরি দেয়ার ক্ষমতা নেই। কিন্তু সেখানে গেলে চা-সিঙ্গাড়া মিলে। আন্তরিকতার সুরে খোঁজ-খবর নেয়। এটাই বা কম কি। ঘোরের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে খোকনের চোখের পর্দায় সেলুলয়েডের ফিতার মতো ভেসে উঠছে দিনগুলো। যখন সে একটি প্রাইভেট ফার্মে ভালো বেতনে চাকরি করতো। অফিসে নিজের একটি ডেক্স, আরামদায়ক চেয়ার, এসির বাতাস আর মাস শেষে চেক কাটার ব্যাংক হিসাব। ভালোই কাটছিল দিনগুলো। স্ত্রী জিনাত বানু আর কন্যা ঊর্মিমালাকে নিয়ে শহর প্রান্তে একটি ছোট্ট সংসার।
একেবারেই আকস্মাৎ। বোশেখী হাওয়ার মতো সবকিছু উড়িয়ে নিয়ে গেছে খোকনের। সম্পর্কের ডালপালা ভেঙে, স্বচ্ছলতার লকলকে বেড়ে উঠা চারাগাছটি উপড়ে, দিনদিন চারিয়ে উঠা স্বপ্নটা দুমড়ে মুচড়ে একাকার করে দিয়েছে। সে এখন হতাশার ডিঙিতে ভাসছে দুঃস্বপ্নের অকুল পাথারে। কয়েক মাস আগেও সে ছিল স্বপ্নবান, আত্মবিশ্বাসী, স্বচ্ছল একজন পুরুষ।
অনেকদিন ধরেই চারপাশের মানুষগুলো পুঁজি মোহনার গল্পে কানভারি করছিল। চারপাশের গুঞ্জন- পুঁজি মোহনায় ইলিশের ঝাঁক ছুটে বেড়াচ্ছে। জালের খোপ মারো আর তাজা তাজা ইলিশ ধরো। ব্যাংক হিসাবে তখন আট বছরের চাকরি জীবনের জমানো ছয়লাখ টাকা অলস ঘুমোচ্ছে। খোকন কোন বিচার-বিশ্লেষন ছাড়াই দ্বিধা উড়িয়ে পুঁজি মোহনায় ঝাঁপিয়ে পড়লো। চোখে তার কোটিপতি হওয়ার স্বপ্ন, মন তার উড়–উড়–। তারপর দিন কাটে তো রাত কাটে না। শেয়ারের মূল্য চাঁন্দে উঠে বসে আছে। হেলেও না দোলেও না।
একদিন ক্যান্টিনে বসে চা খাচ্ছিল সে। এমন সময় এলো বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া দুই তরুন। চা খেতে খেতেই তাদের সঙ্গে পরিচয়। ছেলে দু’টো অন্তর্জাল নির্ভর পিনকোডের ব্যবসা করে। তিনমাসে দ্বিগুন লাভের ব্যবসা। এমএলএমের মতো লেফট হ্যাণ্ড আর রাইট হ্যাণ্ড, ছকে বাঁধা পিরামিড কৌশলে শীর্ষবিন্দুতে পৌছার যক্কি নেই। তাদের চোখে মুখে কোটিপতি হওয়ার স্বপ্ন ঝিলিক দিচ্ছে। আত্মবিশ্বাসে টগবসে ছেলে দু’টো কথার জাদুজালে জড়িয়ে ফেললো। বলাবাহুল্য, তারই লোভাতুর মনটি জড়িয়ে পড়লো জালে। দেখতে দেখতেই সে জড়িয়ে গেলো দেহ-মনে। অফিসের কলিগ, আত্মীয়-স্বজন কাউকেই বাদ দিলো না নেটওর্য়াক থেকে। এরই মধ্যে দুইবার লাভ পেয়েছে সে। দ্রুত বড় লোক হওয়ার ঘোরে দুইবারেই পুনবিনিয়োগ করেছে। পিনকোড কেনা-বেচায় সে মেয়ের নামে করা এফডিআর, স্ত্রীর ডিপোজিট সবই ভেঙে ফেললো। ঢুকিয়ে দিলো পিনকোডের অদৃশ্য গহ্বরে। এ শর্টকার্টটুওয়েতে হাঁটা শুরু করলো অন্যরাও। টাকা দাও, গোপন পিনকোড কেনো আর ডলারের হিসাব-নিকাশ কষতে কষতে তর্জনীর ডগা ও ক্যালকুলেটরের বাটনগুলো নড়বড়ে করে ফেলো।
সাধারন চাকরিজীবী খোকন দেখতে দেখতে দারুন ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ব্যবসা সম্প্রসারণে ভোরে পরিচিত লোকজনের বাসায় বাসায় হানা, সকালে অফিসে ছুটা, দুপুরে লাঞ্চ আওয়ারে পুঁজি মোহনায় লম্ফজম্ফ এবং সন্ধ্যায় গোপন পিনকোডের ব্যবসা, ডলারের হিসাব-নিকাশ। টাকার লেনদেন হচ্ছে, মোহনায় সাতরাচ্ছে আর অন্তর্জালের গহ্বরে হারিয়ে যাচেছ। কিন্তু ব্যাংকের পেট স্ফিত হচ্ছে না। কেবলই হাতবদল হচ্ছে। এখন সে ইলিশ মোহনার দক্ষ জেলে আর অদৃশ্য পিনকোডের বিশ্বস্ত ইজারাদার। স্ত্রীর মুখের দিকে তাকানোর সময় নেই। কন্যার অসুস্থতার দিকে খেয়াল নেই। সামাজিক কর্মকাণ্ডের তো ফুরসৎই নেই। কিন্তু সে সারাদিন মানুষের সঙ্গেই থাকে। তার মতো লোভাতুর মানুষ নিয়ে কারবার।
সেদিন ছিল রোববার। খোকন যথারীতি লাঞ্চ আওয়ারে অফিস থেকে বেরিয়ে সাতরাতে গেছে। কিন্তু ব্রোকারেজ হাউজে পৌছার আগেই দেখে মতিঝিলের মোহনা ঘাটে জটলা। লোকজন উত্তেজিত। খোকন কৌতুহলী হয়ে কাছে যায়। অবশ্য গতকাল দুপুরে শুনেছে মোহনায় নাকি কেউ কেউ কৌশলে মাছ শিকার করতে চায়। তাহলে কি সেটাই হচ্ছে। জটলায় গিয়ে তার মাথা ঘুরে যায়। মোহনায় নাকি রীতিমতো হাঙ্গর ঢুকে পড়েছে। ইলিশ তো খেয়েছেই উল্টো জেলেদের নৌকা উল্টো দিয়েছে। কারও হাত-পাও খেয়ে ফেলেছে। দুই জেলে নাকি সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে। খোকন ব্রোকারেজ হাউজে ঢু মারে। কিন্তু সেখানে গিয়েই সে আকাশ থেকে পড়ে। রাতারাতি তার সাড়ে বারো লাখ টাকার ইলিশ মাছ দুইলাখে ঠেকেছে। বলে কি! কিন্তু ব্রোকারেজ হাউজের লোকজন নির্বিকার। সে পুকুরঘাটে অন্যদের সঙ্গে রাগে-ক্ষোভে হৈ চৈ করে, স্লোগান দিয়ে অফিসে ফিরে।
রাতে বাসায় ফিরেই খোকন টিভি অন করে। পুঁজি মোহনায় বিক্ষোভের দৃশ্য দেখে। নিজেকে দেখে স্লোগানরত অবস্থায় একপলক। অর্থমন্ত্রী তাদের বলছে- ফটকাবাজ। রাসে রিমোটটি টিভিপর্দায় ছুড়ে মারতে গিয়েও হজম করে। সরকারই তো একদিন রোডমার্চ করে পুঁজি মোহনায় ফটকাবাজদের ডেকে এনেছে। সে কথা মনে করে খোকন একটি তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। সে রাতে খোকনের ঘুম হয় না। রাতে সে স্বপ্নে দেখে সাগরে ইলিশ শিকারে গেছে। গভীর সাগরে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ খেলা করছে। তারা হাত দিয়ে ইলিশ ধরছে। ঠিক তখনই একদল হাঙ্গর এসে সমস্ত ইলিশ গপাগপ গিলে ফেলে। তারা নৌকা থেকে পড়ে গিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। তাদের চারপাশে হাঙ্গরের দল। এ হাঙ্গরের দলের মধ্যে সে ব্যাংকের লোন অফিসারকে দেখে, তার ছোট বেয়াইকে দেখে। যার কাছ থেকে খোকন দুইলাখ টাকা কর্জ নিয়েছেন। খোকনের ঘুম ভেঙে যায়।
এক ধরনের ঘোরের মধ্যেই সে অফিসে যাওয়া আসা করছে কয়েকদিন। অন্তর্জালের পিনকোড ব্যবসায়ীদের কপালে দুঃচিন্তার ভাঁজ। তার কয়েকজন গ্রাহক ফোন করেছে। তারা উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলেছে- পিনকোড ব্যবসার কারণেই নাকি শেয়ারবাজারে ধ্বস। কিন্তু পিনকোড ব্যবসায়ীরা সে ধরনের আতঙ্কের কথা উড়িয়ে দেয়। মোহনার অবস্থা এমন আদৌ সেখানে ইলিশের মওসুম আসবে কিনা নিশ্চয়তা নেই।
পরের বৃহস্পতিবার খোকনের মাথায় বজ্রাঘাত পড়ে। অফিস থেকে বেরিয়ে আগে-বাসে সে অন্তর্জালের পিনকোড ব্যবসার খবর নিতে হাতিরপুল ছুটে যায়। কিন্তু অফিসে নতুন তালা। খোকন ভেবে পায় না। আজ তো বৃহস্পতিবার অফিস তালাবদ্ধ হবে কেন? মোবাইলে রিং দিতে গিয়ে দেখে মোবাইল বন্ধ। তার মতো আরো কয়েকজন সেখানে জড়ো হয়েছে। সবার চোখে মুখে হতাশা। নানা আশঙ্কা খোকনের মনে উথাল-পাতাল করতে থাকে। কয়েকজন তার কাছে জানতে চাইছে- বিষয় কি? সে কোন উত্তর দিতে পারে না।
তিন সপ্তাহ ধরে পাওনাদার ও গ্রাহকরা অনাবরত ফোন দিচ্ছে খোকনের মোবাইলে। কিন্তু সে রিসিভ করছে না। দু’একটা ফোন ধরলেও কোন উত্তর দিতে পারছে না। বাসায় স্ত্রীর ঘেন ঘেনানির মাত্রা বেড়ে গেছে। মেয়েটি জ্বরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কাশি হয়েছে। ডাক্তারের কাছে নেয়ার মতো টাকা নেই হাতে। এখনও বেতনের বাকি এক সপ্তাহ। বহুদিন পর সে জুমার নামাজ পড়েছে। মোনাজাতে আল্লাহর কাছে সাহায্য চেয়ে কান্নাকাটি করেছে। এখন সে পাক্কা বিশলাখ টাকার দেনায় পড়ে গেছে। চোখে মুখে দেখছে ঘন অন্ধকার।
শুক্রবার টিভিতে নাটক দেখে মনটা হালকা করতে চেয়েছিল খোকন। বেনসন বাদ দিয়ে সে দু’টো গোল্ডলিফ নিয়ে বাসায় ফিরেছে। সেখান থেকে একটি টানতে টানতে টিভির সামনে গিয়ে বসে। তার স্ত্রী জিনাত বানু তখন মেয়েকে নিয়ে শুয়ে আছে বৈকালিক বিশ্রামে। খোকন খেয়াল করে বেচারী দিনরাত গাধার খাটুনি খাটে। টিভি চ্যানেল ঘোরাতে ঘোরাতে একটিতে তার চোখ আটকে যায়। অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে টকশো হচ্ছে। সেখানে বিরোধী পক্ষের লোকটি যেভাবে বলছে এককথায় এক্সিলেন্ট। পুঁজি মোহনা ও শর্টকার্টইউটু নিয়ে তার বক্তব্য শুনে ইচ্ছে করছে লোকটার পায়ে ধরে সালাম করে আসে। কিন্তু পরক্ষণেই সরকার পক্ষের লোকটির কথা শুনে তার কান গরম হতে থাকে। মেজাজ বিগড়াতে শুরু করে। শালা জ্ঞান দিচ্ছে আর স্বপ্নের জগতে দৌড়াচ্ছে। যেভাবে কয়েকসপ্তাহ আগেও দৌড়েছে খোকন। কিন্তু সবচেয়ে খারাপ লেগেছে যখন অর্থমন্ত্রী পাগলের মতো মুখে হাসি ঝুলিয়ে বললেন- দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা আগের চেয়ে চাঙ্গা, পরিস্থিতি যে কোন সময়ের চেয়ে ভালো। খোকন একটি শব্দই উচ্চারণ করে- শালা টাল।
সে রাতেই খোকন বেদনাভারাতুর কণ্ঠে জিনাতকে কাছে ডাকে। জিনাত খানিকটা হতাশ ও ভয়ার্ত চেহেরায় কাছে এসে চুপচাপ বসে। দুইজনই চুপচাপ।
জিনাত অস্ফুষ্ট স্বরে বলে- কিছু বলবেন?
খোকন- হ্যাঁ।
জিনাত অপেক্ষা করে।
খোকন বলে- ভাবছি তোমাদের কিছুদিনের জন্য গ্রামে পাঠিয়ে দেব।
জিনাত নিরুত্তর।
খোকন বলে- বাসাটি ছেড়ে দিয়ে আমি মেসে গিয়ে উঠব। আর পারছি না। বলেই সে মাথায় হাত দিয়ে সোফায় ঘাড় এলিয়ে দেয়।
জিনাত সবই বুঝে। তাই কোন প্রতিক্রিয়া দেখায় না।
ত্রিশ তারিখ সকালে বাসা থেকে বেরুনোর সময় কপালে ধাক্কা লেগেছে খোকনের। স্ত্রী-কন্যার বাসের টিকেট কাটা হয়েছে। বাসার কিছু মালামালও বন্ধুদের বাসায় সরিয়ে নিয়েছে। আজ রাতের মধ্যেই বাসা খালি করতে হবে। এতদিনের সাজানো বাসাটি তছনছ হয়ে গেছে। কাল এ বাসায় উঠবে আরেক ভাড়াটিয়া। জিনাতের চোখ অশ্রুসজল। খোকনের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ। মাথায় হাত ঘষে ধাক্কাটি হজম করে সে। পেছন থেকে জিনাত ডাক দিয়ে বলছে- আজ দ্রুত ফিরবেন। জিনিষপত্র গোছগাছ করেই আমাদের বাস ধরতে হবে।

