Sunday, January 22, 2012

উল্টোযাত্রা - কাফি কামাল

উল্টোযাত্রা
কাফি কামাল
....................
কাফ্রির মতো ঘন কালো রাত্রীর হৃদয় ধরে দিলবেজার বানু বিড়াল পায়ে হেঁটে চলছেন। গন্তব্য তার পদুয়ার হাতির দীঘি। বাপের বাড়ি, ঠাণ্ডা মৌলভির ঘর। মেঠোপথের দুইপাশে কালো কালো স্তুপের মত ঝোপঝাড়। নানা রকম পোকা মাকড়ের বিদঘুটে আওয়াজ একটি ভৌতিক আবহের সৃষ্টি করছে। মুখে তার আল্লাহ-রসুলের পাক কালাম আর কাঁধে বিয়াল্লিশ সেরের যমদূত; বেটে মৌলভি। পরণে জোলার শাড়ি, চরণে রেঙ্গুনের চপ্পল।
সুখছড়ির বেটে মৌলভির বাড়ি থেকে হাতির দীঘির ঠাণ্ডা মৌলভির বাড়ির দূরত্ব পাক্কা সাড়ে তিনমাইল। দূরত্বের একপ্রান্তে বটবৃক্ষের স্নিগ্ধ আশ্রয় অন্যপ্রান্তে গরম তাওয়ার উষ্ণতা। মধ্যখানে বয়ে গেছে খরস্রোতা টংকাবতী নদী।
সাদী মোবারকের একযুগ ধরে প্রতিটি ক্ষণ দিল বেজার বানু তা হাড়ে হাড়ে অনুভব করেছে। বারবার মনে পড়ে সুখছড়ির বেটে মৌলভিকে কবুল বলার সে চুপচাপ জবরদস্তির কথাটি। শ্বশুরবাড়ির প্রথমদিন থেকে গরম তাওয়ায় ভাজা লালমরিচের মত পুড়ে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছেন। কিন্তু নিয়তির পরশ পাথরের অপেক্ষায় কেটে গেছে দীর্ঘসময়। এরই মধ্যে তার নাড়িছেঁড়া ধন মোহাম্মদ শাকুরের বয়স এগারো পূর্ণ হয়ে বারোতে পড়েছে। বিয়ের ১১মাসের মাথায় দিল বেজারের কোল আলো করে এসেছিল শাকুর।
বিয়ের পর মেয়েরা পায় একজন মাতৃতুল্য শাশুড়ি। কিন্তু দিল বেজারের কপালে আল্লাহপাক লিখে দিয়েছেন একটি কুটনি বুড়ি। সে কুটনি বুড়ির ঘেরোবন্দী হন ঠাণ্ডা মৌলভির শান্ত স্বভাবের মেয়েটি। কথায় কথায় ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, অবহেলা। শাশুড়ির তাচ্ছিল্য দিয়েই শুরু হয় তার সংসার জীবন। গভীর রাতে ওয়াজ মাহফিল থেকে বাড়ি ফিরেন বেটে মৌলভি। ফেরা মানেই কুটনি বুড়ির হঠাৎ নাকিকান্নার সুর ওঠা, মায়ের কান্নায় মৌলভির তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠা। তারপর চারফুট উচ্চতার মাওলানা আবদুস সালাম ওরফে বেটে মৌলভির বিচারসভা। ছেঁড়া জুতা জোড়া থেকে পুরোনো ঝাড়–র উপুর্যুপরী আঘাত। অবশেষে দিল বেজারের রক্তাক্ত দেহ, বিছানায় ছটফট করার দৃশ্য। যদিও দিল বেজারের আব্বাজান নেয়ামত উল্লাহ ওরফে ঠাণ্ডা মৌলভির বিবেচনায় এটা একটি শয়তান বিতাড়ন প্রক্রিয়া। তিনি দিলকে বারবার সান্তনা দেন, স্ত্রীর শরীরে যেখানে স্বামীর আঘাত লেগেছে সেখানে দোযকের আগুন স্পর্শ করবে না। সত্যিই কি তাই! তাহলে তো দোজকের আগুনে দিল বেজারের খুব একটা কষ্ট হবে না। এতটুকু মেনে নিলেও শেষ রাতে বিক্ষত শরীর নিয়ে বেটে মৌলভির একতরফা নির্যাতনে সে সত্যিই বেদনাহত হয়েছে। ফুলে ওঠা স্থানে দোযকের আগুন স্পর্শ না করার একটি বিশ্বাসগত সম্ভাবনা থাকলেও মৌলভির স্পর্শ নির্যাতন থেকে রেহাই মিলেনি।
বাবা-মা’র আদরের মেয়ে দিল খোশ বানু এক সময় হয়ে ওঠেছে বেটে মৌলভির দিল বেজার। এখন সে সত্যিকারেরই দিল বেজার। বিয়ের দীর্ঘ এক সময়েও কখনো বিজলীর মত দুই একটি মুহুর্ত ছাড়া দিল তার বেজারই থেকেছে। খোশ হয়ে ওঠতে পারেনি। তার বেদনার্ত গুমড়া মুখের দিকে তাকিয়ে এক ভোর বেলা তাকে এ অপবাদই দিয়েছে বেটে মৌলভি। সে থেকেই দিল খোশ বানু হয়ে ওঠেছেন দিল বেজার ওরফে দিল বেজু।

খ.
অগ্রহায়নের শেষ সপ্তাহেই ঝেকে বসেছে পৌষের শীত। কৃষকের ধান কাটা প্রায় শেষ। নতুন ধানের ধেনো গন্ধে মৌ মৌ করছে চারদিক। চাষা ভুষো গ্রামীণ মানুষ আল্লাহর শোকর জানাতে পাড়ায় পাড়ায় ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করছে। পাড়ায় পাড়ায় মসজিদ মাদ্রাসায়গুলোর কোষাগার ফুলে ফেপে স্ফিত হচ্ছে। নাখোদা’রা বলে, অগ্রহায়ন হচ্ছে মসজিদ মাদ্রাসার কোষাগার স্ফীতির মওসুম। মৌলভির ওয়াজে ধর্মীয় গল্প বলার ফাঁকে-ফোঁকরে দরাজ গলায় লোকজনের কাছে চাদা তুলছে। মারহাবা মারহাবা শব্দে বাড়ছে চাঁদার পরিমান আর মহিমা। কেউ নতুন ধান বিক্রির কড়কড়ে নোট, কেউ বা আড়ি আড়ি ধান চাউল দান করছে। মৃত বাবা-মা আত্মার শান্তি কামনা, সংসারের সুখ সমৃদ্ধি ও দোজাহানের নেকি অর্জনে সবাই এখন কম বেশি উদার হস্ত। এলাকার উঠতি পয়সাওয়ালারা তো রীতিমতো প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠেন। এ সময় ঘন ঘন ওয়াজের দাওয়াত আসে মৌলভির। দিনে দু’তিনটিও থাকে। নজরানাও কম নয়। এক একটি ওয়াজের জন্য তাকে দিতে হয় হাজার টাকা। ভাল মানের খাবার দাবার তো আছেই। কেউ কেউ যাতায়াতের জন্য রিক্সার ও ব্যবস্থা করেন। তিন চার ক্রোশ দূর থেকে বেটে মৌলভির ওয়াজের দাওয়াত আসে। এ সময় কাপড়-চোপড়ে একটু যতœবান হতে হয়। তাই ইস্ত্রির ভাজ দেয়া পাঞ্জাবী ছাড়া ওয়াজ মাহফিলে যান না বেটে মৌলভি। সেদিন সুখছড়ি ওয়াজ মাহফিলে গিয়ে খাবার সময় আর্দি কাপড়ের পাঞ্জাবীতে গরুর গোশতের ঝোল পড়ে দাগ হয়ে যায়। তাই দাগ উঠাতে সেটি বাজারের লণ্ড্রিতে দেয় মৌলভি। আরেকটি পাঞ্জাবী আধোয়া। সেদিন সকালে মাদ্রাসায় যাওয়ার সময় মৌলভি দিল বেজারকে কড়া নির্দেশ দেয়। দিল বেজু- আমার কোর্তাটা ধুয়ে রাখবা। বিকালে ওয়াজে যেতে হবে। সেখান থেকে রাতে আরেকটি দাওয়াত আছে। কিন্তু সারাদিন বাড়ির কাজে দিল বেজু কোর্তা ধোয়ার কথা ভুলে যায়। দুপুরে মাদ্রাসা থেকে বাড়ি ফিরে মৌলভি দেখে যেখানের কাপড় সেখানেই আছে, ধোয়া হয়নি। দেখেই মাথায় রক্ত ওঠে যায় তার। মুখ দিয়ে গালির ফোয়ারা ছুটে- ওই খানকি মাগির ঝি, কি বলে গিয়েছিলাম মনে নেই।
দিল বেজু হন্তদন্ত হয়ে রান্নাঘর থেকে ছুটে আসে। কি হয়েছে?
তোর মাকে .....।
এভাবে কুত্তা বিলাইয়ের মত গালি দিচ্ছেন কেন।
জানিস না- তোরে যে ওয়াজের সুরে কোর্তা ধুইতে বলেছিলাম।
ততক্ষণে শুরু হয়ে যায় চুল ধরে মারপিট। দিল বেজু সহ্য করতে পারে না। সে ভুল করেছে সত্য তবে ঘরে তো আর বসে ছিল না। বাড়িতে মেহমান এসেছে। তাদের জন্য রান্নার পাশাপাশি বাড়ির ভেতর ধান চালের মওসুমী কাজ তো আছেই।
মুখের গালি আর হাতের ঢালি খেয়ে, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে দিল বেজার বানু। দুপুরে বেতের বাড়ি হজম করতে করতে সে বলেই ফেলে- আমি আর আপনার ঘর করবো না। আপনার ঘরে থাকবো না।
কোন নাগরের কাছে যাবি? বেটে মৌলভির শ্লেষ।
অত আর আল্লাদ নেই।
তাহলে কোথায় যাবি- হারামজাদি।
মুখ সামলে কথা বলেন। আব্বাজানের গজব পড়বে।
খানকি তুই তালিম দিস না। বেটে মৌলভি আরেক ঘা লাটির আঘাত করে।
কোথায় কোন বারাম খানায় যেতে চাস বল।
বাপের বাড়িই যাব। আপনারে ঘুমে রেখেই যাব। নিবুর্দ্ধিতা করে নিজের গোপন পরিকল্পনাটি ফাঁস করে দেয়- দিল। তবে চালাক বেটে মৌলভি সতর্ক হয়ে পড়ে। লোকে তো এমনি বলে না- ‘বেটে হচ্ছে শয়তানের লাঠি।’ দেহে যারা বেটে বুদ্ধিতে সে তারা দীর্ঘ। ফলে মৌলভি বুঝে নেয়- এবার একটা অঘটন ঘটবে। খাঁচার পাখির মুখে বোল ফুটেছে। এবার উড়াল দিতে চাইবে। কয়েকদিন আগের কথাগুলো এবার ভাবতে থাকে মৌলভি।

সবকিছুতেই শাকুরের কৌতূহল। সবকিছুই যেন তাকে বুঝতে হবে, জানতে হবে। কিছুদিন আগে জেটাতো ভাইয়ের সাইকেল নিয়ে সে হঠাৎ উধাও হয়ে যায়। সে যে সাইকেল চালাতে পারে সেটাই বাড়ির কেউ জানতো না। সাইকেল খুঁজে না পেয়ে শাকুরের জেটাতো ভাই গফুর যখন গালাগালি করতে করতে খুঁজছে তখনই খবরটি পাওয়া গেল। উত্তরপাড়ার করিম সরকার জানালো, তিনি নিজের চোখে দেখেছেন। শাকুর কাত হয়ে হয়ে সাইকেলের প্যাডেল মেরে উত্তরদিকে চলে গেছে। করিমের কথা শুনে সবাই অবাক। শাকুর সাইকেল চালাতে শিখলো কখন? কেউতো শাকুরকে চালানো শেখায়নি। সবার মুখে জিজ্ঞাসা? সে প্যাডলের নাগাল পায়তো?
এরই মধ্যে করিম অদৃশ্য সাইকেল চোরের জ্ঞাতিগোষ্ঠী তুলে গালাগালি করেছে। এখন খবর পাওয়ার পর সে লজ্জিত মুখে উত্তরদিকে হাঁটা দিল। করিম সরকারের কথায় দিল বেজার বানুর মনটা দ্বিখণ্ডিত হয়ে পড়েছে। একমনে ছেলের সাইকেল চালনা শেখার কৃতিত্বে আনন্দিত অন্যমনে গফুরের গালাগালিতে ছেলের প্রতি ক্ষোভ দানা বাঁধছে। গফুরের গালিগুলো তার অন্তরে এসে বিধঁছে। যদি ছেলের একটি সাইকেল থাকতো তাহলে নিশ্চয়ই তাকে এভাবে গালি শুনতে হতো না। নানা কাজে এদিক ওদিক পাঠানোও যেতো।
খানিকক্ষণ পর শাকুরকে পাওয়া গেলো কাজির বিলে। সাইকেলে শরীর বাকিয়ে প্যাডল মারছে আর কখনো হাত ছেড়ে দিচ্ছে কখনো পা প্যাডল থেকে তুলে নিচ্ছে। গফুর তাকে ডাক দেয়- এ্যাই শাকুর। গফুরকে দেখেই অবশ্যই শাকুর সাইকেল দাঁড় করিয়ে কাঁপতে থাকে। তবে গফুর তাকে কটু কিছু বলে না। শুধু মিষ্টি হেসে বলে- এ্যাই বজ্জাত বলে আনতে পারতি না। শাকুর লজ্জা ও ভয়ে নিশ্চুপ। এতক্ষণ পর বুঝতে পারছে সে খুব একটা অপরাধ করে ফেলেছে।
রাতে বাড়ি ফিরেই আগুন চোখে বেটে মৌলভি ছেলেকে ঘুম থেকে তুলে। কোন কৈয়ফিত জানতে না চেয়েই চড়-থাপ্পড়ে শাকুরের গাল লাল করে ফেলে। ঠোঁট ফেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোয়। সহ্য করতে না পেরে দিল বেজার বানু ঠেকাতে যায়।
কি করছেন আপনি। ছোট্ট অপরাধে এমনভাবে পেঠাতে হয়।
মুখে কোন কথা নয়, সঙ্গে সঙ্গে শাকুরকে ছেড়ে দিল বেজারকে পেঠাতে শুরু করে মৌলভি।

টানা তিনদিন জ্বরে ভোগার পর বিছানা ছাড়ে শাকুর। ছেলের ফ্যাকাসে মুখ দেখে মায়ের মন মানে না। দিল বেজারের চোখ দিয়ে শ্রাবণের বারি ঝরেছে এইতিনদিন।
ছেলে সুস্থ হওয়ার পর একদিনে দিল বেজার স্বামীর কাছে একটি আবদার করে বলে- একটি কথা বলব, রাখবেন?
কি কথা- মৌলভির কণ্ঠে কোমলতা।
ভরসা পেয়ে দিল বেজার আর্জিটা পেশ করে- আমাদের শাকুরকে একটি সাইকেল কিনে দেন না।
শুনে মুহূর্তের মধ্যেই রেগে আগুন হয়ে ওঠে মৌলভি। তার মুখ দিয়ে বেরুতে থাকে, রাগের লাভা। তপ্ত এবং হন্তারক। খানকি, বৈতাল- ছেলেকে গাণ্ডু বানাতে ছাস। আবার বলবি তো, চুলের ঝুঁটি ধরে হাতিরদীঘি পাঠাব।
দিল বেজার স্বামীর মেজাজের আকস্মিকতায় খানিকটা ভড়কে যায়। পরক্ষণে তার মনটা খুবই খারাপ হয়ে যায়। প্রায়ই সে এটা-ওটা আবদার করে না। বাড়ির প্রয়োজনীয় জিনিষের বাইরে কবে কি আবদার করেছিল তার মনেই পড়ে না। তাই এক পর্যায়ে তার জেদ হয়। যাই হোক, যেভাবেই হোক ছেলেকে সাইকেল সে কিনে দেবেই।
কয়েকদিন পর জীবনে প্রথমবারের মতো চুরি করে দিল বেজার। পাড়ার সোলায়মানকে দিয়ে গোলা থেকে ধান নামিয়ে গোপনে বিক্রি করে। সোলায়মান তিনটি পাঁচশ টাকার নোট তার হাতে গুঁজে দেয়। বাড়ির খরচ থেকে বাঁচিয়েও সে বাড়ির বাঁশের খোড়লে কিছু টাকা জমিয়েছিল। খোড়ল কেটে নানা অংকের নতুন-পুরোনো নোট মিলিয়ে দেখে আটশ ঊননব্বই টাকা জমেছে। সে এরই মধ্যে খবর নিয়ে দেখেছে একটি মাঝারি উচ্চতার সাইকেল কিনতে দুইহাজার টাকা লাগে। এই কয়দিন স্বামীর কাছে যতই অপমানিত হোক না কেন তার চোখে ভেসেছে একটি দৃশ্য। শাকুর সাইকেল চালিয়ে মাদ্রাসায় যাচ্ছে আর বাতাসে ওড়ছে তার পাঞ্জাবীর খুট।
পরদিন ভাসুরপুত গফুরকে আমিরাবাদ পাঠিয়ে একটি সাইকেল নিয়ে আসে। লাল রঙের ফনিক্স সাইকেল। সাইকেল পেয়ে শাকুরের আনন্দ যেন আর ধরে না। সাইকেল নিয়ে সে উঠোন পেরিয়ে রাস্তার দিকে চলে যায়। সেটা দেখে দিল বেজারের মন বহুদিন পর খোশ হয়। নিজের আসল নামের কথা তার মনে পড়ে। মুহূর্তের তার মুখ দিয়ে ফিক করে হাসির শব্দ বেরুয়।
সকালে ঘরের দাওয়ায় নতুন সাইকেল দেখে অবাক হয় মৌলভি। খর্বত্বের কারণে নিজের সাইকেল চালানো শেখা হয়ে ওঠেনি। তার ছেলে সাইকেল চালাবে তার সামনে দিয়ে! মৌলভি কল্পনাই করতে পারছে না।
দিল বেজারকে হাঁক দেয়- এই দিল বেজু, এদিকে আয়।
দিল সামনে আসতেই সাইকেল দেখিয়ে মৌলভির প্রশ্ন- এটি কার?
মুখে হাসি ফুটিয়ে দিল বেজার বলে- শাকুরের জন্য কিনে আনিয়েছি।
কে কিনে দিয়েছে?
জ্বি, আমি কিনে আনিয়েছি, গফুরকে দিয়ে।
বৈতাল তুই, টাকা কোথায় পেলি? মৌলভির মেজাজ চড়তে শুরু করেছে।
হাতে কিছু টাকা ছিল আর...
আর কি?
কয়েক আড়ি ধান বিক্রি করেছি।
দিল বেজুর কথা শেষ হওয়ার আগেই ‘ছেলেকে গাণ্ডু বানানোর পায়তারা করছিস’ এই স্বগোক্তির করতে করতে মৌলভির হাত-পায়ের ব্যবহার শুরু হয়ে যায়। সেই সঙ্গে যা তোকে আমি ‘এক তালাক’ দিলাম বলে মৌলভি এ সংক্রান্ত তিনটি শক্তির একটি ব্যয় করে ফেলেন। এখনও তার হাতে দুইটি শক্তি, দিল বেজুর সামনেও দুইটি রক্ষা কবচ। শব্দটি আর মাত্র দুইবার উচ্চারণ করলেই মৌলভি হারাবেন তার ক্ষমতা আর দিল হারাবেন তার স্ত্রী পরিচয়। তবে দ্রুত সামলে নেন মৌলভি। দুপুরেই তিনি সাইকেলটি দুইশ টাকা বাট্টা দিয়ে ফেরত দিয়ে আসেন। সারাদিনের পিটুনী আর গালাগালির চেয়ে এ বিষয়টিই বেশী কষ্ট দেয় দিলকে। সংসারের পাক্কা একযুগের ভিত যেন দ্রুতই ক্ষয়ে যেতে থাকে।
দিল বেজারের মন আবারও দ্বিখণ্ডিত হয়। একদিকে সংস্কার অন্যদিকে স্বাধীনতা। স্বামীর বাড়ি ছেড়ে বাপের বাড়ি গেলে লোকে মন্দ বলবে। সবচেয়ে বড় কথা বাবা কষ্ট পাবেন। মৃত্যুপর পর আল্লাহর শাস্তি নিয়েও সে দ্বিধান্বিত। কি জবাব দেবেন আল্লাহকে। মৌলভি তো শুধু নির্যাতনই করে না। মাঝে মধ্যে আদরের আতিশয্যও দেখায়। কথাটি ভাবতে ভাবতেই তার চোখে ভেসে ওঠে বহু স্মৃতি।
ওয়াজ মাহফিল থেকে ফেরার সময় বহুদিন বহু জিনিষ নিয়ে এসেছে তার জন্য। কখনো কমলা-আপেল, কখনো বা পোটলা বেঁধে তরকারি। আবার সেসব তিনি দিল বেজারকে খাইয়ে দিয়েছেন নিজ হাতে। খুব মজা করে, আদর করে। স্বামী হিসাবে মৌলভি একরোখা। বিয়ের পর থেকে কেবল অপবিত্রের মওসুম ছাড়া দিলকে কখনো নিস্তার দেননি মৌলভি। বহুবার রাতে মৌলভির অতি আদরে সৃষ্ঠ মুখের দাগগুলো ঢাকতে দিল বেজুকে মুখে শাড়ির আচল পেচিয়ে বাড়ির কাজকর্ম করতে হয়েছে। এ রকম দিনগুলোতে প্রতিবেশী ননদ-ভাবীরা আড়ালে আবড়ালে হেসেছে। তখন মুখে লজ্জা থাকলেও আনন্দ গৌরবে তার বুক ভরে গেছে।
তবে সবসময়ই মৌলভির আদরের অত্যাচারে মন ভরে না দিল বেজুর। অভ্যাসে পরিণত হলেও ভেতর থেকে সাড়া জাগে না। খারাপ লাগে যখন দিল বেজুর কোন ভাললাগা, খারাপলাগা কিংবা মতামতের তোয়াক্কাই করে না মৌলভি। দিনের পর দিন সহ্য করলেও সাইকেল কাণ্ডটি দিলের দিল ভেঙে দেয়।
বিয়ের পর থেকে এভাবেই দিল বেজার নতুন করে আবিস্কার করতে থাকে বেটে মৌলভিকে। মানুষের সামনে লোকটি খুবই আমলদার আলেম। কিন্তু নিজস্ব পারিবারিক জগতে প্রায় বিপরীত। রেগে গেলে তার মুখে গালি ফুটতে থাকে ওয়াজের মতোই। দিল বেজারের মা-বাপ কেউই বাদ পড়ে না সে বিষ বর্ষণ থেকে। তখন দিল বেজার মৌলভির সঙ্গে পাড়ার অন্য চাষাভুষোর থেকে কোন পার্থক্য দেখতে পান না। বিয়ের ছয় মাসের মাথায় প্রথম গায়ে হাত তুলেছিল বেটে মৌলভি। ওজুর পানি দিতে দেরি করায় দিল বেজারের পিটে কষে একটা কিল মেরেছিল।
একদিন এক অদ্ভুত কাণ্ড করেছিলেন বেটে মৌলভি। উত্তেজিত হয়ে একটি কাঠের টুল নিয়ে এসেছিল। তারপর সে টুলে দাঁড়িয়ে টাশ-টাশ কয়েক ঘা চড় বসিয়ে দিয়েছিল দিলকে। এ ধরনের শাস্তিতে একধরনের মজা পেয়ে গিয়েছিল মৌলভি। ঘনঘন টুলের উপর দাঁড়িয়ে মুখে চড়-থাপ্পড় মারা রেওয়াজে পরিণত করে ফেলেছিল। আরেকদিন আরও অদ্ভুত একটি কাণ্ড করেছিলেন তিনি। দিল বেজারের স্তন দু’টি আঁকড়ে ধরে ঝুলে পড়েছিল মৌলভি। ব্যথায় ককিয়ে ওঠে মাটিতে গড়িয়ে পড়েছিল দিল বেজার। চোখে মুখে অন্ধকার নেমে এসেছিল। দিলের অবস্থা দেখে মুহুর্তের মধ্যে পাল্টে গিয়েছিল মৌলভি। তরা করে মাটির কলসি থেকে জল এনে তার চোখে মুখে ছিটিয়ে দিয়েছিল।
তবে বেশীর ভাগ সময় মৌলভির নির্যাতন নেমে এসেছে দিলের দীঘল চুল বেয়ে। রাগান্বিত অবস্থায় দিল বেজারের চুলের নাগাল পেরে তো কোন কথাই নেই। সোজা চুলের তোড়া পেচিয়ে ধরে শরীরটা ঝুকিয়ে নিয়ে ইচ্ছেমত চড় থাপ্পড় কিল ঘুষি বুৃষ্টির মত শুরু হয়। তখন ধর্মভীরু বেচারি দিলের কান্না ছাড়া কিছুই করার থাকে না। তাও আবার উচ্চস্বরে নয়, মৃদুস্বরে-নিরবে। কারণ একবার উচ্চস্বরে কান্না করতে গিয়ে তাকে তালাকের হুমকি দিয়েছিল মৌলভি। বলেছিল, পরপুরুষে পরনারীর কণ্ঠ শুনলে দোজকে জলতে হবে। আর তালাকের ভয় তো গ্রামীন ধর্মভীরু নারীর বিরুদ্ধে কার্যকর অস্ত্র। আর বেটে মৌলভি এসব অ™ভুত কাজ করতেন তার খর্বত্বের কারণে। স্বাভাবিকভাবে সে দিলের মুখমণ্ডলের নাগাল পেতো না। অবশ্য মানসিকভাবেও মৌলভি কখনো স্ত্রীর মনের নাগালটি পায়নি।