পরিবারকে গ্রামে পাঠিয়ে দেয়ার পর হোটেলে খেয়ে না খেয়ে একমাস অফিস করেছে খোকন। কিন্তু দিনগুলো যেন কাটছেই না। একদিন অফিসে ঢুকতেই ফ্রন্ট ডেক্সের জুনিয়র কর্মকর্তাটি তেতো হাসি হেসে নোটিশ বোর্ডের দিকে আঙুল দিয়ে ইশারা করে। খোকন খেয়াল করে দেখে ছাটাই নোটিশ ঝুলছে। সেখানে তার নামটিও জ্বলজ্বল করছে। কর্তৃপক্ষ অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের দোহাই তুলে চৌদ্দজনকে ছাটাই করেছে। চলতি মাসের বেতনের সঙ্গে তাদের পাওনা বুঝে নিতে বলা হয়েছে। মুহুর্তে চোখে সর্ষে ফুল দেখে সে। ততক্ষণে ফ্রন্ট ডেক্সের অফিসারের তেতো হাসিও মিইয়ে গেছে। বুকে যন্ত্রনা, হৃদয়ে রক্তক্ষরণ নিয়ে অফিসের শেষ কয়েকটি দিন কাটাতে হবে।
পুঁজিমোহনায় হাঙরের তান্ডবের পরপরই শর্টকার্টওয়েটু’র পিনকোডও হঠাৎ হ্যাং হয়ে গেল। চোখে মুখে অন্ধকার দেখছিল খোকন। অনেক ভেবেচিন্তে ঠিক করেছিল পরিবারকে গ্রামে পাঠিয়ে কিছু খরচ কমানো গেলে পাওনাদারদের চাপ কমবে। বাজার ঘুরে দাঁড়ালে ধীরে ধীরে ক্ষতি পুষিয়ে উঠবে। কিন্তু একমাসের মাথায় চাকরিটা যাওয়ার পর সত্যিই অকুল পাথারে পড়েছে খোকন। পাওনাদারদের ভয়ে লুকিয়ে চলতে হয় আবার চাকরির খোঁজে চারদিকে ঢু মারতে হয়। এ এক অদ্ভুত জীবনযাপন। অথচ তার চারপাশের মানুষগুলোকে কত সহজ স্বাভাবিক দেখাচেছ। খোকনের মনে প্রশ্ন জাগে- এরা কি সত্যিই স্বাভাবিক আছে নাকি সময় ও পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে?
খোকন লুকিয়ে চুরিয়ে হাটে। পাওনাদার ও গ্রাহকদের ফোনের জবাবে ধৈর্য্য ধরতে ক্ষুদে বার্তা পাঠায়। গোপনে এদিক-ওদিক যোগাযোগ করে। কিন্তু কোন আশার আলো দেখতে পায় না। খোকনের দিন কাটে না। সেদিন সেভ করতে গিয়ে খেয়াল করে চিপে পাক ধরেছে। কয়েকটি দাড়ি আফ্রিকা থেকে ইউরোপে পাড়ি জমিয়েছে।
খোকন মতিঝিলের ব্যাংক পাড়ায় ঘুরে, পুঁজি মোহনার আশপাশে যায়। লোকজনের কাছে খবরাখবর জানতে চায়। কোন সুসংবাদ আছে কিনা। কিন্তু লোকে নানা কথা বলে। একবুড়ো কেরানী পানের পিক ঝেড়ে তাচ্ছিল্য করে- কি দিন এলো বাপ। আজকালের পোলাপানরা বুড়োদের কথাই মানতে চায় না। বলি কি- দরগায় যাও। দরবেশের কাছে হাত পাতো। দরবেশদের আর্শিবাদে দেশটি টিকে আছে। কিন্তু কেউ শুনে না। বুড়োদের কথা কিন্তু আখেরে ফলে।
দরবেশ আর কালো বিড়ালের গল্প শুনতে শুনতে খোকনের কান ঝালাপালা হয়ে উঠে। সে গোল্ডলিফের বদলে কয়েকটি স্টার সিগারেট নেয়। একটিতে টান দিয়েই সেখান থেকে সরে যায়। যেতে যেতে শুনে কে একজন বলছে- দক্ষিণা ব্যাংকটি নাকি কোন আরব যুবরাজ কিনে নিচ্ছে।
পল্টন মনি সিং ভবনের সামনে আসতেই কলেজ জীবনের বন্ধু বশির পাটোয়ারীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল খোকনের। গত সরকারের সময়ে দেদারসে আদম ব্যবসা করেছে। দুহাতে কামিয়ে নিয়েছে কাচা পয়সা। এখন পুরান ঢাকায় নাকি কিসের আমদানী-রপ্তানী ব্যবসা করে। খোকন কখনো আগবাড়িয়ে জানতে যায়নি। পাটোয়ারী তাকে দেখেই হাক দেয়- কিন্তু বন্ধু কি খবর?
খোকন এড়িয়ে যেতে চায়- না কি আর খবর।
শেয়ার বাজারে ধরা খেলি নাকি?
খোকন সম্মতিসুচক উত্তরহীন।
পাটোয়ারী বলে- সরকার তো প্রনোদনা দিচ্ছে।
খোকনের সংক্ষিপ্ত উত্তর- শুনেছি।
পাটোয়ারী উচ্চসিত কণ্ঠে বলে- আরে চিন্তা করিস না। আমাদের সরকার বাজার আবার দাঁড় করাবে। তোরা মালামাল হয়ে যাবি।
খোকন এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে মনে মনে ভাবে- পাটোয়ারী তো বিগত সরকারের সময়ে দুহাতে কামিয়েছে। তাহলে এ সরকারও তাদের হয় কি করে?
পাটোয়ারী হঠাৎ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তড়িঘড়ি করে। আহারে দশ মিনিট দেরি হয়ে গেল। সে খোকনের পিঠ চাপড়ে দিয়ে জিরো পয়েন্টের দিকে চলে গেলো। সেদিনের কথা মনে হতেই বেদনার মধ্যেও হাসির রেখা ফুটে উঠে খোকনের চোখে-মুখে। 

ঘোরের মধ্যেই ডাকুয়ার অফিসে গিয়ে ঢুকলো খোকন। ডাকুয়া তখন অন্যদিনের মতোই টেবিলে মাথাগুঁজে শুকনো মুড়ি চিবুচ্ছিল। সে পত্রিকা পড়ে না, টেলিভিশনে খবর দেখে না, সিগারেট খায় না। বলে পত্রিকা আর টেলিভিশনের খবর কেবলই মন খারাপ করে দেয়। চোখে ভাসতে থাকে নানা ঘটনা দূর্ঘটনার দৃশ্য, কানে বাজতে থাকে তার বর্ণনা। আর সিগারেট মানেই অপচয়। ঘামে ভেজা নোটগুলো আগুনে পোড়ানো। তাই এগুলো থেকে দুরে থাকে সে।
খোকনকে দেখেই ডাকুয়া মিস্টি একটি হাসি দেয়। এটা তার পুরো স্বভাব। এসেছিস বন্ধু- নে মুড়ি খা। বলেই টোঙাটি এগিয়ে দেয়। পাশেই বাসার ফোটানো পানির বোতল। খোকন কপালের ঘাম মুছে ধপ করে ডাকুয়ার সামনের চেয়ারে বসে পড়ে। তারপর বিনা বাক্যব্যয়ে মুড়ি চিবুতে থাকে। ডাকুয়া কথা তুলে- কোথাও যাচ্ছিলি?
ডাকুয়ার ছোট্ট এ প্রশ্নের ভেতর যেন অজস্র জিজ্ঞাসা কিলবিল করছে। সে হয়তো জানতে চাইছে- চাকরির খোঁজ মিললো কিনা, কিংবা বাজারের কি অবস্থা কিংবা গ্রামে ভাবি-বাচ্চারা কেমন আছে... ইত্যাদি কতকিছু। ডাকুয়ার এ ছোট্ট প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে খোকনের মনের অর্গল খুলে যায়, জবানের আড়ষ্টতা কেটে যায়। সে সকালের ফাঁকা রাস্তায় গাড়ির না পাওয়া দিয়েই শুরু করে। খানিকটা বিরক্তি মিশিয়ে বলে- বলিস না দোস্ত। সকালে রাস্তায় বেরুলাম গুলশান যাব, কিন্তু রাস্তা দেখি বাস নেই। কি করব ভাবছি এমন সময় ফোন করল তোর ভাবি। মেয়েটির আবারও জ্বর বেড়েছে। আগামী সপ্তাহে চাচাতো বোনের বিয়ে। টাকার দরকার। পারিবারিক সমস্যার কথা বলতে গিয়ে চাকুরির সন্ধান সামনে চলে আসে। কতজনের কাছে ধর্ণা দিলাম। কদিন ঘুরিয়ে বলে- চেষ্টা করেছি কিন্তু এখন সুযোগ নেই। খোকন এক মুহুর্ত চুপ মেরে থাকে। তারপর আবার শুরু করে- কি করব বল দোস্ত মাথায় কাজ করছে না। ক’দিন ধরেই পাওনাদাররা ঘন ঘন ফোন করছে। ফোন ধরলেই ঘ্যান ঘ্যান করছে। পরশুদিন তো একজন মা-বোন তুলে গালাগাল দিল।
ডাকুয়া কিছু বলে না- কেবল মাথা নাড়ে।
খোকন বলেই চলে। পুঁজিবাজার নাকি দাঁড় করাবে সরকার নাকি কি কি উদ্যোগ নিচ্ছে, শুনি কিন্তু দেখি না। সেদিন প্রেসক্লাবের সামনে শুনলাম বিরোধীদল বলছে- ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গেলে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন করা হবে। কিন্তু কিছুই তো বিশ্বাস করতে পারি না।
ডাকুয়ার চেহেরায় সহানুভূতির ছাপ।
নতুন মদ্যপের মতো অবস্থা খোকনের। জ্বালা-যন্ত্রনা, দুঃখ-বেদনা সবকিছু উগলে দিচ্ছে। দেখ দোস্তÑ সকালে আদাবর থেকে ধানমণ্ডি হেঁটে আসতে গিয়ে কত অভিজ্ঞতা হলো। পুলিশের ধাওয়া খেলাম দুইবার। পথিমধ্যে মিছিলে নিখোঁজ, হাওয়া, গুম, লুকিয়ে রাখা, ব্লেম গেম নানারকম শব্দ শুনেছি। বউয়ের চাহিদা, পাওনাদারের গালি- কান দু’টো ঝালাপালা হয়ে গেল। কথা শেষ করেই সে ঢকঢক করে বোতলের অর্ধেক পানি গলাধকরণ করে। একটু নিঃশ্বাস নিয়ে বলে- দোস্ত আর পারছি না।
খোকনের কথা শুনতে শুনতে ডাকুয়ার মুখে মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠে। ডাকুয়া আলমিরার উপর থেকে ভুভুজেলাটি নিয়ে নাড়াচাড়া করে। দেখেই খোকনের বিরক্তি জাগে। হঠাৎ করেই ডাকুয়া সামনে ঝুকে খোকনের কানের পাশে একটি ফুঁ দিলো ভুভুজেলায়। বিকট একটি আর্তনাদ খোকনের কানের পর্দা ভেদ করে, মনের অলিন্দে কাঁপন ধরিয়ে; কানে তালা লাগিয়ে দিল। সারাদিন ধরে তার কানে জমে ওঠা সমস্ত তাগাদা, গালাগাল, বাখোয়াজ, গুজব, সুখ-দুখের কাহিনী সবই যেন মুহূর্তে উধাও হয়ে গেছে। সে বয়রার মতো এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে দেখে ডাকুয়া পরিতৃপ্তির হাসি হাসে। বেশ খানিকক্ষণ পর ধীরে ধীরে কানের তালা খুললে খোকন বিস্ময় আর বিরক্তি নিয়েই ডাকুয়াকে বলে- কি ব্যাপার?
ডাকুয়ার মুখে হাসির রেখা। সে হাত বাড়িয়ে বলে- তাড়াতাড়ি ফি-টা দে। 
খোকন অবাক হয়- কিসের ফি?
কেন চিকিৎসা ফি। 
চিকিৎসা ফি মানে!
ডাকুয়া মুখে কৃত্রিম গাম্ভীর্য ফুটিয়ে বলে- কেন তোর কান দু’টো ফাঁকা ফাঁকা লাগছে না?
হ্যাঁ, লাগছে।
এই যে ফাঁকা ফাঁকা লাগছে, কর্ণকুহরে জমে ওঠা সবকিছু উড়িয়ে নিয়ে গেছে এটাকে বলে ভুভুজেলা চিকিৎসা। সকালে বাসা থেকে বেরুনোর সময় একবার নিবি, সন্ধ্যায় বাসায় ফেরার আসে একবার নিবি। সারাদিনই কান দু’টো ফাঁকা ফাঁকা থাকবে। উল্টোপাল্টা কিছুই আর কানে ঢুকবে না।
ডাকুয়ার নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি দেখে খোকন গভীর ভাবনায় ডুবে যায়। উপলব্ধি করে জীবনযাত্রায় পিছিয়ে পড়া আফ্রিকায় কেন ভুভুজেলা এত জনপ্রিয়। কেনই বা বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের ভুভুজেলা এত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। সে মনে মনে আফ্রিকানদের স্যালুট দেয়।

kafi_bd80@yahoo.com

কন্যাযাত্রী
কাফি কামাল

গর্জনবুনিয়ার পশ্চিম ঢাল বেয়ে গড়িয়ে নামছে দুপুর। সদ্য নেভানো চুলোর মতো ঠাণ্ডা হয়ে আসছে সূর্যের তেজ। মৃদু বাতাসে অঘ্রাণের ধানকাটা মাঠের নাড়ার মতো সুর ওঠেছে চ্যাপ্টামুড়ার মৌলভী বাড়িতে। বরকনে দু’পক্ষের মেহমানরা সমবয়সীদের নিয়ে আড্ডা জমিয়ে তুলেছেন। আড়ালে-আবডালে চলছে হালকা রঙ্গ-রসিকতাও। না দেখা জামাই নিয়ে কনে দিনারাকে অন্দর মহলে টিপ্পনি কাটছে বুড়ি দাদী-নানীরা। তা শুনে হাসিতে গড়িয়ে পড়ছে তরুণীরা। তবে ভেতর বাড়ির খোশালাপ বাইরে উঠোনের পুরুষ মানুষের কানে একটা আবছা রেশ ছড়িয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। মৌলভী বাড়ির অন্দরে পুরুষ মানুষের অবাধ যাতায়াত নিষিদ্ধ। বিয়ে-শাদী উপলক্ষেও কোন গান-বাজনা নেই। নেই তেমন হৈ হুল্লোড়ও। আছে কেবল কনের দাদা সিকান্দার মৌলভীর হাঁক-ডাক আর বাচ্চাদের হইচই। তারপরও বিয়েবাড়ির কিছু স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য চ্যাপ্টামুড়ার চূড়া ছুঁইয়ে গেছে। হাঁটাচলায় শাহেদের কানে অন্দর মহলের দু-এক টুকরো হাস্যরস অনুরণন তুলেছে। ওদিকে বরপক্ষ এটা আনেনি, ওটা আনেনি ইত্যাদি মেয়েলী অনুযোগে, হৈ হল্লায় সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে।
কি একটা প্রয়োজনে দিনারার মাকে খুঁজতে গিয়ে পাশের বারান্দায় দিনারাকেই চোখে পড়ে শাহেদের। বিয়ের শাড়িতে দিনারাকে পরীর মতো লাগছে। তার চোখ দু’টো জলে ভেজা। কিছুক্ষণ পরই তাকে না দেখা জামাইর কাছে নিজেকে আজীবনের জন্য সমর্পণ করতে যেতে হবে। সমুদ্র তীরবর্তী দূরের এক গ্রামে। মেয়েরা নাকি স্বর্গে যাওয়ার আগমুহূর্তেও রান্নাঘরে একটা ঢুঁ মেরে যায়। দিনারাও শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার আসে বিয়েবাড়িতে ব্যস্ত মাকে এটা-ওটা এগিয়ে দিচ্ছে। শাহেদকে দেখেই সে দ্রুত আঁচলে মুখ ঢাকে। শাহেদ নীরবে দ্রুত বেরিয়ে যায়।
ঘরভর্তি মেয়েদের চোখে জল, কণ্ঠে চিরায়ত কনে বিদায়ের শোক। বরযাত্রীরা দুপুরের খাওয়ার পর্ব শেষ করে ফেরার তাড়া দিচ্ছেন। কয়েকজন বয়স্ক বরযাত্রী খানাপিনা সেরে ছুটেছিলেন মসজিদের উদ্দেশে। ছেলে-ছোকরারা ভিড় করছিল পাড়ার দোকানে। সবাই এখন চ্যাপ্টামুড়ার চূড়ায় কনেবাড়ির উঠোনে ফিরে আসছে। নীরবে এটা-ওটা আনা-নেয়া করছেন কনের বাবা নুরুল করিম মৌলভী। তার চোখও টলমল। তিনি পাঞ্জাবির খুঁট দিয়ে চোখের পানি মুচছেন। বড় মেয়ের বিয়ে দিয়ে মন ভরেনি তার। দ্বিতীয় মেয়ের বিয়েতেও মনের মতো আয়োজন করতে পারলেন না। বুড়ো পিতার হাঁকডাকের কাছে বড্ড অসহায় নূরুল করিম মৌলভী। তবে নাতনিকে শ্বশুর বাড়ির মুরব্বীদের হাতে হাওলা করে দিতে দিনারার দাদা সিকান্দার মৌলভীর তাড়ার অন্ত নেই। উঁচুস্বরে হাঁক দিচ্ছেন- কই রে তাড়াতাড়ি কর। তাড়া কর, সূর্য যে ডুবে যায়। সন্ধ্যা হয়ে আসছে।