গ.
দুপুর থেকেই মনে মনে প্রস্তুতি নেয় দিল। রাত যখন বাড়বে, মৌলভি ওয়াজ মাহফিলে যাবে তখনই কলিজার টুকরো শাকুরকে নিয়ে বাপের বাড়ি রওনা দেবে সে। রাতের আধারে, আব্রু ঢেকে। দিল চিন্তা করে দেখেছে- ঠাণ্ডা মৌলভির সম্মান পুরো তল্লাটে। তার মেয়ে স্বামীর অবাধ্য হওয়ায় অজুহাতে তালাক পেলে সে সম্মান ধুলোয় লুটোবে। স্বামীর ইজ্জাতটাও কি কম? হাজার হোক কলেমা পড়া স্বামীতো। দুনিয়ার না পাওয়া যায় আখেরাতে তো ফল পাওয়া যাবে।
দুপুরে শাকুরকে ডেকে পুকুর ঘাটে নিয়ে যায় দিল। বাড়ির মধ্যে বললে আবার ফাঁস হয়ে যেতে পারে। এমনিতেই শাশুড়ি হল কুটনি বুড়ি। আশপাশের লোকজনরে বিশ্বাস করা যায় না। পুকুর ঘাটে গিয়ে ছেলেকে বলে- শাকুর বাপ আমার, তোর বাপের নির্যাতন আর সহ্য হয় না। চল আজ রাতে পালাই। তোর নানা বাড়িতে চলে যাই। তোর বাপ সবাইরে ওয়াজ নসিহত করে এবার তাকে একটা এলেম দিতে হবে।
অনেকটা বোকার মতই চুপচাপ ঘাড় নেড়ে মায়ের কথায় সায় দেয় শাকুর। বাবাকে প্রচণ্ড ভয় পায় ছেলেটি। আবার মায়ের জন্যও দুঃখ লাগে। মনে মনে ভাবে- বড় হলে বাপরে শায়েস্তা করতে হবে। কিন্তু মায়ের প্রস্তাবে সে এক ধরনের দ্বন্দ্বে পড়ে যায়। জগতে সবার উপরে মায়ের সম্মান। আল্লাহর রাসুল নাকি সে স্বীকৃতি দিয়েছেন। যদিও বাবার মুখেই তার এসব কথা শোনা। যাহোক, দিল ছেলেকে রাজী করাতে পারে।
সে প্রশ্ন করে- কিন্তু কিভাবে যাবেন আম্মা।
কেন হেঁটে, রাতের আঁধারে।
আব্বাজান তো জেনে যাবে। তখন তো কেরাপ বেতের বাড়ি একটিও মাটিতে পড়বে না।
দিল তাকে অভয় দেয়। আজ রাতে নতুন জামা পরেই শুয়ে থাকবি। রাতে যখন তোকে শরীর ঝাকিয়ে ইশারা করব তখন চুপচাপ আমার সঙ্গে বেরিয়ে পড়বি।

মায়ের পরিকল্পনা অনুযায়ী ছেলে সন্ধ্যা রাতেই ঘুমিয়ে পড়ে। পরনে তার নতুন জামা।
ঘরের ভেতর পাশাপাশি কক্ষ। আগে শাকুরকে একই বিছানায় রাখতেন মৌলভি। আটবছর বয়সের পর থেকে তাকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে পাশের কক্ষে। তবে দুই কক্ষের মধ্যখানের দরজা সবসময় খোলাই থাকে। মৌলভি মাঝেমধ্যে ছেলের পাশেই শোয়। বিশেষ করে দিলবেজারের ঋতুর মওসুমে।
জামাই বিকালে ওয়াজে যাওয়ার পর থেকে দিল বেজার বানু অপেক্ষার প্রহর গুনছে। সন্ধ্যারাতে শাশুড়িকে খাইয়ে দাইয়ে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছে দিল। যেচে শ্বাশুড়ির মাথার চুল টেনে দিচ্ছে, পা টিপে দিচ্ছে আর বেদনানাশক তেল মালিশ করে দিচ্ছে। মনে মনে কামনা করছে- বুড়ির চোখ দু’টি বুঝে আসুক। শীতের রাত। অনেক দীর্ঘ। মৌলভির ঘুম কাতুরে চোখকে ফাঁকি দেয়ার এটাই উপযুক্ত সময়। ওয়াজ মাহফিল থেকে ফিরতে ফিরতে কুয়াশায় আবছা অন্ধকারে লোকজনের চোখকে ফাঁকি দিয়ে বিলপাতারি হেঁটে পদুয়া বাপের বাড়ি যাবার। রাত আরেকটু গভীর হলেই বেরিয়ে পড়তে চায় সে। বেটে মৌলভি বাড়ি ফিরতে ফিরতে পৌছাতে চায় বাপের বাড়ি। লোকজনের চলাফেরা থাকতে সে যেতে পারবে না। কারণ পথে তাকে কেউ চিনে ফেললে নানারকম বিপদ। একে মৌলভির কন্যা তার ওপর মৌলভির স্ত্রী। লোকজনের সামনে দিয়ে একাকি গভীর রাতে চলাফেরা বড় অশোভন হবে। লোকজন শেখায়েত করবে।
কিন্তু বুড়ির আর চোখ বুঝে না। মাঝে মাঝে চোখ বুঝে এলেই ধড়পড়িয়ে ওঠে বুড়ি। তার কাছে কি যেন লুকোতে চায়। হঠাৎ চা খেতে চায়। অথচ বুড়ি সচরাচর চা খায় না। পিঠে গরম পানির ছ্যাকা দিতে বলে। বুড়ির হলো কি আজকে। তাহলে কি তার পরিকল্পনা জেনে গেছে বুড়ি? দিল বেজারের দিলে নানারকম দোলাচল।

ঘ.
স্ত্রীর পরিকল্পনা জানার পর ওয়াজ মাহফিলে মন বসে না বেটে মৌলভির। ওয়াজে নামাজের ‘একমন তত্ত্ব’ বয়ান করতে গিয়ে তার মনই দুইভাগে ভাগ হয়ে পড়ে। একমন ওয়াজে মনোযোগ দেয় আরেকমন বাড়িতে স্ত্রীর গতিবিধি আন্দাজ করে। রাতে ওয়াজ মাহফিল থেকে আগে বাগেই বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নেয়। অবশ্যই ওয়াজে বের হবার আগে বুড়ি মাকে সতর্ক করে এসেছে। বলেছে- দিলকে চোখে চোখে রাখতে। তারপরও মন মানে না। তাই তড়িঘড়ি ওয়াজ শেষ করে বাড়ি পথ ধরেন মৌলভি।
রাত দ্বিপ্রহরে হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ফিরেন তিনি। উঠোনে ঢুকেই হাক দেয়- কই রে দিল বেজু। মাঝে মধ্যে মৌলভি আদর করে দ্বিতীয় অপভ্রংশে- তাকে দিল বেজু নামে ডাকে। প্রথম ডাকে সাড়া দেয় না দিল। দ্বিতীয় ডাকে ছোট্ট করে উত্তর দেয়- আসছি। ছোট্ট হলেও বিবির সাড়া তাকে স্বস্তি দেয়। অন্যদিন সে ঘরে ফিরে আগে মা’র কাছেই বসতেন। আজ সোজা বিবির কাছে।
এ বছর অগ্রহায়নের মাঝামাঝি থেকে শীত ঝেকে বসেছে। শীতের পোষাক ছাড়া বাইরে বেরুনো দূরের কথা বিছানায় ঘুমানো পর্যন্ত অসম্ভব হয়ে ওঠেছে। তাই রাতে পালানোর প্রস্তুতি হিসাবে নতুন জামার ওপর শীতের কাপড় আর গলা অব্দি মাথার কানটুপি পরিয়ে ছেলে শাকুরকে ঘুম পাড়ায় দিল বেজু। তার চোখ-নাক ছাড়া প্রায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আর শীতের রাতে গরমের ওম পেয়ে সেও দ্রুত ঘুমের জগতে পাড়ি দিয়েছে। বেটে মৌলভিও ওয়াজ শেষে শীতের রাতে ঠাণ্ডা থেকে বাঁচতে পাঞ্জাবীর ওপর শীতের পোষাক আর গলা অব্দি কানটুপি ঢেকে বাড়ি ফিরেছে। ফিরেই ওই অবস্থাতেই শুয়ে পড়েছে ছেলের পাশে।
দিল বেজার বানু রাগে ফুলতে থাকে। বুড়ির কারণে স্বামীর বাড়ি ফেরার আগেই পালাতে পারেনি সে। এখন মনে হচ্ছে- বুড়িকে গলা টিপে মেরে ফেলাই ভাল ছিল। মৌলভি কাপড়-ছোপড় পাল্টে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। তার আশংকা বিবিকে আন্দাজ করতে দেয় না। যেন অন্য দশটি দিনের মতোই সবকিছু স্বাভাবিক। কিন্তু কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারছে না দিল। মনটা কেবল পালাই পালাই করছে। করবেই তো। বহুদিনের ছাইছাপা আগুন হঠাৎ জ্বলে ওঠেছে তার মনে।
নিজের বিছানায় দিলবেজার। পাশের কক্ষে ছেলে শাকুরের পাশে বেটে মৌলভি। দুইজনেরই কানখাড়া। একজন অপেক্ষা করছে অন্যজনে পাহারা দিচ্ছে।
শাকুরের বয়স এগারো হলে কি হবে দেখতে সে বাপেরই সমান। লোকে বলে- শাকুর হয়েছে নানার মতো। যেমন টকটকে ফর্সা তেমন শোল মাছের মতো লম্বা একহারা গঠনের শরীর। ছেলের জন্মের পর মৌলভি দু’একবার স্ত্রীর কাছে কৈফিয়তও চেয়েছে। এ ছেলে কার? তবে প্রতিবারই দিল বেজার চোখের জলে বুক ভাসিয়ে পবিত্র কালামে পাকের নামে শপথ করেছে- জীবনে সে একজন পুরুষের বুকেই আশ্রয় নিয়েছেন আর তিনি হলেন বেটে মৌলভি। মৌলভি তার এ কথা বিশ্বাস করুক আর না করুক জবরদস্তি করতে যায়নি। এতে পক্ষান্তরে তারই বদনাম। লোকজন তাকে তার খর্বত্ব নিয়ে এখন বেটে মৌলভি বলে তখন বলবে আটকুড়ো মৌলভি।

সারাদিনের দেহ মনে বেদনার্ত দিল বেজার বানু কাৎ হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই চোখে রাজ্যের ঘুমে নেসে আসে। জোর করে জেগে থাকতে গিয়ে কিছুক্ষণ এপাশ-ওপাশ করেছেন বোকার মতো। এতে মৌলভি আরও সচেতন হয়ে গেছে। আরও গভীর রাতে যখন ঘনরাত্রীর গাঢ় অন্ধকার ফ্যাকাশে হয়ে ওঠেছে। এমন সময় হঠাৎ করেই ঘুম ভেঙে যায় দিলের। মৌলভির হালকা চালের নাক ডাকার শব্দে সে নিশ্চিত হয় তিনি এখন ঘুমোচ্ছেন। মৌলভির ঘুম ভারী, গাঢ়। বিছানায় গা এলিয়ে দিলে আর খবর থাকে না। কিন্তু মৌলভি ধরে আছে ভান। স্ত্রীর প্রতিটি পদক্ষেপ তার সন্দেহ গাঢ় থেকে আশংকার তৈরি হচ্ছে। কিন্তু বোকা দিল তার কিছুই টের পায় না। দিল ঘুমিয়ে পড়ার পর মৌলভি ছেলের সঙ্গে স্থান পরিবর্তন করে নিয়েছে। ঘুমন্ত শাকুরকে সরিয়ে বিছানার প্রান্তবদল করে মৌলভি।

ঙ.
রাত ত্রিপ্রহরে, ঘুম ভাঙার পর দিল বেজার বানু বিছানা থেকে ওঠে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। পর্দা সরিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে আন্দাজ করলেন ফজরের আজানের কিছুক্ষণ বাকি আছে। এখনই রওনা দেয়া দরকার। এখন রওনা দিলে ফজরের আজানের সময় বাপের বাড়ি পৌছানো যাবে। বাপের মত ছেলে শাকুরেরও ঘুম ভারি। তাই খুব সতর্ক পায়ে দিল বেজার দরজার ছিটকানি খুলে দেয়। এবার সেগুন কাঠের আলনা থেকে বোরকাটা গায়ে চাপিয়ে বিছানার দিকে যায়। মৌলভির ঘুম ভেঙে যাওয়ার ভয়ে দিল বেজার বানু। সিথানে টিমটিম করে জ্বলা হারিকেনটি বড় করে না। আলো-আধারীর মধ্যেই বিছানার দিকে যায়। বিছানার যে পাশে শাকুর শুয়েছিল সে পাশে গিয়ে আলতোভাবে শাকুরকে হালকা ধাক্কা দিয়ে ঘুম ভাঙায়। তারপর দ্রুতপদে ঘর থেকে বেরিয়ে অতিসর্ন্তপনে বাইরের শিকলটি লাগিয়ে দেয়।
একটু আগে যখন ছেলের পাশাপাশি শুয়েছিল মৌলভি তখনকার ঘটনাগুলো ভাবে, আর মনে মনে হাসে। দিল বেজার বানু বিছানায় ফিরেই পাশে শোয়া শাকুর মনে করে বেটে মৌলভিকে গা ঝাকিয়ে ইশারা করে। কিরে নানা বাড়ি যাবি না? ঘুমের ভান ধরা বেটে মৌলভি পরিস্কার বুঝে ফেলে- দিল পালাচ্ছে। তখন সে দুইবার হু-হু করে? দিল পালানোর উত্তেজনায় সবকিছু ভুলে যায়। পোশাক-শারীরিক কাঠামো এবং আগাম পরিকল্পনার কারণে শাকুর আর বেটের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না। বউয়ের পালানোর ইশারায় পেয়ে সে মাথা নিচু করে বউয়ের পিছু নেয়। দরজাটা পার হয়েই টপ করে বউয়ের পিঠে চড়ে বসে। দিল বেজু ছেলের কাণ্ড দেখে বলে- বেটা হাঁটতেও পারবি না। তোর বাপ জীবনটা পুইড়া অঙ্গার করলো তুইও দেখি বাপের মতোই হইছিস। মাকে কষ্ট দিস। বলতে বলতে মৌলভির ভারী দেহটা নেড়ে চেড়ে কাঁধ ঝাঁকিয়ে পিঠের উপর ঠিকমতো বসিয়ে নেয়। বলে, তুই তো দেখি তোর আব্বাজানের চেয়েও ভারী। তারপর পেছন থেকে তার দুইপা নিজের কোমরের সঙ্গে পেছিয়ে ধরে হাটা দেয়। ছেলে সেজে পিঠে চড়া মৌলভি কোন শব্দ করে না। বরং ছেলের মত করে স্ত্রীর কাঁধের মধ্যে নিজের মাথাটি ফেলে দেয় ঘুমের ভান করে।
বেটে মৌলভি বিছানায় সরে শুয়ে ছিলেন স্ত্রীর গতিবিধি সম্পর্কে সতর্ক হতে। কিন্তু নিজের স্ত্রীর পিঠে ছেলের মতো চড়ে বসতে পারবে এটা কল্পনাও করতে পারেনি। যখনই স্ত্রী তাকে ছেলে মনে করে পিঠে তুলে নেয়- তখনই তাকে একটি রোমাঞ্চকর অনুভুতিতে পেয়ে বসে। দেখতে চায়- বেচারী শেষ পর্যন্ত কি করে। ঘুমের ঘোরে বেচারি বুঝতেই পারেনি। এমনকি দাড়িগুলোর অনূভূতিই টের পায়নি। এতে বেটে মৌলভি নিজেই বিস্মিত।
বেটে মৌলভি ছেলেকে খুবই আদর করে। প্রতিবার জামা বানানোর সময় একই কাপড় দিয়ে একই ডিজাইনে ছেলে শাকুরের জন্য ও জামা বানিয়ে নেয়। দুইজনের মাপও প্রায় একই। ফলে তারা বাপ-বেটা যখন কোথাও বেড়াতে যান তখন অনেকেই তাদের ভাই বলে ভুল করে। আবার দুইজনের বয়সের ব্যবধানও সে দ্বন্দ্বকে আরও জটিলতর করে তোলে। বেটে মৌলভি ও তার ছেলে শাকুরের কণ্ঠও প্রায় একই রকম। ফলে অনেক সময় আড়াল থেকে কথা বললে বাড়ির লোকজনও দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ে। এমন অনেকবার ঘটেছে যে, শাকুর মাদ্রাসা থেকে ফিরেই উঠোনে কারও সঙ্গে কথা বলছে- কিন্তু বেটে মৌলভি মনে করে দিল মাথার কাপড় টেনে দিয়েছেন। অন্যদের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। শাকুর তার আব্বাজানের শারীরিক গঠনটি না পেলেও পেয়েছে কণ্ঠটি।
বেটে মৌলভির সঙ্গে দিল বেজারের বিয়ে হওয়ার তেমন কোন যুক্তি ছিল না। কিন্তু অন্ধবিশ্বাস আর একটি অঙ্গীকারের কাছে পরাজিত হয়েছে যুক্তি। দিল বেজারের আগে ঠাণ্ডা মৌলভির আরও দুইটি মেয়ের জন্ম হলেও তারা খুব ছোটবেলাতেই মৃত্যুবরণ করে। কিন্তু ঠাণ্ডা মৌলভির একটির মেয়ের শখ ছিল। তাই তিনি দিল বেজারের জন্মের পর অঙ্গিকার করেছিলেন- মেয়েটিকে কোন আলেমের কাছে বিয়ে দেবেন। সে গরিব-গুর্বা, অন্ধ-খোঁড়া যাই হোক না কেন।
দরদি কণ্ঠের জন্য ছোট বেলা থেকেই সুনাম ছড়িয়ে পড়ে বেটে মৌলভির। ফলে মেয়ে দিল খোশ বানুর জন্য বিয়ের প্রস্তাব পেতেই একবাক্যে ‘হ্যাঁ’ করেছেন তিনি। একবার চিন্তা করার সময়ই পাননি তাদের শারীরিক অসামঞ্জস্যতা। বেটে মৌলভির কাছে তিনি মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। আর গোড়া মৌলভি বাড়ির মেয়ে হিসেবে পারিবারিক সম্মান দেখাতে গিয়ে সে বিয়েতে রাজী চুপচাপ সম্মতি দিয়েছিল দিল বেজার।
কারণ পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চি উচ্চতার সুঠামদেহী দিলের বিপরীতে চার ফিট উচ্চতার বেটে মৌলভির সামঞ্জস্যতা হয় না। এমনিতেই আদরের প্রতিবন্ধকতা তার উপর এ বৈষম্য তাদের সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে দাওয়াত কবুলের পথও সংকুচিত করে। তবে ঠাণ্ডা মৌলভি মেয়ের জামাই বেটে মৌলভিকে বিচার করে আধ্যাতিœক উচ্চতায়।