খ.
বন্ধুর ছোট বোনের বিয়েতে চল্লিশ কিলোমিটার দূর থেকে চ্যাপ্টামুড়া এসেছে শাহেদ। সমুদ্রের ঘ্রাণযুক্ত শরীরে হাজির আরেকবন্ধু মোশতাক। বিয়েবাড়িতে প্রথম পরিচয়েই তাদের সঙ্গে আড্ডা জমিয়ে তুলেছেন কনের ফুফাতো ভাই মোরশেদ। আগের রাত থেকেই গল্প, আড্ডা, বিয়েবাড়ির ছোটখাটো নানা কাজে আনন্দের মধ্যেই কেটে গেছে সময়।
কনে বিদায়ের আসে দিনারার বড়ভাই জয়নাল বন্ধুদের কন্যাযাত্রী হওয়ার প্রস্তাব দেয়। বলে- চলরে শাহেদ রাজাখালী যাই...।
কে কে যাচ্ছে? শাহেদের কৌতূহলী জিজ্ঞাসা।
মোরশেদ এবং মোশতাকও যাবে। ছেলে-বুড়োরা তো আছেই। জয়নালের হাসিমাখা উত্তর।
চল্। তাহলে নতুন জায়গা দেখা হবে। সমুদ্রতীরের গ্রামে জামাইবাড়িতে নিশ্চয় খুব আনন্দ হবে। জয়নালের প্রস্তাবে কন্যাযাত্রী হতে এককথায় রাজি হয়ে গেল তিনবন্ধু। জয়নাল তাড়া দেয়- দ্রুত কর। কিছুক্ষণের মধ্যেই দিনারাকে নিয়ে বরযাত্রীরা রওনা দেবে।
পুরনো আমলের লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা জিপে চড়ে বিকাল নাগাদ শুরু হলো কন্যাযাত্রা। একটিতে দু’পক্ষের পুরুষ অন্যটিতে মেয়েদের নিয়ে হেলেদুলে চলতে শুরু করলো জিপ দু’টো। ধুলো ওড়া, খোয়া ভাঙা মেঠোপথ ধরে জিপ চলছে। রাস্তার দু’পাশ থেকে গ্রাম্য বৌ-ঝি’রা বেড়ার ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে উঁকি দিচ্ছে। হাফপ্যান্ট পরা শিশু আর লুঙ্গির কাছা মারা বালকগুলো জিপের পেছনে পেছনে দৌঁড়াতে দৌড়াতে ধুলো খেয়ে হাঁপিয়ে উঠছে। কন্যাযাত্রী বুড়োরা কখনও ধমক দিয়ে কখনও হাতের লাঠি দেখিয়ে শিশুদের দৌড় থামিয়ে দিচ্ছেন। জিপগুলো যখন আঁকাবাঁকা মেঠোপথ ভেঙে বাঘগুজরা স্টেশনে পৌঁছে তখন আসরের নামায শেষ করে মুসল্লিরা বেরিয়ে আসছে।
মুসল্লীদের দেখেই বরযাত্রী আবদুস সালাম আপসোস করে- নামাযটা কাজা হয়ে গেল। গাড়ি একটু পরে ছাড়লে হতো না।
পাশে বসা আবদুল কাইয়ুম ভেংচি কাটে... আরে আমার নামাযি। সবাই নামায পড়েই গাড়িতে ওঠলো আর সালাম ভাই হাওয়া খেয়ে।
কাইয়ুমের কথা শুনে সালাম প্রথমে অবিশ্বাসের সঙ্গে তাকালেও পরক্ষণেই লজ্জায় চুপ মেরে গেলেন।
সুযোগ পেয়েই শাহেদ দুষ্টুমি করেÑ এক ওয়াক্ত নামায কাজা করলে ২৪ খুতবা দোজখের আগুনে জ্বলতে হবে।
শাহেদের কথাটা কেড়ে নিয়েই বর ও কনেযাত্রী কয়েকজন বুড়ো ধর্মালাপ শুরু করে দিলেন। শাহেদ তখন মোশতাককে চিমটি কেটে দেখালেন পাশের বাড়ির একটি তরুণীকে কিভাবে উঁকি মারছে।
মোশতাক মৃদু হেসে বলে- দোস্ত, একদম দোস্ত। 
বাঘগুজরা থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে ছোট পাকা রাস্তাটি পেকুয়ার দিকে চলে গেছে। বর্ষাকালে প্রচুর কাদামাটির কারণেই নাকি লোক মুখে এ নামকরণ। কিছুদিন আগেও বর্ষাকালে এ অঞ্চলের মানুষের দুর্ভোগের অন্ত ছিল না। এখনও পেকুয়া থেকে চকরিয়া যাতায়াতে জিপই ভরসা। কিন্তু রাত বাড়লে তাও মেলে না। চারদিকের দৃশ্য অবলোকন করে শাহেদের মন ভরে উঠে। অন্যরা যখন নানা গল্পগুজবে মেতে ওঠেছে তখন শাহেদ দেখছে প্রকৃতি। অঘ্রাণের ধানকাটার পর হলুদ নাড়া মেটে হলদে আভা ছড়িয়ে দিয়েছে দিগন্তব্যাপী। পেকুয়া স্টেশন থেকে গাড়ি পশ্চিম দিকে বাঁক নিতেই বিশাল ধুঁ ধুঁ বিল। আঁকাবাঁকা রাস্তা পশ্চিম দিকে চলে গেছে রাজাখালী অভিমুখে। মোশতাক ও মোরশেদের নানা গল্প, ভেতরে বুড়োদের নানা মন্তব্য আর উজ্জ্বল শ্যামলা একটি তন্বী বরযাত্রীর চোখাচোখি হয়ে মাঝে মধ্যে ছেদ পড়ছে শাহেদের প্রকৃতি ভোগে। জিপ দু’টো পেকুয়ার সবুজ বাজার পৌঁছতেই ক্লান্ত সূর্য হেলে পড়লো। সেমিপাকা টিনশেড কয়েকটি দোকানে নিয়ে গড়ে ওঠা সবুজ বাজার পেরুতেই চারদিকে লবণের ধুঁ ধুঁ মাঠ। কানে ভেসে আসছে সমুদ্রের গর্জন। জামাইবাড়ি পৌঁছাতেই সূর্য ডুব দেয় বঙ্গোপসাগরে। নুনের মাঠ থেকে বাড়ি ফিরছে সুঠাম দেহের ঘামে ভেজা নুনচাষিরা। নুনের মাঠে বিচ্ছিন্ন একেকটি বাড়ি নিয়ে রাজাখালীর গ্রামগুলো। নারকেল গাছ আর ছোট ছোট পুকুর নিয়ে প্রতিটি বাড়িই যেন মাঠের সমুদ্রে একেকটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ।
শাহেদের মনে পড়ে ’৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের কথা। মনে করিয়ে দিতেই হু করে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে মোশতাক। তারপর উদাস কণ্ঠে বলে- সে কি ভোলার মতো ঘটনা রে...। তারপর স্বগোক্তি করে বলে- বিরান ভূমিতে পরিণত হয়েছিল। চারদিকে লাশের পর লাশ। ভেসে এসেছে কুতুবদিয়া, মাতারবাড়ি আর মগনামা থেকে। আমার মেঝ ফুফুর লাশই তো পাইনি।
শাহেদের চোখ তখন অনুসন্ধিৎসু হয়ে ওঠে। যেন ঘূর্ণি তাণ্ডবের অস্তিত্ব খুঁজছে।

গ.
জিপগুলো ধুলো উড়া পথ মাড়িয়ে জামাইবাড়ির অদূরে এসে থামলো। অল্প একটু পায়ে হাঁটা পথ পেরুলেই নারকেল গাছে ঘেরা জামাইবাড়ি। আঙ্গিনায় ঢুকেই এক ধরনের বিদঘুটে আবহাওয়া নাকে মুখে ঝাপটা দিয়ে গেল শাহেদের। পাড়া প্রতিবেশীরা বরের আঙ্গিনায়ও ঢুকলো না। জিপ থেকে নেমেই যে যার বাড়িতে চলে গেলো। বরের আত্মীয়-স্বজনরা ব্যস্ত হয়ে উঠলেন নিজেদের নিয়েই। উঠোনে ধান শুকানোর তলুই বিছিয়ে বসার ব্যবস্থা করা হলো কন্যাযাত্রী কয়েকজন বুড়োর। মেয়েরাও নিজেদের মতো করে বাড়ির ভেতরে বসার জায়গা খুঁজে নিয়েছে। কিন্তু বাইরে দাঁড়ানো কন্যাযাত্রী জোয়ান ছেলেগুলোর দিকে কারও নজর নেই।
বন্ধুদের কথা ভেবে ছোট হয়ে যাচ্ছিল কনের ভাই জয়নাল। রাগে-অপমানে তার মুখের শিরা ফুলে ওঠেছে। ঠোঁট কামড়াতে কামড়াতে সে পায়চারী শুরু করে। এ কেমন বাড়ি রে বাবা! প্রতিবেশীদের আনাগোনা নেই। আত্মীয়-স্বজনের হৈ হুল্লোড় নেই। সামিয়ানা আর আলোকসজ্জা নেই। রঙিন কাগজের ফুল পর্যন্ত লাগানো হয়নি দরজায়। শাহেদ কিছুটা অবাক হয়। আঙিনায় নারকেল গাছে হেলান দিয়ে গল্পে মেতে ওঠা শাহেদ ও মোরশেদকে দু’টো মোড়া এনে দেয় একটি ছেলে। দিনারার জামাই তখনো বাজার থেকে ঘরে ফিরেনি। দু’কিলোমিটার দূরেই রাজাখালী বাজারে তার তেলের দোকান। মাছমারা ট্রলার ও ইঞ্জিন নৌকায় তেল সাপ্লাই দেয়। বিয়ের দিনেও দোকানে তেল বেচাকেনা করছে, শুনেই শাহেদের মনটা কুচকে যায়।
কন্যাযাত্রী আর আত্মীয়-স্বজনরা বরের জন্য অপেক্ষা করছে। তরজা বেড়ার ফোকর দিয়ে ঘরের ভেতর থেকে মাঝে মধ্যে মহিলাদের ফোড়ন কাটা আর মুখ ঝামটার শব্দ কানে আসছে। দিনারার মামা শ্বশুর কুদ্দুস মেম্বারের মধ্য বয়সী স্ত্রীর অট্টহাসির শব্দগুলো বেশ জোরালো। এরই মধ্যে শাহেদের পরিচিত হয়ে ওঠেছে ওই হাসির শব্দ। পৃত্থুলা আকৃতির বাচাল মহিলাটি দুপুর থেকেই কথায় কথায় হাসির ধমক ছড়াচ্ছেন। নিজেই বলেন, নিজেই হাসেন। অলঙ্কার সজ্জিত শরীরের অহঙ্কারী ভাঁজ খুলে কন্যাযাত্রী মহিলাদের সঙ্গে মেয়েলী ঠাট্টা-মশকরা করে যাচ্ছেন। বাইরে কন্যাযাত্রীদের সঙ্গে কথাবলার লোক নেই। কেউ এসে জিজ্ঞেসও করছে না। বুড়োরা নিজেদের মতো গল্পগুজবে মেতে ওঠলেও শাহেদদের নিঃসঙ্গটা ঘুচে না। তার মনে হচ্ছে, এ কোন আবোলাইন্যা মেজবানে এসে পড়েছি। যে বাড়িতে অনুষ্ঠান সে বাড়ির লোকজন কথার খাতির না করলে নিজেকে কেমন ছোট ছোট লাগে। মনে হয় অযাচিত। মোরশেদের সঙ্গে এলোমেলো গল্প লতিয়ে ওঠলেও তার ভাল লাগছে না।
চট্টগ্রামের বিয়ের সঙ্গে কোন মিলই নেই। এজন্য শাহেদের বিস্ময়টা একটু বেশি। বৃহত্তর চট্টগ্রামের লোকজনের মেহমানদারীর সুনাম দেশজোড়া। চট্টগ্রামে বিয়ে বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া, আদর-আপ্যায়নের জুড়ি মেলাভার। লোকে বলে, পাতিলে চাল না থাকলেও খরচের হাত খোলা। চট্টগ্রামের লোকজনের মধ্যে এ নিয়ে একটি অহঙ্কারও আছে। এখানে খাবার চেয়ে কথার মান বেশি। 
শাহেদ শুনেছে সমুদ্রতীরের মানুষ সাহসী ও উদার হয়। এখন মনে হচ্ছে, তাদের মধ্যে হিংস্রতা আর অসামাজিকতাও আছে। নাকি ভুল বিচার করছে? একটি বাড়ির লোকজনের আচরণে পুরো এলাকার চরিত্র বিচার করা কি ঠিক?
উঠোনে একটি চেয়ারে বসে পায়ের ওপর পা তুলে বরের কনিষ্ঠ কবির চার ব্যান্ডের রেডিও নিয়ে বসেছে। রেডিওর নব-এ স্টেশন ঘোরাতে ঘোরাতে সে খুব রসিয়ে রসিয়ে বিদেশের গল্প শুরু করে। হা করে গিলছে কয়েকজন বুড়ো লোক। মনে হচ্ছে কোন প্রবাসী দীর্ঘদিন পর বাড়ি ফিরেছে। সবাই তাকে ঘিরে সাত সমূদ্র তের নদীর গল্প শুনছে। কবির ছিটগ্রস্তদের প্রলাপের মতো গল্প করেই যাচ্ছে। কিন্তু বিরক্ত লাগছে শাহেদের। কোন সুস্থ সামাজিক লোক কি বিয়েবাড়িতে মেহমানদের প্রজার মতো বসিয়ে নিজে জমিদারের মতো গল্প শোনায় নাকি। কার গল্প কে শোনে, কে কার চেয়ে কম। লোকটা পাগল নাকি!