চ.
কৃষ্ণপক্ষের টানে চাদের আলো অনেকটাই ম্লান। আলোচ্ছায়ায় পথ স্পষ্ট দেখা গেলেও মাঝে মধ্যে গা চমকানো নানা শব্দ চারদিকে, পাখির ডানা ঝাপটানি। কোনটি পোকার আর কোনটি পশুপাখির। গাজির বিলের বুক চিড়ে সুখছড়ি নদীর পাশ ধরে মেটোপথ চলে গেছে টংকাবতী কুলে। টংকাবতী পার হলেই মল্লিক চোয়াং হয়ে পদুয়া। জিনপরীতে ভয় করে না দিলবেজার। ছোটবেলায় বাপের কাছে শেখা দোয়া দরুদগুলো এখনও তার মনে আছে। ছোটবেলা থেকে অনেকের মুখে শুনে আসছে- তার বাবা ঠাণ্ডা মৌলভি নাকি রাত বিরাতে ওয়াজ মাহফিল বা দাওয়াত শেষে ফেরার পথে বেয়াদবি করার অপরাধে বহু জ্বিনপরিকে এসব দোয়া দরুদ পড়ে অন্ধ ও বোতলবন্দী করেছে।
ছেলে হয়ে পিঠে চড়ে বসা বেটে মৌলভির ওজন নিয়ে আর হাঁটতে পারে না দিল বেজু। পিঠে ভার, মনে ভয়। দুইয়ে মিলে তাকে আরও বেশী কান্ত করে ফেলে। এই সেদিন বউ হয়ে এসেছে বেটে মৌলভির বাড়িতে। সেদিন কোলে করে দুধ খাইয়েছে শাকুরকে। দিনদিন বাড়ন্ত ছেলেটা দেখতে বাপের সময় হয়ে ওঠেছে। সুখছড়ির বাঁশঝাড় আর ডাল ছড়ানো কড়ই গাছের ঘন ছায়া মাড়িয়ে দিল বেজু হাঁটে আর ভাবে। কি ভাবে! কি ভাবে না? অতীত স্মৃতি ভাবতে ভাবতে তার মন ছুটে যায় অকল্পনীয় ভবিষ্যতে। শুধু কি সে? মৌলভির মনের মধ্যেও চলছে নানা ভাংচুর। কৌতুহল আর রহস্যের খেলা।
অদূরে টংকাবতী নদী। অন্ধকারের মধ্যেও আবচা আবচা নদীতীরের বাঁশঝাড়গুলো দেখা যায়। খানিকটা উত্তরদিকে লালবিন্দুর মত কি একটা জ্বলছে। দিল বেজু আন্দাজ করে নেয়, লালবিন্দুটি নিশ্চয়ই ঢাইরকূল মসজিদের মিম্বরের আলোকবাতি। বেজু শাকুরের পায়ে চিমটি দিয়ে বলে- শাকুর, ওঁ শাকুর। শাকুরের কোন সাড়া নেই।
পিঠের ভারে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে ঢাইলকূল এসে পৌঁছে দিল বেজু। ছেলেকে পিঠ থেকে নামিয়ে দিয়ে বলে, আর পারছি না বাবা। এবার হেঁটে চল। এখনো অনেক পথ।
কথাটি বলেই টেনে নিঃশ্বাস নেয় বেজু। মুহূর্তের মধ্যেই মুখের কাপড় সরিয়ে নিজেকে প্রকাশ করে বেটে মৌলভি। নিঃশ্বাস ফেলেই ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে দিল বেজু। ঘটনার আকস্মিকতায় যেন একখণ্ড পাথরে পরিণত হয়।
মৌলভি কথা বলে ওঠে- বৈতাল, রাতের আঁধারে পালাচ্ছিস। বললেই তো হতো, পাল্কিতে করে ঠাণ্ডা মৌলভির ঘরে পৌছে দিয়ে আসতাম। ঠাণ্ডা মৌলভির মেয়ে, বেটে মৌলভির বউ হয়ে পালাতে তোর বুক কাঁপলো না। মৌলভির গলায় কোমল তাচ্ছিল্যের সুর।
মুখ দিয়ে কোন শব্দ বেরুয় না বেজুর। পাথরের মতো মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে কাঁপতে থাকে। স্ত্রীর ভয়ার্ত কাঁপুনি দেখে মৌলভির মন নরম হয়। পরক্ষণেই আরেকটি নতুন কাণ্ড ঘটায় মৌলভি। আলগি মেরে উঁচু হয়ে দিল বেজুর গলাটা জড়িয়ে ধরে নাগালে আনে। চকাস চকাস করে দু’গালে চুমো খেয়ে বলে- এবার কোথায় যাবি? বাপের বাড়ি না লাঙের বাড়ি?

দাঙ্গা - কাফি কামাল (ছোটগল্প)

দাঙ্গা
কাফি কামাল
.......................
সকাল থেকেই হু হু হাওয়া বইছে। যেন দখিনের বঙ্গোপসাগর থেকে আসছে ঝড়ের পূর্বাভাষ। বোশেখ মাসের দ্বিতীয় বুধবার হেলে পড়েছে পশ্চিমে। আর উঠোনে তরজা বেড়া বানাতে বানাতে আলী হোসেনের ভাবনায় ঘুরপাক খাচ্ছে কালবোশেখী। যেটা সকাল থেকেই আসি আসি করছে। হালের গরুগুলো গুতোগুতি করে গোয়াল ঘরের একপাশের বেড়া ভেঙে ফেলেছে। আগেরদিন তা দেখার পর ছেলেদের একচোট বকাবকি করেছে। তারপর মেরামতের জন্য বাজার থেকে বাঁশ কিনে এসেছে। সকাল থেকেই সে বাঁশ ছেচে বেড়া বানানোর আয়োজন করছেন নিজেই।
গাজির বিলে আলী হোসেনের জমিনে হাল বাইছে কামলা মাহাদু। দুপুরের খাবার খেয়ে বিশ্রামের পর দ্বিতীয়দফায় লাঙ্গলের ফাল বসিয়েছে জমিনে। গরুগুলো হাটতে চাইছে না। মাহাদু’র নিজেরও পা চলছে না। কিন্তু আলী হোসেনের নির্দেশ সন্ধ্যার মধ্যেই এ দাগের জমিতে হাল শেষ করতে হবে। তাই হেলে দুলে ধীর গতিতে হাল বাইছে সে। গলায় একটি গানের কলি গুমরে মরছে। এমন সময় কয়েকজন সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে গাজির বিলে যায় দিয়াপাড়ার মোতাব্বির। কাছাকাছি গিয়েই কণ্ঠে রাগ ঢেলে, চোখ লাল করে নির্দেশ দেয়- এ মাহাদু হাল ছেড়ে দে।
বিস্ময়বিমূঢ় হয়ে মাহাদু জিজ্ঞাসা করে- কেন?
এ জমিন আমার।
বলেন কি! সারাজীবন হাল চষলাম একজনের আর এখন জমি দাবি করছেন আপনি!
হ্যাঁ, এ জমি আমার-
তো আমাকে বলে কি লাভ। জমির মালিকরে গিয়ে বলেন।
মোতাব্বিরের স্বরে রাগের মাত্রা বাড়ে- ওই ব্যাটা কামলা, এত কথা কস ক্যান। জলদি ওঠ।
ধানী জমির লোভ বড় নিরাময়হীন। সে লোভ গিলেছে মোতাব্বিরকে। বেশকিছুদিন ধরেই জমিটি নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে সে। আগের মওসুমে জমিতে আলী হোসেনের চাষ বন্ধ করার চিন্তা করলেও সাহস পায়নি। এবার প্রস্তুতি নিয়েই নেমেছে। মাহাদু খেয়াল করে দেখে মোতাব্বির লোকজন নিয়ে এসেছে। তাদের হাতে দা-কিরিচ। তাই সে কথা বাড়িয়ে হাল ছেড়ে দেয়। গরুগুলোকে বিলের মধ্যে ছেড়ে দিয়ে সোজা আলী হোসেনের বাড়িতে ছুটে যায়।
আলীকে দেখে মাহাদু বলে ওঠে- ভাইজান হাল নিষেধ করেছে?
কে রে?
দিয়া পাড়ার মোতা।
বলিস কি? চাইলেই কি হাল নিষেধ করা যায়? চল দেখি...
প্রায় তৈরি হওয়া বেড়াটি ওই অবস্থায় রেখেই বিলের দিকে ছুটে যায় আলী হোসেন। পেছনে পেছনে মাহাদু আর জরিনা খাতুন। আলী হোসেনের স্ত্রী। একপা মাটিতে আরেকপা বাতাসে রেখে আলী গাজীরবিলে পৌছে।
তখনও লোকজন নিয়ে জমির আলেই দাড়িয়ে আছে মোতা। তাকে দেকে আলী হোসেন চিৎকার মারে- কি রে মোতা হাল নিষেধ করেছিস কেন।
জমি আমার তাই করেছি- মোতার কণ্ঠে নির্লিপ্ততার সুর।
আমার বাপের দিনের জমি তোর হবে কেন।
তোর বাপে তো আমার জমি আরেকজনের কাছে কিনেছে। আমার কাছে তো কিনেনি।
দুইজনের তর্কের মধ্যে এসে দাঁড়ায় মাদুলীপাড়ার বদরুল চৌকিদার। সে হেটে যাচ্ছিল ডলুনদীর পাড় ধরে। দুইপক্ষের গ্যাঞ্জাম দেখে জমিনে নেমে এসেছে। চৌকিদার রাগান্বিত আলী হোসেনরে জড়িয়ে ধরে। ভাই গ্যাঞ্জাম করে লাভ কি। আইনের পথে যান।
রাগ যতই হোক মোতার পক্ষে বেশী লোকজন দেখে নিজেকে কিছুটা সামলে নেয় আলী। চৌকিদারের কথায় সায় দিয়ে বলে- হ হ, আইনের পথেই যাব। সমুন্দির পুতরে চৌদ্দ শিকের ঘরে ঢুকিয়ে ছাড়বো।
জরিনা বেগম দেখে একলা ঝগড়া করতে গেলে বাচার পথ নেই। তাই স্বামীর কোমরের লুঙ্গির প্যাচ ধরে ঘরের দিকে টান দেয়। খানিকক্ষন রাগে গজরাতে গজরাতে এদিক-ওদিক করে আলী। তারপর বাড়ির পথ ধরে।


খ.
তিন বছর আগের এক শীতের রাতে চুলোর আগুনে পুড়েছে মোতাব্বিরের বাড়ি। মধ্যরাতের সে আগুন গিলে খেয়েছে সবকিছু। পুড়ে গেছে বাড়ির বেশীরভাগ জিনিষপত্র। জমি জমার দলিলপত্রও ছাই হয়েছে। কিন্তু লোকে বলে- পুড়ে গেলে উড়ে আসে। ঘরে আগুন লাগলে নাকি দ্রুতই মানুষের উন্নতি হয়। আগুনে পোড়া বাড়িতে নাকি দ্রুত স্বচ্ছলতা আসে। প্রবাদের সূত্র ধরেই যেন আচম্বিত জমির খবরটি পায় সে।
জমির দলিল তুলতে কয়েকদিন তহশিল অফিস আর সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে যেতে হয় মোতাব্বিরকে। তহশিল অফিসে খোঁজ-খবর করতে গিয়েই তথ্যটি আবিস্কার করে সে। পুরোনো কাগজপত্রে জানতে পারে তাকে ১৯৫৬ সালে তার দাদি ওই জমিটুকু দানপত্র করেছেন। জমির পরিমানও কম নয়। পাক্কা একুশ গন্ডা। দাগ নং: ১৬২/১৬৩/১৬৪। খতিয়ান: আরএস ১৮-১৯, এসআর ২৮-২৯, সিএস ৪৮-৪৯। মৌজা: গাজির বিল, সাং- কাতলবিলা। জমির দাগ-খতিয়ান খুঁজে দেখা গেল এখন সেটা দক্ষিণ পাড়ার আলী হোসেনের দখলে। এটাও জানতে পারলো জমিটি দাদির মৃত্যুরপর ভাগের অংশ হিসেবে তার ফুপো সকিনা বিবি বিক্রি করেছিল আলী হোসেনের বাবাকে। কিন্তু জমিতো তার। তার নামেই আগে লিখে দিয়েছেন দাদি।
জমির আবিস্কারের এমন তথ্যে সে রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে ওঠে। তার রোমকূপ দিয়ে ঘামের ফোটা বেরিয়ে আসে। মুহুর্তেই কয়েকবার ভেসে ওঠে দাদির মুখ। নাকের নোলকটি কয়েকবার দুলে ওঠে। ঠোটের কোনা দিয়ে যেন ঝরে পড়ে পানের কয়েক ফোটা রক্তিম রস। দাদির সে হাসি মাখা মুখকে একবার মনে মনে সালাম করে সে। শ্রদ্ধায় মাথা নুইয়ে আসে। আনমনে হাতের সিগারেটটি হাতের আঙুলের ফাক থেকে ঝরে পড়ে। পর মুহুর্তে রাগও হয়। শালির বুড়ি গোপনে জমিটি দিয়েছে বটে জীবনে অভোগ্যই রয়ে গেল। সামনেও যে কত যক্কি আছে, খোদা জানে।
বেশ ক’দিন কথাটি গোপন রাখে সে। একদিন দুপুরে খাবার সময় মোতাব্বির স্ত্রীর কাছে কথাটি তুলে। জানিস সোনাই এবার আমি সোনা-ই পাইছি।
মানে- বিস্ময় সোনাই বিবির কণ্ঠে।
মাটির সোনারে... মাটির সোনা, চাষ দিলেই ভরে গোলা।
খুলে বলেন, আপনার প্যাচ মারা কথা বুঝি না।
আরে একুশ গণ্ডা জমি পাইছি। এখন বুঝে নেওন বাকি।
শুনেই সোনাই বিবির চোখ কপালে ওঠে। বলেন কি!
হ্যাঁ রে সোনাই।
সোনাইর চোখে আনন্দ আর আতংকের যৌথতা ফুটে ওঠে।
আরেকদিন রাতে বাজার থেকে ফেরার সময় বাল্যবন্ধু আবদুস সাত্তারের কাছেও কথাটি তুলে মোতাব্বির। জানতে চায়, কি করা যায়।
মোতাব্বিরের কাছে এভাবে জমির কথা শুনে অনেকেই আশ্চর্য হয়েছে। কেউ আবার তাকে জমি দখলে যেতে বলেছে। আবার কেউ কেউ তার দাদির এ দান নিয়ে আলোচনা তুলেছে। যার কিছু বাস্তব, কিছু প্যাচাল।
তবে মাদুলীপাড়ার ছমিরুদ্দিন শুনেই বলে- মোতা এখন তো জমি মানেই সোনা টুকরো। সোনার চেয়েও দামী। সোনার ক্ষয় আছে, জমির তা নেই।
সে জন্যই তো বুদ্ধি চাই কাকু।
তোর জমি তুই দাবি করবি, দখলে যাবি তাতে আবার বুদ্ধি কিসের!
জমিতো আলী হোসেনের দখলে। বহু আগে তার বাপ কিনেছে আমার ফুপো সকিনা বিবির কাছে।
তো কি হয়েছে? জমি তো আগেই তোর নামে লিখে দিয়েছে তোর দাদি।
তা দিয়েছে, কিন্তু প্রকাশ তো করেনি বুড়ি।
আরে পাগল সে ভেবেছে তখন প্রকাশ করলে অন্যরা ঝামেলা করবে।
এখন তো ঝামেলাতেই জড়িয়ে গেছে।
দেখ মোতা, আগ-পাছের অত ভাবনা ভেবে মানুষ চলতে পারে না। আগামীকাল কার কি হবে সেটা কি আগাম কেউ জানি? এই যে, এতবছর জমিটি ছিল আলী হোসেনের, এখন দেখা যাচ্ছে জমি তোর।
কাকা আপনি তো জমি-জমার ফাঁক-ফেরকা নিয়ে কাজ করেন। এখন সোজা করে বলেন তো কি করা যায়- মোতাব্বিরের কণ্ঠে বুদ্ধি যোগাড়ের কৌতুহল।
এখন কাগজপত্র যোগাড় কর, তারপর মামলা কর, জমিতে হাল বন্ধ করে দে।
মোতাব্বির যা বুঝার বুঝে নেয়- কিছু পেতে হলে, কিছু তো করতেই হবে। সেটা মারামারি.. ঝগড়াঝাটি যাই হোক।
জমি আবিস্কারের পর থেকেই তহশিল অফিসে যাতায়াত বেড়ে যায় মোতাব্বিরের। এ দলিল, সে দলিল, নামজারির কাগজ, খাজনার রশিদ, খতিয়ান, পর্চা, সার্ভে... কত কিছু। টানা কয়েক মাসের দৌড়ঝাপ শেষে কাগজপত্র সব তার হাতে আসে। কেবল দাবি করে দখল বুঝে নেয়াই বাকি। কিন্তু এ কাজটিই সবচেয়ে কঠিন আর ঝুঁকিপূর্ণ। আলী হোসেনের কাগজপত্রও সঠিক। তবুও নিজের জমির অধিকার আদায়ের এক দুর্দমনীয় নেশা তাকে পেয়ে বসে।
এই কান ওই কান হতে হতে মোতাব্বিরের জমি আবিস্কারের কথাটি একদিন আলী হোসেনের কানেও পৌছে। হঠাৎ সেদিন চাচাতো ভাই শফিক তার কানে তুলে। গাজিরবিলে তার পৈতৃক সূত্রে পাওয়া তার একুশ গণ্ডা জমি নাকি দিয়াপাড়ার মোতার। শুনে সে আকাশ থেকে পড়ে। সে তো পেয়েছে পৈতৃক সূত্রে। তাই প্রথমে কথাটিকে গুরুত্ব দিতে চায়নি। এক পর্যায়ে কথাটি গ্রাম ছড়িয়ে গেলে পরের মঙ্গলবার আলী হোসেন তহশীল অফিসে ছুটে যায়। খোঁজ নিয়ে দেখে মোতাব্বিরের দাবি অমূলক নয়। তখনই তার মৃত বাবার হাসিমাখা মুখটি ভেসে ওঠে। সরলতার প্রতিকৃতি একটা। এ সরলতার জন্যই পদে পদে ঠকেছেন জীবনে। খোঁজ-খবর না করেই একজনের জমি আরেকজনের কাছে কিনেছে লোকটি। রাগে বাপকে দাদার নাম তুলে একটি গালি দিলো সে। পরমুহুুর্তে ভাগ্যকে একবার দোষলো। বুঝতে পারলো সামনে তার ঝড়ের দিন আসছে।