ঘ.
অপেক্ষা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। বরের দেখা মিলছে না। কন্যাযাত্রীদের মুখে মুখে ঘুরপাক খাচ্ছে একই প্রশ্ন- কখন আসবে বর? বর এলেই না সম্পন্ন হবে আক্দ। কন্যাযাত্রীদের বেশিরভাগই আসে বরকে দেখেনি। দিনারার দূর সম্পর্কের এক দুলাভাইয়ের ঘটকালিতে বিয়ের ঠিক-ফর্দ হয়েছে। তিনিই দিনারার দাদাকে বর ও তাদের আত্মীয়-স্বজনের ব্যাপারে নানা কথা বাড়িয়ে বলেছে। দিনারার দাদার কারণে কেউ আগ বাড়িয়ে রাজাখালী গিয়ে বর বা তার ঘরবাড়ি দেখেনি। বুড়োর এক কথা- বাজারে তেলের দোকান আছে, এক দুনের নুনের মাঠ আছে, দেখতে শুনতেও মন্দ নয়। তাই কারও দেখতে যাওয়ার দরকার নেই। বেশি খোঁজ নিতে গেলেই দুষ্ট লোকরা ত্রুটি বের করে। এখন বরের বাড়ি পৌঁছেই মন খারাপ হয়ে গেছে দিনারার ভাই জয়নালের। রাত যত বাড়ছে ততই হাফিয়ে ওঠছে কন্যাযাত্রীরা। বুড়োরাও হাঁক দিচ্ছে- কই গো আমাদের নাতজামাই কই?
শাহেদ আর মোরশেদ উসখুস করছে। মোশতাক তাকিয়ে আছে জয়নালের বেদনার্ত চেহেরার দিকে। তাদের কিছুই ভাল লাগছে না। সামুদ্রিক হাওয়ায় ক্ষুধা-তৃষ্ণা দু’টোই উসকে দিচ্ছে। তৃষ্ণায় বুকটা ফেটে যাচ্ছে শাহেদের। এতক্ষণ একটির পর একটি সিগারেট টানতে টানতে তার কলজে পর্যন্ত যেন শুকিয়ে গেছে। সে ইশারায় একজন বয়সী লোকের কাছে খাবার পানি চাইলেন। লোকটি দ্রুত ওঠে গিয়ে কিছুক্ষণ পর ফিরে এলো খালি হাতে। কানে কানে বললেন, মেয়েদের কারণে তিনি ভেতরে যেতে পারেননি। এবার মোশতাক বাড়ির ভেতরে ঢোকে। কিছুক্ষণ পর সেও বেরিয়ে আসে খালি হাতে। বিরক্তি প্রকাশ করে বলে, কেমন বাড়ি রে বাপ। চারবার বলার পরও কেউ এক গ্লাস পানি দিল না!
এবার জয়নাল বেয়াই কবিরকে বলে- কি ভাই একটু পানিও খাওয়াবেন না?
কবির একজনকে হাক দেয়। লোকটি বেরিয়ে এসেই জানায়- শরবতের ব্যবস্থা হচ্ছে।
সময় গড়িয়ে আধঘণ্টা পেরিয়ে যায়, পানি আসে না। শাহেদ মনে মনে হাসে। এখানকার মানুষ কি পানিও খায় না। আশপাশে নলকূপও দেখা যাচ্ছে না। মোরশেদ পেছন থেকে চিমটি কাটে শাহেদের। দুইজন বাড়ির উত্তরদিকের পুকুরে যায়। নারকেল গাছ দিয়ে বানানো ঘাটে বসে তৃষ্ণা মিটিয়ে পানি খায়। হাত-মুখ ধোয়। মোরশেদ বলে- পানিতো দেখি ডাবের চেয়ে মিষ্টি। তারপর দু’জনই হেসে ওঠে।
শাহেদ খেয়াল করে প্রতিবেশীদের মধ্যে বিয়েবাড়ি নিয়ে তেমন আগ্রহ নেই। লোকজন নানা টিপ্পনি কাটছে। গল্পচ্ছলে শাহেদ পাশের বাড়ির মধ্যবয়সী একজনকে জিজ্ঞেস করলো- কি ভাই আপনাদের দেশে কি বিয়েবাড়িতে হৈ হুল্লোড় হয় না?
লোকটি মৃদু ভেংচি কাটে। ওই বাড়িতে হৈ হুল্লোড়, নাউযুবিল্লাহ!
কথাটি শুনেই মোরশেদের মুখটি কালো হয়ে গেল। অচেনা এ লোকটি যেন তাদের গালে কষে থাপ্পড় দিয়েছে। হাজার হলেও মামাতো বোনের শ্বশুরবাড়ি। শাহেদ ও মোরশেদ হাঁটতে হাঁটতে পাড়ার উত্তর দিকের একটি গাছের নীচে এসে দাঁড়ায়। পকেটের সিগারেটও ফুরিয়ে গেছে। আশপাশে কোন দোকানও দেখা যাচ্ছে না। যার কাছেই জিজ্ঞেস করে সেই গাল দেয়ার মতো করে উত্তর দেয়- রাজাখালী যান।
দুইকিলোমিটার দূরেই রাজাখালী। পথ বেশি নয়। মন ভাল থাকলে দূরত্ব নস্যি। বিয়েবাড়ির গোষ্ঠী উদ্ধার করতে করতে তারা নিজেদের নিয়ে আলাপে মেতে ওঠে। কিছুক্ষণ পর মোশতাকও যোগ দেয়। বলে, তোদের খুঁজতে খুঁজতে এদিকে চলে এলাম।
মোশতাক স্বগোক্তি করে- ভালই হলো, ওই যে আমার মামির বোনের বাড়ি। চল সেখানে যাই। এমন পানসে বিয়ে বাড়ির চেয়ে দূরসম্পর্কের আত্মীয় বাড়িই অনেক ভাল।
শাহেদ সায় দেয়- চলো।
মোশতাকের মামীর বোনের বাড়ির উঠোনে ঢুকতেই চোখে পড়ে তলুই বিছিয়ে খোশগল্প করছে নুনের মাঠ ফেরত কয়েকজন যুবক। তাদের দেখেই একজন হাঁক দেয়- আপনারা কারা? মোশতাক নাম বলতেই বাড়ির মেঝ ছেলে সালাম রীতিমতো লাফিয়ে ওঠে। আরে মোশতাক তুই! অন্যরাও ওঠে দাঁড়ায়। বাড়ির ভেতর থেকে দু’টি হাতল ভাঙা চেয়ার আর মোড়া এনে তাদের বসতে দেয়। বিয়েবাড়ির কথা শুনতেই সালাম হেসে ওঠে। শাহেদ খেয়াল করে আবারও মোরশেদের মুখটা কালো হয়ে গেছে। কথা বলতে বলতেই শরবত আর বিস্কুট নিয়ে এলো বাচ্চা একটি মেয়ে। মেঘ না চাইতেই জল, কি ব্যাপার। শুরু হয়ে গেল আড্ডা। নুনের মাঠ থেকে মধ্যপ্রাচ্য, কলেজ থেকে জনপ্রতিনিধি... হাজারও কথা। এরই মধ্যে তাসের প্যাকেট জোগাড় করে ফেলেছে মোশতাক। তাকে একটি ধন্যবাদ দিয়েই শুরু হলো টুয়েন্টি নাইন।
রাত তখন সাড়ে ১০টা। খেলা জমে ওঠলেও মোরশেদের পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে রাগে। এতক্ষণেও বিয়ে বাড়ির কেউ তাদের খোঁজও নেয়নি। বিয়ের দিন দোকানদারি করে শ্বশুর বাড়ির লোকজনরে দেখাচ্ছে শালা বর। মনে মনে গাল পাড়ে আর আস্তে করে মোশতাককে চিমটি কাটে। চিমটি খেয়েই তাড়া দেয় মোশতাক। চল বিয়েবাড়ি যাই। বর এসেছে কিনা দেখি। সালাম ক্ষেপে উঠেÑ আরে কতদিন পর বেড়াতে এসেছো ভাত খেয়ে যাও, রাতে থাকো। 
এ বাড়ির লোকজনের আতিথেয়তায় শাহেদ মুগ্ধ। তবে হঠাৎ কোন বাড়িতে এসেই ভাত খেতে বসে যাওয়া ভাল দেখায় না। ভেতরে আগ্রহ থাকলেও বাইরে তাড়া দেখায় তারা। সালাম তাদের বিয়ে বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিলেও বিয়ে বাড়িতে ঢুকে না। শাহেদের অনুরোধও বিনীতভাবে এড়িয়ে গেল।

ঙ.
বরের কোন খোঁজ নেই। মুরব্বীদের কেউ কেউ উঠোনে বসেই ঘুমে নাক ডাকতে শুরু করেছে। অন্যরা বিরক্ত মুখে অপেক্ষা করছেন। তাদের সঙ্গে আসা নঈম ভেতরে গিয়ে একটি চক্কর কেটে এসে মন্তব্য করলেন, কি মুখরা একেকটি বুড়ি। দিনারা চোখের জলে একাকার। মেয়েগুলো নানা রকম খোটা দেয়া শুরু করেছে। কুদ্দুস মেম্বারের বউটা, একটি দজ্জাল। সারা শরীরে অলঙ্কার পরে বাড়ি জুড়ে পায়চারী করছে আর তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করছে। শুনে শাহেদ অবাক হয় না। বিকালে জিপে বসেই তো মহিলাটি নানা মন্তব্য করছিল। দিনারার জন্য তার খুব মায়া হয়। মেয়েটিকে সারাজীবনই এ খোটাখুটির যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে। মেয়েরা কি এ জন্যই জন্মায়? শাহেদের বোনের কথা মনে পড়ে।
বরের কনিষ্ঠ এসে খুবই অনান্তরিক স্বরে হাঁক দেয়- কার কার ক্ষুধা পেয়েছে আসুন। অপমানে শাহেদের মুখ লাল হয়ে গেল। এ কোন ভুতের রাজ্য রে বাপ। শুনেই পিত্তি জ্বলে গেলো মোরশেদের। অস্ফুষ্ট স্বর বেরিয়ে এল গলা দিয়ে- শালা!
রাজাখালী থেকে চল্লিশ কিলোমিটার দূরে শাহেদদের বাড়ি। সেখানে এত অনান্তরিক কণ্ঠে ডাকলে কুকুরও খেতে আসবে না। জয়নাল জানে, মোশতাকও জানে। কিন্তু অপমানে লাল হওয়া ছাড়া কিইবা করার আছে। তারা সেটাই হয়, লালে লাল।
তারা কেউ ভেতরে যাচ্ছে না দেখে একটি বয়স্ক মানুষ আবারও হাঁক দেয়, কই খেতে আসেন।
এতক্ষণ চুপচাপ থাকলেও জয়নাল এবার গলা চড়িয়ে ডাকে বেয়াইকে। কি মিয়া আমরা আপনাদের বাড়িতে কি কামলা এসেছি নাকি? মেহমানদের আপ্যায়ন তো করলেন না উল্টো এত রাতে জানতে চাচ্ছেন ক্ষুধা পেয়েছে নাকি।
জয়নালের কণ্ঠে ঝগড়া ও অপমানের কান্নার সুর যুগপৎ উপছে পড়ছে। বরের কনিষ্ঠ কবির সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করেই রেডিও হাতে চলে গেল ভেতরে। 
কয়েকজন বুড়ো খাবার পর্ব সেরেই বরের খোঁজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। কন্যাযাত্রী আবুল কিছুটা শ্লেষ জড়িয়ে বললেন- বরতো লাখ টাকার কারবারি। টাকা গুণতেই নাকি আঙুল ব্যথা হয়ে যায়।
আরেকজন টিপ্পনি কাটে, বরের মুখে নাকি বসন্তের দাগ আছে। বেচারা হয়তো লজ্জায় দেরি করছে। বুড়ো লোকগুলো এভাবে গ্রাম্য ঠাট্টা মশকরায় মেতে ওঠে।
কন্যাযাত্রী বুড়োদের মুখ ঝামটা দিয়ে কুদ্দুস মেম্বারের বউ বলে ওঠে, লোকের মতো ফকির না। অন্যের কাছে চেয়ে চিন্তে খায় না। আমার ভাগনের মুখ থেকে নুরের জ্যোতি বেরুয়।
শাহেদের এসব মেয়েলী প্যাঁচাল ভাল লাসে না। তবে দুপুর থেকেই সারাপথে কুদ্দুস মেম্বারের উজ্জ্বল শ্যামলা উচ্ছল মেয়েটিকে দেখে তার ভেতরে অন্যরকম একটি অনুভূতি জন্মেছে। রাতে উঠোনে পাল্টানো পোশাকে মেয়েটিকে আরেক ঝলক দেখে তার মনে হয়Ñ আজ কি পূর্ণিমা তিথি। মেয়েটির সঙ্গে কথা বলতে পারলে সময়টা ভাল কাটতো। তবে এখন তার মায়ের কথা শুনে চোখে মুখে মরিচের জ্বালা অনুভব করে। ‘বর আসছে না, বর কই, কখন আসবে’ সবাই একে অন্যকে প্রশ্ন করছে আর প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। মেয়ে পক্ষের লোক হলেই যত জ্বালা। মনের বিরক্তিও প্রকাশ করা যায় না।
উঠোনে অপেক্ষারত কন্যাযাত্রীদের গুঞ্জণে হঠাৎ জল ঢেলে দিলেন কুদ্দুস মেম্বারের বউ। বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে ঘোষণা দিলেন, সবাই আলহামদুলিল্লাহ বলেন। বর-কনে কবুল বলেছে। মানে? একযোসে সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন সবার। সবার প্রশ্নের নীরব উত্তর হিসেবে তার পেছনে পেছনে হাসিমুখে বেরিয়ে আসে একজন বয়স্ক মৌলভী। বোবা একটি মুহূর্ত কাটানোর পর বুড়ো কন্যাযাত্রীরা আলহামদুলিল্লাহ পড়লেন। এবার নিশ্চয় বরকে দেখা যাবে। আবার সবার মধ্যে বর দেখার কৌতূহল চারিয়ে ওঠলো। দুলাভাই কই, নাতজামাই কই? বুড়োরা আবারও জানতে চাইলেন। শাহেদ আর মোরশেদ ভেবে পায় না, বিষয়টি কি? সে সন্ধ্যা থেকে কন্যাযাত্রীরা অপেক্ষা করছে। কিন্তু গভীর রাতে বাড়ি ফিরে গোপনে বিয়ে পড়লেন বর। শেষ দফা অপমানে লাল হয় কন্যাযাত্রীরা। জয়নালের চোখ দিয়ে টপটপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে।
মোরশেদ হঠাৎ বলে ওঠে, চলো শাহেদ। 
কোথায়?
ফিরে যাই...
কিভাবে?
পূর্বদিকে হাঁটতে শুরু করলে সকাল নাগাদ নানাবাড়ি পৌঁছে যাবো। পারবে হাঁটতে?
শাহেদের মনে হচ্ছিল সে কোন ভুল জায়গায় এসেছে। তাই তার অনিবার্য উত্তর, হ্যাঁ।
কন্যাযাত্রীদের জটলা থেকে ইশারায় মোশতাককে ডাকে মোরশেদ। কাছে আসতেই মোরশেদ ফিসফিসিয়ে বলে, তুমি জয়নালের সঙ্গে থাকো আমরা চললাম। কোথায় যাচ্ছি সেটা জিজ্ঞেস না করেই বোকার মতো ঘাড় নাড়লেন মোশতাক। জামাইবাড়ির উঠোন থেকে বেরিয়ে তারা পূর্বদিকে হাঁটতে শুরু করে। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ আলো বিলাচ্ছে। চাঁদের আলোয় ধুলো ওড়া পথে পা বাড়িয়েই তাদের মনে হয় কোন কনসেনট্রেশন ক্যাম্প থেকে তারা পালিয়ে যাচ্ছেন। ধীরে ধীরে তাদের চলার গতি বাড়ে। পেটের ক্ষুধা-তৃষ্ণা উবে যায়।
প্রথমে শাহেদই মুখ খোলে। আমরা যে চলে এলাম বিষয়টি কেমন হলো?
মোরশেদের সোজা উত্তর- ভাল। ওরা আমাদের খুঁজবেও না।
যে বাড়িতে সন্ধ্যা থেকে এক গ্লাস পানি খেতে দেয়নি তারা আবার আমাদের খুঁজবে।
নিজের এ অতিসামাজিক মনোভাবের জন্য শাহেদের হাসি পায়। কোথাও গেলে তার সবসময় মনে হয় কে কি মনে করছে, কি ভাবছে ইত্যাদি। তবে জয়নালের জন্য তার সত্যি সত্যিই খারাপ লাগে। বেচারা কন্যার ভাই। যেন কত বড় অপরাধ করে ফেলেছে। পদে পদে বন্ধুদের কাছে মুখ ছোট আর তালুই বাড়িতে তাচ্ছিল্যের শিকার হতে হচ্ছে। 
ধীরে ধীরে তাদের গল্প জমে উঠে। দূরত্ব অজানা থাকায় তারা কতটুকু এগুলো তা বুঝতে পারে না। পূর্ণিমা রাতের নানা গল্প ডালপালা ছড়াতে থাকে। পথের দুই পাশের বিচ্ছিন্ন বাড়িগুলোকে আকাশের নিচে বিস্তীর্ণ মাঠে এক একটি স্তূপের মতো মনে হয়।
হাঁটতে হাঁটতেই তাদের সামনে পড়ে মূর্তিমান অজগর। সমুদ্র নালাটিকে শাহেদের বিশাল বিস্তীর্ণ বিলে ছুটে চলা অজগরের মতো মনে হয়। পায়ে জুতো, সামনে খাল। দু’জনই গ্রামের ছেলে। খাল পেরুনোর বিস্তর অভিজ্ঞতা। তারপরও তারা এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়ায়। মোরশেদ দ্রুত প্যান্ট তুলে খালে নেমে পড়ে। তবে কয়েক কদম এগুতেই গভীর কাদায় তার পা দেবে যায়। অবস্থা বেগতিক দেখে শাহেদ তাকে টেনে তুলে। কাদামাখা পায়ে রাস্তায় ওঠেই তারা হঠাৎ হাসিতে গড়িয়ে পড়ে। তারপর দক্ষিণমুখী হাঁটা শুরু করে।