গ.
কী একটা কঠিন অসুখে হুট করে মরে গিয়েছিল মোতাব্বিরের বাপ। লেজটি ধরে ফেলার আগে পালিয়ে যাওয়া ফড়িংয়ের মতো। তখন তার বয়স এগারো বছর। মাঘ মাসের হাড় কাপানো শীতের এক রাতে। পরদিন ভোরে ঘুম থেকে ওঠেই দেখে তার ববা শুয়ে আছে সাদা চাদর গায়ে জড়িয়ে আর তাকে ঘিরে বাড়ির সবাই দোয়া-দরুদ পড়তে পড়তে চোখ মুচছে। বাবার মৃত্যুর ওই দৃশ্যটুকুই তার মনে আছে। আর মনে পড়ে বাবার মৃত্যুর ৪০দিন পর মোতাব্বিরের মা অন্য পুুরুষের সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিল। তৎকালে পুরো তল্লাটে এ ঘটনা ছিল এক মুখরোচক কাহিনী। বাবা-মা হারানো মোতাব্বির দাদির আশ্রয়ে বড় হয়েছে। তার দিনে কেটেছে সারাদিন টো টো করে ঘুরে বেড়িয়ে আর দাদির ফুট ফরমায়েশ খেটে। তখনও তার বৈষয়িক অস্থিরতা বুঝার বয়স হয়নি। মাঝেমধ্যে মা-বাবার কথা মনে পড়লেও বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গ পেলে তা মুহুর্তেই ভুলে গেছে।
মোতাবিব্বরের দাদি ফুলমতি বানু একদিন চুনতি রশিদ ভেণ্ডারের বাড়িতে যায়। মোতাব্বিরকে বগলদাবা করে সঙ্গে নেয়। ভেণ্ডারকে কাছে ডেকে বলে- আমারে একটা কাজ করে দিতে পারবেন?
পারবো না কেন, বুবু কি করতে হবে?
আমার বড় ছেলেটি হুট করে মরে গেছে। তার বউও পিছুটান ফেলে নিজের পথ বেছে নিয়েছে। অন্য ছেলের বউটাও রীতিমতো দজ্জাল। তাই আমি মৃত্যু আগে আমার বড় ছেলের একমাত্র পুতটারে কিছু জমি দানপত্র করতে চাই।
ভালো কথা- ভেণ্ডারের সংক্ষিপ্ত উত্তর।
কিন্তু বিষয়টা খুব গোপনে করতে হবে। কেউ যেন টের না পায়।
রশিদ ভেন্ডার তাকে দলিলপত্র নিয়ে আরেকদিন আসতে বলে।
তিন সপ্তাহপর আরেকদিন বৃষ্টির ঝাপটা ঠেলে রশিদ ভেণ্ডারের সঙ্গে আনুগঞ্জ সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে যায় ফুলমতি। খরচা-বিরচা আগেই দিয়ে রেখেছিল। বিয়ের দেনমোহর বাবদ পাওয়া একুশ গণ্ডা জমি নাতি মোতাব্বিরকে দানপত্র করে সন্ধ্যায় ঘরে ফিরেন বুড়ি। পুরো ঘটনাটা এতটাই গোপন ছিল যে, তার অন্য ছেলেমেয়েরা কোনদিন টেরই পায়নি। মৃত্যু আগে তিনি এ ব্যাপারে কাউকে কিছু বলেননি। ফলে দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে কেউ জানতেই পারেনি। ফুলমতি বানুর মৃত্যুর পর তার ছেলে মেয়েরা সবাই একত্রিত হয়ে চেহলামের দিন জমিজমা ভাগবন্টন করে নেয়। তার ফুপো সকিনা বিবির ভাগে পড়েছিল ওই জমি টুকু। যা মোতাব্বিরকে দানপত্র করে দিয়েছিল তার দাদি। পরে ভাগের জমি হিসেবে তিনি তা বিক্রি করে দেন দণি পাড়ার আকরাম হোসেনকে। তারই ওয়ারিশি সূত্রে জমিটুকু পেয়েছে আলী হোসেন। চারভাইয়ের ভাগের অংশে।


ঘ.
সারাদিন মৌখিক ঝগড়া-ঝাটির পর রাতে আলী হোসেন ছুটে যায় তার মুরব্বি আশরাফ আলী সিকদারের বাড়িতে। বেদনার্ত কণ্ঠে বলে- সিকদার ভাই, সারাজীবন আপনাদের পিছনে দৌড়েছি। আমাদের বাপ-দাদারাও আপনাদের পিছনেই হেটেছে। এখন আমি বিপদে পড়েছি। আমার বিপদ কি চেয়ে চেয়ে দেখবেন?
দেখ আলী, ঝামেলা পাকিয়েছে তোর বাপ। হক টাকা দিয়ে ভেজাল জমি কিনেছে। এখন কি করার আছে- আশরাফ সিকদারের কণ্ঠে শীতলভাব।
আলী হাল ছাড়ে না। একটু নিরবতার পর বলে- মোতাব্বিরকে নিয়ে অত চিন্তা করি না। কিন্তু তাকে উস্কে দিচ্ছে নবীরউদ্দিন চৌধুরী।
নবীর চৌধুরীর কথা শুনেই চোখে বিজলী খেলে আশরাফ সিকদারের। কৌতুহলী কণ্ঠে জানতে চায়- কি বলে সে?
আমাকে সরাসরি কিছুই বলেনি। শুনেছি, সে নাকি মোতাব্বিরকে বলেছে- জমি দখলে যেতে।
তাই নাকি- আশরাফ সিকদারের কণ্ঠে উষ্মা।
এখন কি করতাম?
চাইলেই কি দখলে যাওয়া যায়। তোর বাপতো ওই জমি নগদ টাকায় কিনেছে। যা তুই চিন্তা করিস না। দেখা যাক কি হয়। ছেড়ে কথা বলার দরকার নেই। কোন ঝামেলা করতে চাইলে- জানাবি।
আলী হোসেন আশ্বস্ত হয়ে বাড়ি ফিরে।
আশরাফ সিকদার আর নবীর উদ্দিন চৌধুরী পরস্পরের জাতশক্র। ব্রিটিশ আমল থেকেই দুই পরিবারের মধ্যে চলছে মর্যাদার লড়াই। ইউনিয়ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বহুবার সরাসরি হাঙ্গামা হয়েছে। খুনোখুনির ঘটনাও ঘটেছে পাকিস্তান আমলে। দুই পরিবারের পথ সে থেকেই দুইদিকে চলে গেছে। যদিও সংগ্রামের বছর প্রকাশ্যে শান্তি কমিটির সঙ্গে যুক্ত থেকেছে আর গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছে চৌধুরী আর সিকদার পরিবার। যুদ্ধের পর শেখের পাটি করলেও সিকদার আর চৌধুরী পরিবারের ছেলেরা এখন রাজনীতিতে দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েছে। নৌকা, ধানের শীষ আর লাঙ্গলে মিশে গেছে বাঙালী চরিত্রের চিরন্তন বহুমুখীনতা। তবে এখনও তারা সে কলহ-বিরোধের ঘেরাটোপ ডিঙাতে পারেনি। এলাকার ভালমন্দে পক্ষ-বিপক্ষ, দলাদলিতে তারাই মূল হোতার ভূমিকা ধরে রেখেছে। আলী হোসেন বাপের কাছে শুনেছিল- ব্রিটিশ আমলে কালি হাটের মালিকানা নিয়েই নাকি দুইপরিবারের বিবাদের সূচনা। কালক্রমে তা ডালপালা ছড়িয়ে এখন মিথে পরিণত হয়েছে। এলাকার লোকজন ঝামেলায় পড়লে একপক্ষ চৌধুরী পরিবারে আরেকপক্ষ সিকদার পরিবারের কাছে ছুটে যায়।
এখন নতুন মিথ হতে যাচ্ছে আলী-মোতার জমির দ্বন্দ্ব। ঝগড়ার পর থেকে তাদের সামাজিক সম্পর্কও ভেঙে পড়ে। দুইজনে এক মসজিদে নামাজ পর্যন্ত পড়তে যায় না। এমনকি ঈদের দিন পর্যন্ত এ বাড়ির কেউ ও বাড়িতে ঢু মারে না। উল্টো কথায়-বার্তায় পরস্পরকে সুযোগ পেলেই ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে। এ ওর পরিবার সম্পর্কে বদনাম করে। এমনকি বিয়ে ভেঙে দিতেও কুণ্ঠিত হয় না।
গত বোরো মওসুমে ডলুনদীতে বাঁধ দেয়ার সময়ও চৌধুরী এবং সিকদার পরিবারের মধ্যে দুই সপ্তাহ কথার লড়াই চলেছে। এ ডলুর পানিতে গাজীর বিলে চাষ হয়। মিয়া বাড়ির মোটকা বদরু প্রতিবছর ডলুতে বাধ দেয়। নিজের জমিও চাষ হয়। অন্যদের জমিতে পানি দেয়ার বিনিময়ে আয় কানি প্রতি হাজার টাকা। আলী হোসেন জাতচাষা। আজকাল নিজে চাষের কাজ না করলেও কামলাদের তদারকি করে। কিন্তু গেলো বর্ষা মওসুমে অনেক হাঙ্গামা করেও জমিতে আর হাল ফুটাতে পারেনি। দুইবার হাল চষতে গেলে বাধা দিয়েছে মোতাব্বির। তবে ঝগড়া-ঝাটি মুখে মুখেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। ভাদ্রমাসে প্রথমবারের মত চেয়ারম্যানের কাছে বিচার দেয় মোতাব্বির। নবীর চৌধুরীর চাচাতো ভাই খবির চৌধুরী স্বাভাবিকভাবেই মোতাব্বিরের পক্ষ নেয়। তারপরও প্রতিবেশীদের পরামর্শে শালিসে বসে আলী হোসেন। শালিসকে কেন্দ্র করে আলী হোসেন একদিন মোতাব্বিরের ফুপো সকিনা বানুর শ্বশুর বাড়িতে যায়। কিন্তু সকিনা বানুও মারা গেছে কয়েক বছর আগে। এখন তার ছেলেরা এ ব্যাপারে কোন দায়িত্ব নিতে নারাজ। এমনকি তারা কথা দিয়েও জমি নিয়ে কোন শালিসে আসেনি।
সন্ধ্যা থেকেই দুইপক্ষের লোকজনে বোর্ড অফিস মুখরিত হয়ে ওঠে। কিন্তু বিচারের মাঝপথেই উত্তেজিত হয়ে ওঠে আলী। না হয়ে উপায়ও বা কি। খবির চেয়ারম্যান তাকে বলে- বহুদিন তো খাইছো এবার মোতা খাওক। চেয়ারম্যানের কথা শুনেই উত্তেজিত আলী হোসেন শালিস থেকে বেরিয়ে আসে।
দু’একদিনের মধ্যে পরিস্থিতি আর ঘোলাটে হয়ে পড়ে। দুইপক্ষই হাল নামাতে যায় ওই জমিতে। এ নিয়ে তাৎক্ষনিক সহিংসতায় আলী হোসেনের বড় ছেলে আকবর হোসেনের মাথা ফাটিয়ে দেয় মোতাব্বিরের লোকজন। আবার মোতাব্বিরের চাচাতো ভাইয়ের ডানহাতে কিরিচের কোপ দেয় আলী হোসেনের মেঝছেলে। এ নিয়ে ফৌজদারী মামলা হয় পরস্পরবিরোধী। পুলিশ আসে দুই বাড়িতেই। ঢামাঢোলের মধ্যে দেওয়ানী আদালতে যায় মোতাব্বির। একসপ্তাহের ব্যবধানে আলী হোসেনও সে পথ ধরে। শুরু হয় দীর্ঘমেয়াদী লড়াই।