চ.
শার্টপ্যান্ট ইন করা মোরশেদকে হাতে জুতো নিয়ে হাঁটতে দেখে শাহেদের বেশ মজা লাগে। গভীর রাত, দেখার কেউ নেই। কিছুক্ষন হাঁটার পর দূর থেকে রাস্তার পাশে একটি বাড়ির উঠোনে কুপি বাতি জ্বলতে দেখা যায়। কাছে গিয়েই মোরশেদ জানতে চায়, বাড়িতে কেউ আছেন? সঙ্গে সঙ্গেই উঠোনের এক কোন থেকে সাড়া মিলে। একটি বুড়ো লোক হাঁক দেয়- কে?
সহজ সরল গ্রাম্য মানুষের সঙ্গে সহজ উত্তর দেয়াই ভাল। চাতুর্যপূর্ণ উত্তর আবার কোন বিপদ নিয়ে আসে। তাই মোরশেদ বলে- আমরা পথিক। 
বুড়োটি এবার তার ছেলেকে ডাক দেয়, দেখতো বশির কারা।
এবার বশির নামের মধ্যবয়সী লোকটি তাদের কাছে এসে কিছুটা অবাক হয়।
আপনারা কারা? কোথায় যাবেন?
বাড়ি বিলপুকুরিয়া। রাজাখালী বেড়াতে গিয়েছিলাম।
এতরাতে কোথায় যাবেন?
জরুরি বাড়ি ফিরতে হচ্ছে, একটু খালের পুলটি দেখিয়ে দেবেন?
বশির দক্ষিণদিকে আঙুল উঁচিয়ে বলেন, সামনে হাঁটতে থাকেন।
বশিরদের বাড়ির উঠোনের পুকুর থেকে পায়ের কাদা ধুয়ে নেয় মোরশেদ।
বাঁশের সাকো পার হয়ে তারা খাল পার হয়। এবার নদীর ওপার দিয়ে যত পথ হেঁটেছিল ঠিক তত পথ উল্টো উত্তর দিকে হাঁটে। পূর্বপাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে পশ্চিম পাড়ে ফেলে আসা বিয়েবাড়ির কথা মনে হচ্ছিল শাহেদের বারবার। খালপাড়ের পথে বাঁশবন, শো শো শব্দ। কোন পথে যাবে সেটা নিয়ে দু’জনের দ্বিধাদ্বন্দ্ব।
আবার পূর্ব দিকে হাঁটা। প্রথম পাড়াটি অতিক্রমের সময় বাড়ির লোকজনের গলা শোনা যাচ্ছিল। একটি শিশুর কান্না আর তার মায়ের আদর কানে আসে। রাস্তার পাশে মসজিদের নলকূপ থেকে পানি খায় তারা। কিছুক্ষণ বেঞ্চিতে বসে বিশ্রাম নেয়। পাড়ার আঁকাবাঁকা মেঠোপথ ধরে তারা আবার হাঁটা শুরু করে। কিছু দূর উত্তর দিকে হাঁটার পর তারা মাঠের মধ্যখান ধরে পূর্বদিকে চলে যাওয়া একটি বড় আলপথে নেমে পড়ে। কিছুদূর যাওয়ার পর দ্বিতীয় পাড়াটি শুরু হয়। আবারও ধান কাটা ধুঁ ধুঁ মাঠ। মাঝে মাঝে কিছু জমিতে এখনও পাকা ধান কাটা হয়নি। শুক্লপক্ষের কোমল আলোতে আবছা কুয়াশা ছড়িয়ে পড়ছে আবিরের মতো। চাঁদটা যেন অভিজাত গৃহিণীর মতো গলে গলে পড়ছে সম্ভ্রমে। সারিবদ্ধ নাড়ার ডগাগুলো ঊর্ধ্বমুখী হয়ে সাজিয়ে তুলেছে বিস্তীর্ণ মাঠ। সৃষ্টি করেছে এক অপূর্ব ব্যঞ্জনা। আঁকাবাঁকা আলগুলো যেন সহমর্মিতায় পরস্পর হাত ধরাধরি করে নিশ্চুপ শুয়ে আছে। পূর্ণিমার হলুদ আলোয় ধানকাটা মাঠের অপূর্ণ দৃশ্য তাদের মাথা ধরিয়ে দেয়। তাদের ডানপাশের একটি বাড়ির আঙ্গিনায় হঠাৎ কয়েকটি পাটি সশব্দে ডানা ঝাঁপটে ডাল পরিবর্তন করলো। শাহেদ গান ধরে...।
ধু-ধু মাঠে হঠাৎ দুটো টর্চের তীব্র আলো তাদের চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। মুহূর্তেই দু’জনের শিরদাঁড়া বেয়ে একটি ভয়ের স্রোত নেমে যায়। বিস্ময়াবিভূত হয়ে তারা থমকে দাঁড়ায়। দূর থেকে কড়া প্রশ্ন আসে- এ কে রে তোরা?
আমরা পথিক...
এদিকে আয়... কড়া ডাক।
তারা ধীরে ধীরে আলোর উৎসে গিয়ে নিজেদের পরিচয় দেয়। তখনো তাদের দৃষ্টি স্বাভাবিক হয়নি। ষণ্ডা প্রকৃতির একজন চোখ রাঙিয়ে তাদের প্রশ্ন করে- তোরা কারা? কোথায় যাবি?
বিলপুকুরিয়া... মোরশেদের নি®প্রান উত্তর।
আরেকজন বলে উঠে- শালাদের আসে বেঁধে ফেল।
প্রথম লোকটি বলে- দরকার নেই।
এরই মধ্যে তাদের কয়েকজন শাহেদ ও মোরশেদকে ঘিরে ফেলে। মাপলার ও মুখোশে মুখ ঢাকা এসব লোকের চেহারা দেখা যায় না। তবে বুঝতে বাকি নেই লোকগুলো ডাকাত। একজনের হাতে একটি দোনলা বন্দুক। দু’জনের মুখ থেকে কোন কথা সরে না। থ হয়ে পড়া মোরশেদের প্রতি নতুন প্রশ্ন- এতরাতে কোথা থেকে আসছো ?
রাজাখালী থেকে।
এতরাত কেন?
পাশ থেকে আরেকজন তাড়া দেয়- টাইম নেই। শালাদের বেঁধে ফেলে রেখে চল যাই।
মোরশেদ ষণ্ডামার্কা লোকটিকে অনুনয়ের সুরে বলে- কাল আমাদের পরীক্ষা।
মোরশেদ বানিয়ে রাখা গল্প শুরু করে- আমরা একটি বিয়ে বাড়িতে গিয়েছিলাম। হৈ হুল্লোড়ে দেরি হয়ে গেছে। পরে গাড়ি মিস করে অনন্যোপায় হয়ে হেঁটেই বাড়ি ফিরছি। আগামীকাল দুপুরে আমাদের পরীক্ষা আছে। সকাল সকাল চট্টগ্রাম শহরে ফিরতে না পারলে পরীক্ষা দিতে পারবো না।
কোথায় পড়ো? এবার কণ্ঠ কিছুটা নরম...
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে...
এতক্ষণ নীরব ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা শাহেদকে ডেকে প্রশ্ন করে- এ তোর বাড়ি কই?
বিলপুকুরিয়া...
শার্ট-প্যান্ট পরা দু’জন তরুণকে দেখে ডাকাতরা দ্বিধাদ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে। একেক জনের একেক মত। ষণ্ডামার্কা লোকটি এক মুহূর্ত কি যেন ভাবলেন। এদিকে তার সঙ্গীদের ঘন ঘন তাড়া আসছে। এবার লোকটি তাদের ইশারায় মাঠের কোনাকুনি পথ দেখিয়ে দিয়ে বলেন- ওদিকে চুপচাপ হাঁটতে থাক। কোন শব্দ করলে গুলি করবো। বুঝছিস...। মোরশেদ একটি ঢোক গিলে বলে- জ্বি।
ডাকাতরা তাদের ভুল পথে ফসল তোলা মাঠের দিকে চলে যেতে বলে। ডাকাতদের ইশারা করা পথে তারা মাঠের কোণাকুনি হাঁটতে শুরু করে। ভয়ে একটি বারের জন্যও পেছনে তাকায় না। শাহেদের মনে হয়- এই বুঝি একটি গুলি তাকে ভেদ করে ছুটে গেল। ভয়ে জমে যাওয়া পাথরের মতো ভারী পায়ে হাঁটা পথ যেন হাজার মাইলের ফুরোবেই না। একটি নাড়ার ডগা শাহেদের জুতার পাশ দিয়ে পায়ে বিদ্ধ হয়। আহ্ শব্দে শাহেদ বেদনা প্রকাশ করতেই শাহেদ মৃদু স্বরে তাড়া দেয়। আরেকটু জোরে...। শাহেদ ভাবে সুযোগ পেয়ে সদ্য কাটা ধানের নাড়াগুলোও যেন প্রতিশোধ প্রবণ হয়ে ওঠেছে।
কোনাকুনি মাঠ ধরে কিছুদুর সামনে যেতেই বিচ্ছিন্ন কয়েকটি বাড়ি চোখে পড়ে। বাড়িগুলো পার হতে না হতেই পেছন দিক থেকে গুলির শব্দ আসে। হৈ চৈ ও চিৎকারের শব্দ আসে। দ্বিতীয় গুলির শব্দের সঙ্গে সঙ্গেই পাড়ার কুকুরগুলো একযোসে ডেকে ওঠে। তারা আবারও থমকে দাঁড়ায়। বেকুবের মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। অজানা আশঙ্কা তাদের গ্রাস করতে চায়। আবার অতিসন্তর্পণে হাঁটা ধরে। তারা এতই সন্তর্পণে বিড়ালের পায়ে হাঁটে যে, যেন তাদের পায়ের শব্দে পাড়ার লোকের ঘুম ভেঙে যাবে। গ্রামবাসী জেসে ওঠে তাদের ডাকাত সন্দেহ করে পিঠিয়ে হাড্ডি ভেঙে দেবে।

ছ.
কত দূর এলাম... শাহেদের কণ্ঠে কৌতুহল।
মনে হয় টৈঠংয়ের কাছাকাছি... মোরশেদের নির্লিপ্ত উত্তর।
আর কতদূর...
মাইল দশেক হবে হয়তো..
আকস্মাৎ আলের উপর দিয়ে নাড়ায় শব্দ তুলে কি একটি যেন শোঁ শোঁ শব্দ করে ছুটে গেল। শাহেদের বুকের ভেতর ভয়ের শিহরণ জাগে। আস্তে মোরশেদ... কি যেন ছুটে গেল।
সাপ হয়তো...
ওরে বাপরে... সাপ! শাহেদের গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়। কণ্ঠে স্পষ্ট ভয়ের রেশ।
ভয় পেয়েছেন?
পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ভয় পাই ওই সাপ খোপ।
দুই জন আছি ভয় করবেন না।
অন্য ভয় নয়, তবে সাপের কথা আলাদা। এবার মোরশেদ হো হো করে হেসে ওঠে। এখন আর ভয়ের কারণ নেই। পেছনের ডাকাতদল অনেক দূরে ফেলে এসেছি।
সামনে... শাহেদের কণ্ঠে নতুন আশঙ্কা।
সামনে বারবাকিয়া বাজারের পশ্চিমের জঙ্গলপথেও ডাকাতি হয়। তবে একদলকে যেহেতু পেছনে ফেলে এসেছি তাই সামনে আরেকদল পড়বে বলে মনে হয় না।
সামনে পড়লেও সে পুরনো গল্প...এবার এতক্ষণ ভয়ার্ত শাহেদও হেসে ওঠে। সাপের ভয় ও রাতের গল্প... ধুলোময় মেঠো আলপথ ধরে হাঁটতে ভালই লাগছে। মন থেকে ধীরে ধীরে কেটে গেছে ডাকাতের ভয়। বিল পেরুতেই হঠাৎ একটি উঁচু খোয়াভাঙা পথের এসে তারা ওঠে। মোরশেদ চিনতে পারে। পথটি উত্তরে টৈটংয়ের দিকে চলে গেছে। এবার টৈটংয়ের খোয়া ভাঙা পথ ধরে অগ্নিকোনামুখী তারা হাঁটতে থাকে। ততক্ষণে আবার খুলে গেছে গানের গলা।
হাঁটতে হাঁটতে আবার নিকষ অন্ধকার। দুইধারে গা ছমছম করা জঙ্গলাকীর্ণ নিঃশব্দ নির্জন পথ। শেয়ালের হুক্কা হুয়া ডাক, বুনো পশুপাখির সশব্দ পদচারণা, ডালে ডালে পাখিদের ডানা ঝাপটানি তাদের মনে আবারও ভয় ধরিয়ে দেয়। জঙ্গলের পথে এগুতেই উঁচু ও ঘন গাছপালার কারণে চাঁদের আলো অতিম্লান হয়ে ঝরে। ফলে চারদিক থেকে নিকষ অন্ধকার তাদের গিলে খেতে চায়। যেন কোন নির্জন প্রেতপুরীতে এসে পড়েছেন। শাহেদ ভয় তাড়াতে গল্প শুরু করলেও মোরশেদ দোয়া দরুদ... পড়তে থাকে।
পাহাড়ি নির্জন পথ অতিক্রম করে তারা বারবকিয়া বাজারে এসে পৌঁছে। তখন ফজরের আযান পড়ে পড়ে সময়। তারা বাজারের একটি খোলা চকিতে বসে বিশ্রাম নেন। পা এগুনো যাচ্ছে না। ক্ষুধায় অর্ধেক হয়ে গেছে দু’জনেই। ভেতর থেকে বন্ধ একটি মুদি দোকানের কড়া নাড়ে। ভাই ভেতরে কেউ আছেন? কোন সাড়া শব্দ নেই। মনে হয় ভেতরে কেউ নেই।
ভেতরে কেউ আছেন?
কে? ভয় এবং গাম্ভীর্যময় ঘুম জড়ানো স্বর।
মোরশেদ নিজের পরিচয় দিয়ে বলে- ভাই আমরা খুবই ক্ষুধার্ত। দোকানে কি বিস্কুট আছে?
এরই মধ্যে ভেতরে কুপি জ্বলে উঠে। একটু পর দোকানের কাঠের একটি পাল্লা খুলে বেরিয়ে আসেন দোকানি সোলেমান। হাতে তার দীর্ঘ উলঙ্গ ধারালো কিরিচ। কিরিচ হাতে দোকানদারকে বেরুতে দেখেই ভয়ে সেটিয়ে যায় শাহেদ। পরক্ষণেই আনমনে হেসে ওঠে। বেচারা নিশ্চয় তাদের ডাকাত-টাকাত ভেবেছে। সোলেমানও শার্ট প্যান্ট পরা দুই তরুণকে দেখে কিছুটা ভড়কে যায়।  
এত রাতে কোথা থেকে আসছেন?
মোরশেদ চতুর্থবারের মতো বানানো গল্প শুরু করে...
বাজারের মসজিদের মুয়াজ্জিনের গলা শোনা যাচ্ছে। বাজারের কুকুরগুলোও জেসে ওঠেছে। কোন একটি বাড়ি থেকে একটি মোরগ বাক্ দিয়ে ওঠল। সোলেমান সওদাগর দুই প্যাকেট বেকারীর বিস্কুট বের করে দেয়। সঙ্গে একটি পানির গ্লাসও। শাহেদ নতুন হলেও মোরশেদের পরিচিত এ বাজার। সে বাজারের নলকূপ থেকে পানি নিয়ে আসে। সত্যি সত্যিই তাদের প্রচুর ক্ষুধা পেয়েছে। এতক্ষণ বুঝতেই পারেনি ভয়ে এবং উত্তেজনার চোটে। দুই প্যাকেট বিস্কুট শেষ করে পানি খেয়ে তারা বাজারের খোলা চৌকিতে বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়। তখন চারদিকে আযান শুরু হয়ে গেছে। দু’একজন করে মুসল্লিরা ঘুম ভাঙা চোখে মসজিদের দিকে ছুটছে।
এখন আর তাদের পা চলছে না। ক্ষুধার্ত অবস্থায় সারারাত হাঁটার পর পেট ভরে বিস্কুট আর পানি খাওয়ায় তাদের শরীরে ক্লান্তি নেমে আসে। শাহেদের পা ব্যথা করছে। মনে হচ্ছে, দু’পায়ে কেউ ভারী পাথর বেঁধে দিয়েছে। সেই সঙ্গে একটি বিজয়ের স্ফুর্তিও অনুরণন তুলছে স্নায়ুতে। মোরশেদ খেয়াল করে অদূরেই চ্যাপ্টামুড়ার শীর্ষে উঁকি দিচ্ছে নতুন দিনের রক্তাভ আভা।

kafi_bd80@yahoo.com

Sunday, January 22, 2012

উল্টোযাত্রা - কাফি কামাল

উল্টোযাত্রা
কাফি কামাল
....................
কাফ্রির মতো ঘন কালো রাত্রীর হৃদয় ধরে দিলবেজার বানু বিড়াল পায়ে হেঁটে চলছেন। গন্তব্য তার পদুয়ার হাতির দীঘি। বাপের বাড়ি, ঠাণ্ডা মৌলভির ঘর। মেঠোপথের দুইপাশে কালো কালো স্তুপের মত ঝোপঝাড়। নানা রকম পোকা মাকড়ের বিদঘুটে আওয়াজ একটি ভৌতিক আবহের সৃষ্টি করছে। মুখে তার আল্লাহ-রসুলের পাক কালাম আর কাঁধে বিয়াল্লিশ সেরের যমদূত; বেটে মৌলভি। পরণে জোলার শাড়ি, চরণে রেঙ্গুনের চপ্পল।
সুখছড়ির বেটে মৌলভির বাড়ি থেকে হাতির দীঘির ঠাণ্ডা মৌলভির বাড়ির দূরত্ব পাক্কা সাড়ে তিনমাইল। দূরত্বের একপ্রান্তে বটবৃক্ষের স্নিগ্ধ আশ্রয় অন্যপ্রান্তে গরম তাওয়ার উষ্ণতা। মধ্যখানে বয়ে গেছে খরস্রোতা টংকাবতী নদী।
সাদী মোবারকের একযুগ ধরে প্রতিটি ক্ষণ দিল বেজার বানু তা হাড়ে হাড়ে অনুভব করেছে। বারবার মনে পড়ে সুখছড়ির বেটে মৌলভিকে কবুল বলার সে চুপচাপ জবরদস্তির কথাটি। শ্বশুরবাড়ির প্রথমদিন থেকে গরম তাওয়ায় ভাজা লালমরিচের মত পুড়ে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছেন। কিন্তু নিয়তির পরশ পাথরের অপেক্ষায় কেটে গেছে দীর্ঘসময়। এরই মধ্যে তার নাড়িছেঁড়া ধন মোহাম্মদ শাকুরের বয়স এগারো পূর্ণ হয়ে বারোতে পড়েছে। বিয়ের ১১মাসের মাথায় দিল বেজারের কোল আলো করে এসেছিল শাকুর।
বিয়ের পর মেয়েরা পায় একজন মাতৃতুল্য শাশুড়ি। কিন্তু দিল বেজারের কপালে আল্লাহপাক লিখে দিয়েছেন একটি কুটনি বুড়ি। সে কুটনি বুড়ির ঘেরোবন্দী হন ঠাণ্ডা মৌলভির শান্ত স্বভাবের মেয়েটি। কথায় কথায় ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, অবহেলা। শাশুড়ির তাচ্ছিল্য দিয়েই শুরু হয় তার সংসার জীবন। গভীর রাতে ওয়াজ মাহফিল থেকে বাড়ি ফিরেন বেটে মৌলভি। ফেরা মানেই কুটনি বুড়ির হঠাৎ নাকিকান্নার সুর ওঠা, মায়ের কান্নায় মৌলভির তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠা। তারপর চারফুট উচ্চতার মাওলানা আবদুস সালাম ওরফে বেটে মৌলভির বিচারসভা। ছেঁড়া জুতা জোড়া থেকে পুরোনো ঝাড়–র উপুর্যুপরী আঘাত। অবশেষে দিল বেজারের রক্তাক্ত দেহ, বিছানায় ছটফট করার দৃশ্য। যদিও দিল বেজারের আব্বাজান নেয়ামত উল্লাহ ওরফে ঠাণ্ডা মৌলভির বিবেচনায় এটা একটি শয়তান বিতাড়ন প্রক্রিয়া। তিনি দিলকে বারবার সান্তনা দেন, স্ত্রীর শরীরে যেখানে স্বামীর আঘাত লেগেছে সেখানে দোযকের আগুন স্পর্শ করবে না। সত্যিই কি তাই! তাহলে তো দোজকের আগুনে দিল বেজারের খুব একটা কষ্ট হবে না। এতটুকু মেনে নিলেও শেষ রাতে বিক্ষত শরীর নিয়ে বেটে মৌলভির একতরফা নির্যাতনে সে সত্যিই বেদনাহত হয়েছে। ফুলে ওঠা স্থানে দোযকের আগুন স্পর্শ না করার একটি বিশ্বাসগত সম্ভাবনা থাকলেও মৌলভির স্পর্শ নির্যাতন থেকে রেহাই মিলেনি।
বাবা-মা’র আদরের মেয়ে দিল খোশ বানু এক সময় হয়ে ওঠেছে বেটে মৌলভির দিল বেজার। এখন সে সত্যিকারেরই দিল বেজার। বিয়ের দীর্ঘ এক সময়েও কখনো বিজলীর মত দুই একটি মুহুর্ত ছাড়া দিল তার বেজারই থেকেছে। খোশ হয়ে ওঠতে পারেনি। তার বেদনার্ত গুমড়া মুখের দিকে তাকিয়ে এক ভোর বেলা তাকে এ অপবাদই দিয়েছে বেটে মৌলভি। সে থেকেই দিল খোশ বানু হয়ে ওঠেছেন দিল বেজার ওরফে দিল বেজু।

খ.
অগ্রহায়নের শেষ সপ্তাহেই ঝেকে বসেছে পৌষের শীত। কৃষকের ধান কাটা প্রায় শেষ। নতুন ধানের ধেনো গন্ধে মৌ মৌ করছে চারদিক। চাষা ভুষো গ্রামীণ মানুষ আল্লাহর শোকর জানাতে পাড়ায় পাড়ায় ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করছে। পাড়ায় পাড়ায় মসজিদ মাদ্রাসায়গুলোর কোষাগার ফুলে ফেপে স্ফিত হচ্ছে। নাখোদা’রা বলে, অগ্রহায়ন হচ্ছে মসজিদ মাদ্রাসার কোষাগার স্ফীতির মওসুম। মৌলভির ওয়াজে ধর্মীয় গল্প বলার ফাঁকে-ফোঁকরে দরাজ গলায় লোকজনের কাছে চাদা তুলছে। মারহাবা মারহাবা শব্দে বাড়ছে চাঁদার পরিমান আর মহিমা। কেউ নতুন ধান বিক্রির কড়কড়ে নোট, কেউ বা আড়ি আড়ি ধান চাউল দান করছে। মৃত বাবা-মা আত্মার শান্তি কামনা, সংসারের সুখ সমৃদ্ধি ও দোজাহানের নেকি অর্জনে সবাই এখন কম বেশি উদার হস্ত। এলাকার উঠতি পয়সাওয়ালারা তো রীতিমতো প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠেন। এ সময় ঘন ঘন ওয়াজের দাওয়াত আসে মৌলভির। দিনে দু’তিনটিও থাকে। নজরানাও কম নয়। এক একটি ওয়াজের জন্য তাকে দিতে হয় হাজার টাকা। ভাল মানের খাবার দাবার তো আছেই। কেউ কেউ যাতায়াতের জন্য রিক্সার ও ব্যবস্থা করেন। তিন চার ক্রোশ দূর থেকে বেটে মৌলভির ওয়াজের দাওয়াত আসে। এ সময় কাপড়-চোপড়ে একটু যতœবান হতে হয়। তাই ইস্ত্রির ভাজ দেয়া পাঞ্জাবী ছাড়া ওয়াজ মাহফিলে যান না বেটে মৌলভি। সেদিন সুখছড়ি ওয়াজ মাহফিলে গিয়ে খাবার সময় আর্দি কাপড়ের পাঞ্জাবীতে গরুর গোশতের ঝোল পড়ে দাগ হয়ে যায়। তাই দাগ উঠাতে সেটি বাজারের লণ্ড্রিতে দেয় মৌলভি। আরেকটি পাঞ্জাবী আধোয়া। সেদিন সকালে মাদ্রাসায় যাওয়ার সময় মৌলভি দিল বেজারকে কড়া নির্দেশ দেয়। দিল বেজু- আমার কোর্তাটা ধুয়ে রাখবা। বিকালে ওয়াজে যেতে হবে। সেখান থেকে রাতে আরেকটি দাওয়াত আছে। কিন্তু সারাদিন বাড়ির কাজে দিল বেজু কোর্তা ধোয়ার কথা ভুলে যায়। দুপুরে মাদ্রাসা থেকে বাড়ি ফিরে মৌলভি দেখে যেখানের কাপড় সেখানেই আছে, ধোয়া হয়নি। দেখেই মাথায় রক্ত ওঠে যায় তার। মুখ দিয়ে গালির ফোয়ারা ছুটে- ওই খানকি মাগির ঝি, কি বলে গিয়েছিলাম মনে নেই।
দিল বেজু হন্তদন্ত হয়ে রান্নাঘর থেকে ছুটে আসে। কি হয়েছে?
তোর মাকে .....।
এভাবে কুত্তা বিলাইয়ের মত গালি দিচ্ছেন কেন।
জানিস না- তোরে যে ওয়াজের সুরে কোর্তা ধুইতে বলেছিলাম।
ততক্ষণে শুরু হয়ে যায় চুল ধরে মারপিট। দিল বেজু সহ্য করতে পারে না। সে ভুল করেছে সত্য তবে ঘরে তো আর বসে ছিল না। বাড়িতে মেহমান এসেছে। তাদের জন্য রান্নার পাশাপাশি বাড়ির ভেতর ধান চালের মওসুমী কাজ তো আছেই।
মুখের গালি আর হাতের ঢালি খেয়ে, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে দিল বেজার বানু। দুপুরে বেতের বাড়ি হজম করতে করতে সে বলেই ফেলে- আমি আর আপনার ঘর করবো না। আপনার ঘরে থাকবো না।
কোন নাগরের কাছে যাবি? বেটে মৌলভির শ্লেষ।
অত আর আল্লাদ নেই।
তাহলে কোথায় যাবি- হারামজাদি।
মুখ সামলে কথা বলেন। আব্বাজানের গজব পড়বে।
খানকি তুই তালিম দিস না। বেটে মৌলভি আরেক ঘা লাটির আঘাত করে।
কোথায় কোন বারাম খানায় যেতে চাস বল।
বাপের বাড়িই যাব। আপনারে ঘুমে রেখেই যাব। নিবুর্দ্ধিতা করে নিজের গোপন পরিকল্পনাটি ফাঁস করে দেয়- দিল। তবে চালাক বেটে মৌলভি সতর্ক হয়ে পড়ে। লোকে তো এমনি বলে না- ‘বেটে হচ্ছে শয়তানের লাঠি।’ দেহে যারা বেটে বুদ্ধিতে সে তারা দীর্ঘ। ফলে মৌলভি বুঝে নেয়- এবার একটা অঘটন ঘটবে। খাঁচার পাখির মুখে বোল ফুটেছে। এবার উড়াল দিতে চাইবে। কয়েকদিন আগের কথাগুলো এবার ভাবতে থাকে মৌলভি।

সবকিছুতেই শাকুরের কৌতূহল। সবকিছুই যেন তাকে বুঝতে হবে, জানতে হবে। কিছুদিন আগে জেটাতো ভাইয়ের সাইকেল নিয়ে সে হঠাৎ উধাও হয়ে যায়। সে যে সাইকেল চালাতে পারে সেটাই বাড়ির কেউ জানতো না। সাইকেল খুঁজে না পেয়ে শাকুরের জেটাতো ভাই গফুর যখন গালাগালি করতে করতে খুঁজছে তখনই খবরটি পাওয়া গেল। উত্তরপাড়ার করিম সরকার জানালো, তিনি নিজের চোখে দেখেছেন। শাকুর কাত হয়ে হয়ে সাইকেলের প্যাডেল মেরে উত্তরদিকে চলে গেছে। করিমের কথা শুনে সবাই অবাক। শাকুর সাইকেল চালাতে শিখলো কখন? কেউতো শাকুরকে চালানো শেখায়নি। সবার মুখে জিজ্ঞাসা? সে প্যাডলের নাগাল পায়তো?
এরই মধ্যে করিম অদৃশ্য সাইকেল চোরের জ্ঞাতিগোষ্ঠী তুলে গালাগালি করেছে। এখন খবর পাওয়ার পর সে লজ্জিত মুখে উত্তরদিকে হাঁটা দিল। করিম সরকারের কথায় দিল বেজার বানুর মনটা দ্বিখণ্ডিত হয়ে পড়েছে। একমনে ছেলের সাইকেল চালনা শেখার কৃতিত্বে আনন্দিত অন্যমনে গফুরের গালাগালিতে ছেলের প্রতি ক্ষোভ দানা বাঁধছে। গফুরের গালিগুলো তার অন্তরে এসে বিধঁছে। যদি ছেলের একটি সাইকেল থাকতো তাহলে নিশ্চয়ই তাকে এভাবে গালি শুনতে হতো না। নানা কাজে এদিক ওদিক পাঠানোও যেতো।
খানিকক্ষণ পর শাকুরকে পাওয়া গেলো কাজির বিলে। সাইকেলে শরীর বাকিয়ে প্যাডল মারছে আর কখনো হাত ছেড়ে দিচ্ছে কখনো পা প্যাডল থেকে তুলে নিচ্ছে। গফুর তাকে ডাক দেয়- এ্যাই শাকুর। গফুরকে দেখেই অবশ্যই শাকুর সাইকেল দাঁড় করিয়ে কাঁপতে থাকে। তবে গফুর তাকে কটু কিছু বলে না। শুধু মিষ্টি হেসে বলে- এ্যাই বজ্জাত বলে আনতে পারতি না। শাকুর লজ্জা ও ভয়ে নিশ্চুপ। এতক্ষণ পর বুঝতে পারছে সে খুব একটা অপরাধ করে ফেলেছে।
রাতে বাড়ি ফিরেই আগুন চোখে বেটে মৌলভি ছেলেকে ঘুম থেকে তুলে। কোন কৈয়ফিত জানতে না চেয়েই চড়-থাপ্পড়ে শাকুরের গাল লাল করে ফেলে। ঠোঁট ফেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোয়। সহ্য করতে না পেরে দিল বেজার বানু ঠেকাতে যায়।
কি করছেন আপনি। ছোট্ট অপরাধে এমনভাবে পেঠাতে হয়।
মুখে কোন কথা নয়, সঙ্গে সঙ্গে শাকুরকে ছেড়ে দিল বেজারকে পেঠাতে শুরু করে মৌলভি।

টানা তিনদিন জ্বরে ভোগার পর বিছানা ছাড়ে শাকুর। ছেলের ফ্যাকাসে মুখ দেখে মায়ের মন মানে না। দিল বেজারের চোখ দিয়ে শ্রাবণের বারি ঝরেছে এইতিনদিন।
ছেলে সুস্থ হওয়ার পর একদিনে দিল বেজার স্বামীর কাছে একটি আবদার করে বলে- একটি কথা বলব, রাখবেন?
কি কথা- মৌলভির কণ্ঠে কোমলতা।
ভরসা পেয়ে দিল বেজার আর্জিটা পেশ করে- আমাদের শাকুরকে একটি সাইকেল কিনে দেন না।
শুনে মুহূর্তের মধ্যেই রেগে আগুন হয়ে ওঠে মৌলভি। তার মুখ দিয়ে বেরুতে থাকে, রাগের লাভা। তপ্ত এবং হন্তারক। খানকি, বৈতাল- ছেলেকে গাণ্ডু বানাতে ছাস। আবার বলবি তো, চুলের ঝুঁটি ধরে হাতিরদীঘি পাঠাব।
দিল বেজার স্বামীর মেজাজের আকস্মিকতায় খানিকটা ভড়কে যায়। পরক্ষণে তার মনটা খুবই খারাপ হয়ে যায়। প্রায়ই সে এটা-ওটা আবদার করে না। বাড়ির প্রয়োজনীয় জিনিষের বাইরে কবে কি আবদার করেছিল তার মনেই পড়ে না। তাই এক পর্যায়ে তার জেদ হয়। যাই হোক, যেভাবেই হোক ছেলেকে সাইকেল সে কিনে দেবেই।
কয়েকদিন পর জীবনে প্রথমবারের মতো চুরি করে দিল বেজার। পাড়ার সোলায়মানকে দিয়ে গোলা থেকে ধান নামিয়ে গোপনে বিক্রি করে। সোলায়মান তিনটি পাঁচশ টাকার নোট তার হাতে গুঁজে দেয়। বাড়ির খরচ থেকে বাঁচিয়েও সে বাড়ির বাঁশের খোড়লে কিছু টাকা জমিয়েছিল। খোড়ল কেটে নানা অংকের নতুন-পুরোনো নোট মিলিয়ে দেখে আটশ ঊননব্বই টাকা জমেছে। সে এরই মধ্যে খবর নিয়ে দেখেছে একটি মাঝারি উচ্চতার সাইকেল কিনতে দুইহাজার টাকা লাগে। এই কয়দিন স্বামীর কাছে যতই অপমানিত হোক না কেন তার চোখে ভেসেছে একটি দৃশ্য। শাকুর সাইকেল চালিয়ে মাদ্রাসায় যাচ্ছে আর বাতাসে ওড়ছে তার পাঞ্জাবীর খুট।
পরদিন ভাসুরপুত গফুরকে আমিরাবাদ পাঠিয়ে একটি সাইকেল নিয়ে আসে। লাল রঙের ফনিক্স সাইকেল। সাইকেল পেয়ে শাকুরের আনন্দ যেন আর ধরে না। সাইকেল নিয়ে সে উঠোন পেরিয়ে রাস্তার দিকে চলে যায়। সেটা দেখে দিল বেজারের মন বহুদিন পর খোশ হয়। নিজের আসল নামের কথা তার মনে পড়ে। মুহূর্তের তার মুখ দিয়ে ফিক করে হাসির শব্দ বেরুয়।
সকালে ঘরের দাওয়ায় নতুন সাইকেল দেখে অবাক হয় মৌলভি। খর্বত্বের কারণে নিজের সাইকেল চালানো শেখা হয়ে ওঠেনি। তার ছেলে সাইকেল চালাবে তার সামনে দিয়ে! মৌলভি কল্পনাই করতে পারছে না।
দিল বেজারকে হাঁক দেয়- এই দিল বেজু, এদিকে আয়।
দিল সামনে আসতেই সাইকেল দেখিয়ে মৌলভির প্রশ্ন- এটি কার?
মুখে হাসি ফুটিয়ে দিল বেজার বলে- শাকুরের জন্য কিনে আনিয়েছি।
কে কিনে দিয়েছে?
জ্বি, আমি কিনে আনিয়েছি, গফুরকে দিয়ে।
বৈতাল তুই, টাকা কোথায় পেলি? মৌলভির মেজাজ চড়তে শুরু করেছে।
হাতে কিছু টাকা ছিল আর...
আর কি?
কয়েক আড়ি ধান বিক্রি করেছি।
দিল বেজুর কথা শেষ হওয়ার আগেই ‘ছেলেকে গাণ্ডু বানানোর পায়তারা করছিস’ এই স্বগোক্তির করতে করতে মৌলভির হাত-পায়ের ব্যবহার শুরু হয়ে যায়। সেই সঙ্গে যা তোকে আমি ‘এক তালাক’ দিলাম বলে মৌলভি এ সংক্রান্ত তিনটি শক্তির একটি ব্যয় করে ফেলেন। এখনও তার হাতে দুইটি শক্তি, দিল বেজুর সামনেও দুইটি রক্ষা কবচ। শব্দটি আর মাত্র দুইবার উচ্চারণ করলেই মৌলভি হারাবেন তার ক্ষমতা আর দিল হারাবেন তার স্ত্রী পরিচয়। তবে দ্রুত সামলে নেন মৌলভি। দুপুরেই তিনি সাইকেলটি দুইশ টাকা বাট্টা দিয়ে ফেরত দিয়ে আসেন। সারাদিনের পিটুনী আর গালাগালির চেয়ে এ বিষয়টিই বেশী কষ্ট দেয় দিলকে। সংসারের পাক্কা একযুগের ভিত যেন দ্রুতই ক্ষয়ে যেতে থাকে।
দিল বেজারের মন আবারও দ্বিখণ্ডিত হয়। একদিকে সংস্কার অন্যদিকে স্বাধীনতা। স্বামীর বাড়ি ছেড়ে বাপের বাড়ি গেলে লোকে মন্দ বলবে। সবচেয়ে বড় কথা বাবা কষ্ট পাবেন। মৃত্যুপর পর আল্লাহর শাস্তি নিয়েও সে দ্বিধান্বিত। কি জবাব দেবেন আল্লাহকে। মৌলভি তো শুধু নির্যাতনই করে না। মাঝে মধ্যে আদরের আতিশয্যও দেখায়। কথাটি ভাবতে ভাবতেই তার চোখে ভেসে ওঠে বহু স্মৃতি।
ওয়াজ মাহফিল থেকে ফেরার সময় বহুদিন বহু জিনিষ নিয়ে এসেছে তার জন্য। কখনো কমলা-আপেল, কখনো বা পোটলা বেঁধে তরকারি। আবার সেসব তিনি দিল বেজারকে খাইয়ে দিয়েছেন নিজ হাতে। খুব মজা করে, আদর করে। স্বামী হিসাবে মৌলভি একরোখা। বিয়ের পর থেকে কেবল অপবিত্রের মওসুম ছাড়া দিলকে কখনো নিস্তার দেননি মৌলভি। বহুবার রাতে মৌলভির অতি আদরে সৃষ্ঠ মুখের দাগগুলো ঢাকতে দিল বেজুকে মুখে শাড়ির আচল পেচিয়ে বাড়ির কাজকর্ম করতে হয়েছে। এ রকম দিনগুলোতে প্রতিবেশী ননদ-ভাবীরা আড়ালে আবড়ালে হেসেছে। তখন মুখে লজ্জা থাকলেও আনন্দ গৌরবে তার বুক ভরে গেছে।
তবে সবসময়ই মৌলভির আদরের অত্যাচারে মন ভরে না দিল বেজুর। অভ্যাসে পরিণত হলেও ভেতর থেকে সাড়া জাগে না। খারাপ লাগে যখন দিল বেজুর কোন ভাললাগা, খারাপলাগা কিংবা মতামতের তোয়াক্কাই করে না মৌলভি। দিনের পর দিন সহ্য করলেও সাইকেল কাণ্ডটি দিলের দিল ভেঙে দেয়।
বিয়ের পর থেকে এভাবেই দিল বেজার নতুন করে আবিস্কার করতে থাকে বেটে মৌলভিকে। মানুষের সামনে লোকটি খুবই আমলদার আলেম। কিন্তু নিজস্ব পারিবারিক জগতে প্রায় বিপরীত। রেগে গেলে তার মুখে গালি ফুটতে থাকে ওয়াজের মতোই। দিল বেজারের মা-বাপ কেউই বাদ পড়ে না সে বিষ বর্ষণ থেকে। তখন দিল বেজার মৌলভির সঙ্গে পাড়ার অন্য চাষাভুষোর থেকে কোন পার্থক্য দেখতে পান না। বিয়ের ছয় মাসের মাথায় প্রথম গায়ে হাত তুলেছিল বেটে মৌলভি। ওজুর পানি দিতে দেরি করায় দিল বেজারের পিটে কষে একটা কিল মেরেছিল।
একদিন এক অদ্ভুত কাণ্ড করেছিলেন বেটে মৌলভি। উত্তেজিত হয়ে একটি কাঠের টুল নিয়ে এসেছিল। তারপর সে টুলে দাঁড়িয়ে টাশ-টাশ কয়েক ঘা চড় বসিয়ে দিয়েছিল দিলকে। এ ধরনের শাস্তিতে একধরনের মজা পেয়ে গিয়েছিল মৌলভি। ঘনঘন টুলের উপর দাঁড়িয়ে মুখে চড়-থাপ্পড় মারা রেওয়াজে পরিণত করে ফেলেছিল। আরেকদিন আরও অদ্ভুত একটি কাণ্ড করেছিলেন তিনি। দিল বেজারের স্তন দু’টি আঁকড়ে ধরে ঝুলে পড়েছিল মৌলভি। ব্যথায় ককিয়ে ওঠে মাটিতে গড়িয়ে পড়েছিল দিল বেজার। চোখে মুখে অন্ধকার নেমে এসেছিল। দিলের অবস্থা দেখে মুহুর্তের মধ্যে পাল্টে গিয়েছিল মৌলভি। তরা করে মাটির কলসি থেকে জল এনে তার চোখে মুখে ছিটিয়ে দিয়েছিল।
তবে বেশীর ভাগ সময় মৌলভির নির্যাতন নেমে এসেছে দিলের দীঘল চুল বেয়ে। রাগান্বিত অবস্থায় দিল বেজারের চুলের নাগাল পেরে তো কোন কথাই নেই। সোজা চুলের তোড়া পেচিয়ে ধরে শরীরটা ঝুকিয়ে নিয়ে ইচ্ছেমত চড় থাপ্পড় কিল ঘুষি বুৃষ্টির মত শুরু হয়। তখন ধর্মভীরু বেচারি দিলের কান্না ছাড়া কিছুই করার থাকে না। তাও আবার উচ্চস্বরে নয়, মৃদুস্বরে-নিরবে। কারণ একবার উচ্চস্বরে কান্না করতে গিয়ে তাকে তালাকের হুমকি দিয়েছিল মৌলভি। বলেছিল, পরপুরুষে পরনারীর কণ্ঠ শুনলে দোজকে জলতে হবে। আর তালাকের ভয় তো গ্রামীন ধর্মভীরু নারীর বিরুদ্ধে কার্যকর অস্ত্র। আর বেটে মৌলভি এসব অ™ভুত কাজ করতেন তার খর্বত্বের কারণে। স্বাভাবিকভাবে সে দিলের মুখমণ্ডলের নাগাল পেতো না। অবশ্য মানসিকভাবেও মৌলভি কখনো স্ত্রীর মনের নাগালটি পায়নি।

গ.
দুপুর থেকেই মনে মনে প্রস্তুতি নেয় দিল। রাত যখন বাড়বে, মৌলভি ওয়াজ মাহফিলে যাবে তখনই কলিজার টুকরো শাকুরকে নিয়ে বাপের বাড়ি রওনা দেবে সে। রাতের আধারে, আব্রু ঢেকে। দিল চিন্তা করে দেখেছে- ঠাণ্ডা মৌলভির সম্মান পুরো তল্লাটে। তার মেয়ে স্বামীর অবাধ্য হওয়ায় অজুহাতে তালাক পেলে সে সম্মান ধুলোয় লুটোবে। স্বামীর ইজ্জাতটাও কি কম? হাজার হোক কলেমা পড়া স্বামীতো। দুনিয়ার না পাওয়া যায় আখেরাতে তো ফল পাওয়া যাবে।
দুপুরে শাকুরকে ডেকে পুকুর ঘাটে নিয়ে যায় দিল। বাড়ির মধ্যে বললে আবার ফাঁস হয়ে যেতে পারে। এমনিতেই শাশুড়ি হল কুটনি বুড়ি। আশপাশের লোকজনরে বিশ্বাস করা যায় না। পুকুর ঘাটে গিয়ে ছেলেকে বলে- শাকুর বাপ আমার, তোর বাপের নির্যাতন আর সহ্য হয় না। চল আজ রাতে পালাই। তোর নানা বাড়িতে চলে যাই। তোর বাপ সবাইরে ওয়াজ নসিহত করে এবার তাকে একটা এলেম দিতে হবে।
অনেকটা বোকার মতই চুপচাপ ঘাড় নেড়ে মায়ের কথায় সায় দেয় শাকুর। বাবাকে প্রচণ্ড ভয় পায় ছেলেটি। আবার মায়ের জন্যও দুঃখ লাগে। মনে মনে ভাবে- বড় হলে বাপরে শায়েস্তা করতে হবে। কিন্তু মায়ের প্রস্তাবে সে এক ধরনের দ্বন্দ্বে পড়ে যায়। জগতে সবার উপরে মায়ের সম্মান। আল্লাহর রাসুল নাকি সে স্বীকৃতি দিয়েছেন। যদিও বাবার মুখেই তার এসব কথা শোনা। যাহোক, দিল ছেলেকে রাজী করাতে পারে।
সে প্রশ্ন করে- কিন্তু কিভাবে যাবেন আম্মা।
কেন হেঁটে, রাতের আঁধারে।
আব্বাজান তো জেনে যাবে। তখন তো কেরাপ বেতের বাড়ি একটিও মাটিতে পড়বে না।
দিল তাকে অভয় দেয়। আজ রাতে নতুন জামা পরেই শুয়ে থাকবি। রাতে যখন তোকে শরীর ঝাকিয়ে ইশারা করব তখন চুপচাপ আমার সঙ্গে বেরিয়ে পড়বি।

মায়ের পরিকল্পনা অনুযায়ী ছেলে সন্ধ্যা রাতেই ঘুমিয়ে পড়ে। পরনে তার নতুন জামা।
ঘরের ভেতর পাশাপাশি কক্ষ। আগে শাকুরকে একই বিছানায় রাখতেন মৌলভি। আটবছর বয়সের পর থেকে তাকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে পাশের কক্ষে। তবে দুই কক্ষের মধ্যখানের দরজা সবসময় খোলাই থাকে। মৌলভি মাঝেমধ্যে ছেলের পাশেই শোয়। বিশেষ করে দিলবেজারের ঋতুর মওসুমে।
জামাই বিকালে ওয়াজে যাওয়ার পর থেকে দিল বেজার বানু অপেক্ষার প্রহর গুনছে। সন্ধ্যারাতে শাশুড়িকে খাইয়ে দাইয়ে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছে দিল। যেচে শ্বাশুড়ির মাথার চুল টেনে দিচ্ছে, পা টিপে দিচ্ছে আর বেদনানাশক তেল মালিশ করে দিচ্ছে। মনে মনে কামনা করছে- বুড়ির চোখ দু’টি বুঝে আসুক। শীতের রাত। অনেক দীর্ঘ। মৌলভির ঘুম কাতুরে চোখকে ফাঁকি দেয়ার এটাই উপযুক্ত সময়। ওয়াজ মাহফিল থেকে ফিরতে ফিরতে কুয়াশায় আবছা অন্ধকারে লোকজনের চোখকে ফাঁকি দিয়ে বিলপাতারি হেঁটে পদুয়া বাপের বাড়ি যাবার। রাত আরেকটু গভীর হলেই বেরিয়ে পড়তে চায় সে। বেটে মৌলভি বাড়ি ফিরতে ফিরতে পৌছাতে চায় বাপের বাড়ি। লোকজনের চলাফেরা থাকতে সে যেতে পারবে না। কারণ পথে তাকে কেউ চিনে ফেললে নানারকম বিপদ। একে মৌলভির কন্যা তার ওপর মৌলভির স্ত্রী। লোকজনের সামনে দিয়ে একাকি গভীর রাতে চলাফেরা বড় অশোভন হবে। লোকজন শেখায়েত করবে।
কিন্তু বুড়ির আর চোখ বুঝে না। মাঝে মাঝে চোখ বুঝে এলেই ধড়পড়িয়ে ওঠে বুড়ি। তার কাছে কি যেন লুকোতে চায়। হঠাৎ চা খেতে চায়। অথচ বুড়ি সচরাচর চা খায় না। পিঠে গরম পানির ছ্যাকা দিতে বলে। বুড়ির হলো কি আজকে। তাহলে কি তার পরিকল্পনা জেনে গেছে বুড়ি? দিল বেজারের দিলে নানারকম দোলাচল।

ঘ.
স্ত্রীর পরিকল্পনা জানার পর ওয়াজ মাহফিলে মন বসে না বেটে মৌলভির। ওয়াজে নামাজের ‘একমন তত্ত্ব’ বয়ান করতে গিয়ে তার মনই দুইভাগে ভাগ হয়ে পড়ে। একমন ওয়াজে মনোযোগ দেয় আরেকমন বাড়িতে স্ত্রীর গতিবিধি আন্দাজ করে। রাতে ওয়াজ মাহফিল থেকে আগে বাগেই বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নেয়। অবশ্যই ওয়াজে বের হবার আগে বুড়ি মাকে সতর্ক করে এসেছে। বলেছে- দিলকে চোখে চোখে রাখতে। তারপরও মন মানে না। তাই তড়িঘড়ি ওয়াজ শেষ করে বাড়ি পথ ধরেন মৌলভি।
রাত দ্বিপ্রহরে হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ফিরেন তিনি। উঠোনে ঢুকেই হাক দেয়- কই রে দিল বেজু। মাঝে মধ্যে মৌলভি আদর করে দ্বিতীয় অপভ্রংশে- তাকে দিল বেজু নামে ডাকে। প্রথম ডাকে সাড়া দেয় না দিল। দ্বিতীয় ডাকে ছোট্ট করে উত্তর দেয়- আসছি। ছোট্ট হলেও বিবির সাড়া তাকে স্বস্তি দেয়। অন্যদিন সে ঘরে ফিরে আগে মা’র কাছেই বসতেন। আজ সোজা বিবির কাছে।
এ বছর অগ্রহায়নের মাঝামাঝি থেকে শীত ঝেকে বসেছে। শীতের পোষাক ছাড়া বাইরে বেরুনো দূরের কথা বিছানায় ঘুমানো পর্যন্ত অসম্ভব হয়ে ওঠেছে। তাই রাতে পালানোর প্রস্তুতি হিসাবে নতুন জামার ওপর শীতের কাপড় আর গলা অব্দি মাথার কানটুপি পরিয়ে ছেলে শাকুরকে ঘুম পাড়ায় দিল বেজু। তার চোখ-নাক ছাড়া প্রায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আর শীতের রাতে গরমের ওম পেয়ে সেও দ্রুত ঘুমের জগতে পাড়ি দিয়েছে। বেটে মৌলভিও ওয়াজ শেষে শীতের রাতে ঠাণ্ডা থেকে বাঁচতে পাঞ্জাবীর ওপর শীতের পোষাক আর গলা অব্দি কানটুপি ঢেকে বাড়ি ফিরেছে। ফিরেই ওই অবস্থাতেই শুয়ে পড়েছে ছেলের পাশে।
দিল বেজার বানু রাগে ফুলতে থাকে। বুড়ির কারণে স্বামীর বাড়ি ফেরার আগেই পালাতে পারেনি সে। এখন মনে হচ্ছে- বুড়িকে গলা টিপে মেরে ফেলাই ভাল ছিল। মৌলভি কাপড়-ছোপড় পাল্টে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। তার আশংকা বিবিকে আন্দাজ করতে দেয় না। যেন অন্য দশটি দিনের মতোই সবকিছু স্বাভাবিক। কিন্তু কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারছে না দিল। মনটা কেবল পালাই পালাই করছে। করবেই তো। বহুদিনের ছাইছাপা আগুন হঠাৎ জ্বলে ওঠেছে তার মনে।
নিজের বিছানায় দিলবেজার। পাশের কক্ষে ছেলে শাকুরের পাশে বেটে মৌলভি। দুইজনেরই কানখাড়া। একজন অপেক্ষা করছে অন্যজনে পাহারা দিচ্ছে।
শাকুরের বয়স এগারো হলে কি হবে দেখতে সে বাপেরই সমান। লোকে বলে- শাকুর হয়েছে নানার মতো। যেমন টকটকে ফর্সা তেমন শোল মাছের মতো লম্বা একহারা গঠনের শরীর। ছেলের জন্মের পর মৌলভি দু’একবার স্ত্রীর কাছে কৈফিয়তও চেয়েছে। এ ছেলে কার? তবে প্রতিবারই দিল বেজার চোখের জলে বুক ভাসিয়ে পবিত্র কালামে পাকের নামে শপথ করেছে- জীবনে সে একজন পুরুষের বুকেই আশ্রয় নিয়েছেন আর তিনি হলেন বেটে মৌলভি। মৌলভি তার এ কথা বিশ্বাস করুক আর না করুক জবরদস্তি করতে যায়নি। এতে পক্ষান্তরে তারই বদনাম। লোকজন তাকে তার খর্বত্ব নিয়ে এখন বেটে মৌলভি বলে তখন বলবে আটকুড়ো মৌলভি।

সারাদিনের দেহ মনে বেদনার্ত দিল বেজার বানু কাৎ হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই চোখে রাজ্যের ঘুমে নেসে আসে। জোর করে জেগে থাকতে গিয়ে কিছুক্ষণ এপাশ-ওপাশ করেছেন বোকার মতো। এতে মৌলভি আরও সচেতন হয়ে গেছে। আরও গভীর রাতে যখন ঘনরাত্রীর গাঢ় অন্ধকার ফ্যাকাশে হয়ে ওঠেছে। এমন সময় হঠাৎ করেই ঘুম ভেঙে যায় দিলের। মৌলভির হালকা চালের নাক ডাকার শব্দে সে নিশ্চিত হয় তিনি এখন ঘুমোচ্ছেন। মৌলভির ঘুম ভারী, গাঢ়। বিছানায় গা এলিয়ে দিলে আর খবর থাকে না। কিন্তু মৌলভি ধরে আছে ভান। স্ত্রীর প্রতিটি পদক্ষেপ তার সন্দেহ গাঢ় থেকে আশংকার তৈরি হচ্ছে। কিন্তু বোকা দিল তার কিছুই টের পায় না। দিল ঘুমিয়ে পড়ার পর মৌলভি ছেলের সঙ্গে স্থান পরিবর্তন করে নিয়েছে। ঘুমন্ত শাকুরকে সরিয়ে বিছানার প্রান্তবদল করে মৌলভি।

ঙ.
রাত ত্রিপ্রহরে, ঘুম ভাঙার পর দিল বেজার বানু বিছানা থেকে ওঠে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। পর্দা সরিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে আন্দাজ করলেন ফজরের আজানের কিছুক্ষণ বাকি আছে। এখনই রওনা দেয়া দরকার। এখন রওনা দিলে ফজরের আজানের সময় বাপের বাড়ি পৌছানো যাবে। বাপের মত ছেলে শাকুরেরও ঘুম ভারি। তাই খুব সতর্ক পায়ে দিল বেজার দরজার ছিটকানি খুলে দেয়। এবার সেগুন কাঠের আলনা থেকে বোরকাটা গায়ে চাপিয়ে বিছানার দিকে যায়। মৌলভির ঘুম ভেঙে যাওয়ার ভয়ে দিল বেজার বানু। সিথানে টিমটিম করে জ্বলা হারিকেনটি বড় করে না। আলো-আধারীর মধ্যেই বিছানার দিকে যায়। বিছানার যে পাশে শাকুর শুয়েছিল সে পাশে গিয়ে আলতোভাবে শাকুরকে হালকা ধাক্কা দিয়ে ঘুম ভাঙায়। তারপর দ্রুতপদে ঘর থেকে বেরিয়ে অতিসর্ন্তপনে বাইরের শিকলটি লাগিয়ে দেয়।
একটু আগে যখন ছেলের পাশাপাশি শুয়েছিল মৌলভি তখনকার ঘটনাগুলো ভাবে, আর মনে মনে হাসে। দিল বেজার বানু বিছানায় ফিরেই পাশে শোয়া শাকুর মনে করে বেটে মৌলভিকে গা ঝাকিয়ে ইশারা করে। কিরে নানা বাড়ি যাবি না? ঘুমের ভান ধরা বেটে মৌলভি পরিস্কার বুঝে ফেলে- দিল পালাচ্ছে। তখন সে দুইবার হু-হু করে? দিল পালানোর উত্তেজনায় সবকিছু ভুলে যায়। পোশাক-শারীরিক কাঠামো এবং আগাম পরিকল্পনার কারণে শাকুর আর বেটের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না। বউয়ের পালানোর ইশারায় পেয়ে সে মাথা নিচু করে বউয়ের পিছু নেয়। দরজাটা পার হয়েই টপ করে বউয়ের পিঠে চড়ে বসে। দিল বেজু ছেলের কাণ্ড দেখে বলে- বেটা হাঁটতেও পারবি না। তোর বাপ জীবনটা পুইড়া অঙ্গার করলো তুইও দেখি বাপের মতোই হইছিস। মাকে কষ্ট দিস। বলতে বলতে মৌলভির ভারী দেহটা নেড়ে চেড়ে কাঁধ ঝাঁকিয়ে পিঠের উপর ঠিকমতো বসিয়ে নেয়। বলে, তুই তো দেখি তোর আব্বাজানের চেয়েও ভারী। তারপর পেছন থেকে তার দুইপা নিজের কোমরের সঙ্গে পেছিয়ে ধরে হাটা দেয়। ছেলে সেজে পিঠে চড়া মৌলভি কোন শব্দ করে না। বরং ছেলের মত করে স্ত্রীর কাঁধের মধ্যে নিজের মাথাটি ফেলে দেয় ঘুমের ভান করে।
বেটে মৌলভি বিছানায় সরে শুয়ে ছিলেন স্ত্রীর গতিবিধি সম্পর্কে সতর্ক হতে। কিন্তু নিজের স্ত্রীর পিঠে ছেলের মতো চড়ে বসতে পারবে এটা কল্পনাও করতে পারেনি। যখনই স্ত্রী তাকে ছেলে মনে করে পিঠে তুলে নেয়- তখনই তাকে একটি রোমাঞ্চকর অনুভুতিতে পেয়ে বসে। দেখতে চায়- বেচারী শেষ পর্যন্ত কি করে। ঘুমের ঘোরে বেচারি বুঝতেই পারেনি। এমনকি দাড়িগুলোর অনূভূতিই টের পায়নি। এতে বেটে মৌলভি নিজেই বিস্মিত।
বেটে মৌলভি ছেলেকে খুবই আদর করে। প্রতিবার জামা বানানোর সময় একই কাপড় দিয়ে একই ডিজাইনে ছেলে শাকুরের জন্য ও জামা বানিয়ে নেয়। দুইজনের মাপও প্রায় একই। ফলে তারা বাপ-বেটা যখন কোথাও বেড়াতে যান তখন অনেকেই তাদের ভাই বলে ভুল করে। আবার দুইজনের বয়সের ব্যবধানও সে দ্বন্দ্বকে আরও জটিলতর করে তোলে। বেটে মৌলভি ও তার ছেলে শাকুরের কণ্ঠও প্রায় একই রকম। ফলে অনেক সময় আড়াল থেকে কথা বললে বাড়ির লোকজনও দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ে। এমন অনেকবার ঘটেছে যে, শাকুর মাদ্রাসা থেকে ফিরেই উঠোনে কারও সঙ্গে কথা বলছে- কিন্তু বেটে মৌলভি মনে করে দিল মাথার কাপড় টেনে দিয়েছেন। অন্যদের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। শাকুর তার আব্বাজানের শারীরিক গঠনটি না পেলেও পেয়েছে কণ্ঠটি।
বেটে মৌলভির সঙ্গে দিল বেজারের বিয়ে হওয়ার তেমন কোন যুক্তি ছিল না। কিন্তু অন্ধবিশ্বাস আর একটি অঙ্গীকারের কাছে পরাজিত হয়েছে যুক্তি। দিল বেজারের আগে ঠাণ্ডা মৌলভির আরও দুইটি মেয়ের জন্ম হলেও তারা খুব ছোটবেলাতেই মৃত্যুবরণ করে। কিন্তু ঠাণ্ডা মৌলভির একটির মেয়ের শখ ছিল। তাই তিনি দিল বেজারের জন্মের পর অঙ্গিকার করেছিলেন- মেয়েটিকে কোন আলেমের কাছে বিয়ে দেবেন। সে গরিব-গুর্বা, অন্ধ-খোঁড়া যাই হোক না কেন।
দরদি কণ্ঠের জন্য ছোট বেলা থেকেই সুনাম ছড়িয়ে পড়ে বেটে মৌলভির। ফলে মেয়ে দিল খোশ বানুর জন্য বিয়ের প্রস্তাব পেতেই একবাক্যে ‘হ্যাঁ’ করেছেন তিনি। একবার চিন্তা করার সময়ই পাননি তাদের শারীরিক অসামঞ্জস্যতা। বেটে মৌলভির কাছে তিনি মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। আর গোড়া মৌলভি বাড়ির মেয়ে হিসেবে পারিবারিক সম্মান দেখাতে গিয়ে সে বিয়েতে রাজী চুপচাপ সম্মতি দিয়েছিল দিল বেজার।
কারণ পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চি উচ্চতার সুঠামদেহী দিলের বিপরীতে চার ফিট উচ্চতার বেটে মৌলভির সামঞ্জস্যতা হয় না। এমনিতেই আদরের প্রতিবন্ধকতা তার উপর এ বৈষম্য তাদের সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে দাওয়াত কবুলের পথও সংকুচিত করে। তবে ঠাণ্ডা মৌলভি মেয়ের জামাই বেটে মৌলভিকে বিচার করে আধ্যাতিœক উচ্চতায়।

চ.
কৃষ্ণপক্ষের টানে চাদের আলো অনেকটাই ম্লান। আলোচ্ছায়ায় পথ স্পষ্ট দেখা গেলেও মাঝে মধ্যে গা চমকানো নানা শব্দ চারদিকে, পাখির ডানা ঝাপটানি। কোনটি পোকার আর কোনটি পশুপাখির। গাজির বিলের বুক চিড়ে সুখছড়ি নদীর পাশ ধরে মেটোপথ চলে গেছে টংকাবতী কুলে। টংকাবতী পার হলেই মল্লিক চোয়াং হয়ে পদুয়া। জিনপরীতে ভয় করে না দিলবেজার। ছোটবেলায় বাপের কাছে শেখা দোয়া দরুদগুলো এখনও তার মনে আছে। ছোটবেলা থেকে অনেকের মুখে শুনে আসছে- তার বাবা ঠাণ্ডা মৌলভি নাকি রাত বিরাতে ওয়াজ মাহফিল বা দাওয়াত শেষে ফেরার পথে বেয়াদবি করার অপরাধে বহু জ্বিনপরিকে এসব দোয়া দরুদ পড়ে অন্ধ ও বোতলবন্দী করেছে।
ছেলে হয়ে পিঠে চড়ে বসা বেটে মৌলভির ওজন নিয়ে আর হাঁটতে পারে না দিল বেজু। পিঠে ভার, মনে ভয়। দুইয়ে মিলে তাকে আরও বেশী কান্ত করে ফেলে। এই সেদিন বউ হয়ে এসেছে বেটে মৌলভির বাড়িতে। সেদিন কোলে করে দুধ খাইয়েছে শাকুরকে। দিনদিন বাড়ন্ত ছেলেটা দেখতে বাপের সময় হয়ে ওঠেছে। সুখছড়ির বাঁশঝাড় আর ডাল ছড়ানো কড়ই গাছের ঘন ছায়া মাড়িয়ে দিল বেজু হাঁটে আর ভাবে। কি ভাবে! কি ভাবে না? অতীত স্মৃতি ভাবতে ভাবতে তার মন ছুটে যায় অকল্পনীয় ভবিষ্যতে। শুধু কি সে? মৌলভির মনের মধ্যেও চলছে নানা ভাংচুর। কৌতুহল আর রহস্যের খেলা।
অদূরে টংকাবতী নদী। অন্ধকারের মধ্যেও আবচা আবচা নদীতীরের বাঁশঝাড়গুলো দেখা যায়। খানিকটা উত্তরদিকে লালবিন্দুর মত কি একটা জ্বলছে। দিল বেজু আন্দাজ করে নেয়, লালবিন্দুটি নিশ্চয়ই ঢাইরকূল মসজিদের মিম্বরের আলোকবাতি। বেজু শাকুরের পায়ে চিমটি দিয়ে বলে- শাকুর, ওঁ শাকুর। শাকুরের কোন সাড়া নেই।
পিঠের ভারে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে ঢাইলকূল এসে পৌঁছে দিল বেজু। ছেলেকে পিঠ থেকে নামিয়ে দিয়ে বলে, আর পারছি না বাবা। এবার হেঁটে চল। এখনো অনেক পথ।
কথাটি বলেই টেনে নিঃশ্বাস নেয় বেজু। মুহূর্তের মধ্যেই মুখের কাপড় সরিয়ে নিজেকে প্রকাশ করে বেটে মৌলভি। নিঃশ্বাস ফেলেই ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে দিল বেজু। ঘটনার আকস্মিকতায় যেন একখণ্ড পাথরে পরিণত হয়।
মৌলভি কথা বলে ওঠে- বৈতাল, রাতের আঁধারে পালাচ্ছিস। বললেই তো হতো, পাল্কিতে করে ঠাণ্ডা মৌলভির ঘরে পৌছে দিয়ে আসতাম। ঠাণ্ডা মৌলভির মেয়ে, বেটে মৌলভির বউ হয়ে পালাতে তোর বুক কাঁপলো না। মৌলভির গলায় কোমল তাচ্ছিল্যের সুর।
মুখ দিয়ে কোন শব্দ বেরুয় না বেজুর। পাথরের মতো মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে কাঁপতে থাকে। স্ত্রীর ভয়ার্ত কাঁপুনি দেখে মৌলভির মন নরম হয়। পরক্ষণেই আরেকটি নতুন কাণ্ড ঘটায় মৌলভি। আলগি মেরে উঁচু হয়ে দিল বেজুর গলাটা জড়িয়ে ধরে নাগালে আনে। চকাস চকাস করে দু’গালে চুমো খেয়ে বলে- এবার কোথায় যাবি? বাপের বাড়ি না লাঙের বাড়ি?