ঙ.
মামলা-মোকদ্দমা লড়তে লড়তে পেরিয়ে যায় দুই বছর। ইতিমধ্যে জেলখানা ঘুরে এসেছে আলী হোসেনসহ তার দুই ছেলে। মোতাব্বিরও তার চাচাতো ভাই মোকলেছ বেশকিছুদিন খবির চেয়ারম্যানের শেল্টারে থেকেও গ্রেপ্তার এড়াতে পারেনি। কিছুদিন আগে তারাও জামিনে বেরিয়ে এসেছে। এরই মধ্যে থানার ওসি পরিবর্তন হয়েছে। আগের জন নিত মোটা অংশ, নতুন ওসি নেয় ভেঙে ভেঙে। দুইপরিবারের লাখ টাকার বাণ্ডিল হজম করেছে দুই ওসি। আর সে বিরোধপূর্ণ জমিতে বুনোঘাসের দঙ্গল রাজত্ব করছে। দেখলে মনেই হয় না সেখানে কখনো চাষ-ভাষ হতো। যদিও তারা এ জমি নিয়ে অনেক পরিকল্পনা করেছে। দুইপরিবার টের পেয়েছে- থানাওয়ালা টাকা খায় রাক্ষসের মত আর আদালতওয়ালা টাকা খায় জোকের মত। তবু তাদের জেদের প্রান্তরে বোধ-বুদ্ধি জন্মে না।
ডলুপাড়ের বাঁশঝাড়ের ভেতর নিন্মচাপ সারছিল মকরিয়া পাড়ার হামদু মিয়া। গাজির বিলের জমির আলী হোসেনের মামলার স্বাক্ষী সে। নিম্নচাপ প্রশমন হতে তার সময় লাগে। তো সে কোশিশ করতে করতে খেয়াল করে ঝরা বাঁশপাতার কার্পেট জমেছে। সে মুখের বিড়িটা ছুটে ফেলে পায়ের তলায় ঝরাবাঁশপাতার আরাম অনুভব করে। কিছুক্ষণ পর নদীর খাদে নেমে হাঁটু সমান চলন্ত পানিতে ঝুপ করে বসে পড়ে। দ্রুত হাত চালিয়ে নিজেকে পরিস্কার করে পাড়ের দিকে ওঠে আসে। এ সময় দেখে কিছুটা ভাটিতে জাল বাইছে মনিরুজ্জামান। হামদু মিয়া তাকে ডাক দেয়- মনির মাছ পাইলি রে?
একটু সময় নিয়ে সে জবাব দেয়- একটা মাত্র বোয়ালের বাইশ।
হামদু মিয়া পাড়ে ওঠে দেখে- গাজির বিলে লোকজন। দেখে সেদিকে হাটা দেয় হামদু।
অগ্রহায়ন মাসে আদালতের একটি রায় পায় মোতাব্বির। রায় পেয়েই লোকজন নিয়ে হাল চষতে যায় সে। জমিতে লাঙ্গলের ফাল কয়েকটি চক্কর না খেতেই প্রায় দ্বিগুন লোক নিয়ে তাতে বাধা দেয় আলী। এ সময় মোতাব্বির হুংকার ছেড়ে বলে- আদালত আমারে রায় দিয়েছে। বাড়াবাড়ি করলে ভাল হবে না।
আলী হোসেনও চড়া গলায় জবাব দেয়- আদালত রায় দিয়েছে, জমি তো দেয়নি। আদালতের কাছেই জমি বুঝে নে।
ওই কথা বলে লাভ নেই- জমি ছেড়ে দুরে গিয়ে কথা ক।
আরে মোতা আদালত তোরে দিছে একবার আমারে দিব তিনবার। সময় থাকতেই জমি থেকে ওইটা যা।
এ নিয়ে হৈ চৈ চলতে থাকে। হৈ চৈয়ের ফাঁক গলে হালের গরুগুলো তখন বিলের আরেক প্রান্তে দীঘল ঘাসে আত্মহারা হয়ে ওঠেছে। মানুষের ঝগড়ায় গরুর কি আসে যায়।
কিন্তু দুপুরের তপ্ত রোদের মতো উত্তপ্ত হয়ে ওঠে আলী আর মোতার মাথার চান্দি। দ্রুতই পরিস্থিতি সংঘাতের দিকে মোড় নেয়। মোতাব্বির বলে, আমার জমি আমি চাষ করবোই। প্রয়োজনে লাশ পড়বে।
আলী হোসেনও কম যায় না- কবে করবি বল। তোর যখন লাগতে শখ হয়েছে, শখ মিটিয়ে দিই।
দেখবি কালই...।
যা যা লোকজনরে খবর দে। কি খাইতে ইচ্ছা হয় শেষ খাওয়া খেয়ে নে। দেখি কার কত হেড়াম আছে।
হ, তুইও খেয়ে নে।
এবার গ্রামের লোকজন আন্দাজ করে নিল, দাঙ্গা অনিবার্য। এ জমিন নরবলি চায়। কার মায়ের বুক যে খালি হয়- খোদা জানে।


চ.
রীতিমত ঢাকঢোল পিটিয়ে স্বার্থের লড়াই। এক রাতের প্রস্তুতিতেই উন্মুক্ত আয়োজন। পরদিন সকালে দাঙ্গা। রাতের মধ্যেই দাঙ্গাবাজ ভাড়া করা, লাঠি-কিরিচের যোগাড় সব করতে হবে। তবে তাতে কারও কান্তি নেই।
মোতাব্বির তার শ্বশুরপক্ষীয় সাতছড়ির বিখ্যাত লাঠিয়াল বাহিনীকে খবর দেয়। আলী হোসেনের ছেলে পেলেরাও আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে ছুটে যায়। আর দুুপুরে দাঙ্গার ঘোষণা দিয়েই আলী হোসেন আশরাফ আলী সিকদারের অফিসে ছুটে যায়। কথা একটাই- আমার জন্য কিছু করেন। তার কথা শুনে আশরাফ আলী একচোট হেসে নেয়। তারপর গোল্ডলিফে টান দিয়ে বলে, দেখ- আমার সামনে এসে প্যান প্যান করবি না। লোকজন খবর দে। কাল সুখছড়ি কুলে সালামতের দোকানে আমি বন্দুক নিয়ে পাখি শিকারে বসবো। মুরব্বির আশ্বাস পেয়ে আলী হোসেন হাওয়ায় পা ভাসিয়ে বাড়ি ফেরে। সাইকেল নিয়ে ছোটছেলেকে পাঠিয়ে দেয় বরাতিয়া শ্বশুরবাড়িতে। বরাতিয়ার লোকজনেরও দাঙ্গা-ফ্যাসাদে নামডাক যথেষ্ট। নিজে আনুগঞ্জে দুইবোনের বাড়ি যায়। আত্মীয়-স্বজন আর ভাড়াটে দাঙ্গাবাজের মধ্যে অনেক তফাৎ। ভাড়াটেরা সুযোগে মারবে, ঝুকি নেবে না।
আলী হোসেন এমনিতেই বদরাগী। তার উপর দাঙ্গার হাতিয়ার নিয়ে ছেলেদের তোড়জোড় না দেখে তার মাথা ধরে যায়। ছেলেদের গালি দেয়- খানকির পুতেরা, জমি কি আমি কবরে নিয়ে যাব। যা বাড়ি ঘরের সব কিরিচ-গজোদা নিয়ে আয়। দেখ শান দেয়া আছে কিনা। বলতে বলতেই উঠোনের শিলপাটায় বালি দিয়ে কিরিচে টান মারে সে। চাৎ চাৎ করতে করতে তীèধার হয়ে ওঠা এক একটি কিরিচ থেকে বিদ্যুৎ ঝলসাচ্ছে। ছোট ছেলে বাড়ি ফিরেই জেটতো দাদার বাড়ি থেকে দুইটি শেল নিয়ে আসে। তার মধ্যে কৌতুহল আর জিঘাংসার মাত্রাটা একটু বেশি।
আলী হোসেন যখন কিরিচে শান দিয়ে তীè করে তোলে তখন রাতের নিস্তবদ্ধতা ভেঙে মোতাব্বিরের উঠোনে বাজার জমে ওঠেছে। হ্যাজাকের আলোয় উঠোনে জমে ওঠেছে দিনদুপুর। রান্নাঘরে চুলোর উপর পানির ডেকচিতে ফুটছে পানি। উত্তপ্ত পানির মধ্যে ছুটে বেড়াচ্ছে কয়েক মুঠো চাপাতা। কিছুক্ষন পরপর ট্রে ভর্তি করে উঠোনে চা নিয়ে যাচ্ছে বাড়ির বান্ধা কাজের ছেলেটা। প্রতিবার ট্রেতে কাপভর্তি চা আর বেলা বিস্কুট। লোকজন আরাম করে চায়ে চুবিয়ে চুবিয়ে বেলা বিস্কুট খাচ্ছে আর সিগারেট ধরাচ্ছে। কেউ কেউ মহেশখালীর পান আর টেকনাফের সুপারী দিয়ে বানিয়ে চিবুচ্ছে জবরদস্ত পানের খিলি। কেউ বিড়িতে টান মেরে প্রতিপক্ষকে হত্যা করছে নানা কথা-কৌশলে। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দাঙ্গার হাতিয়ারগুলো জড়ো হতে থাকে। সাতছড়ির দাঙ্গাবাজরা নিজেরাই নিয়ে এসেছে সাত আটি বাইদ্যা গাছের গাছের লাঠি। আগাগোড়া একই সমান। যেমন শক্ত তেমন কাজের। এক ঘা’র বেশী দুই ঘা খাওয়ার মত লোক কমই আছে।
সারারাত থেকে থেকে চলছে চা-পান পর্ব। চলছে রান্নার আয়োজন। গরু জবাই করে দাঙ্গাবাজদের জন্য খাবারের আয়োজন করেছে মোতাব্বির। সকালে ঝাল ঝোলে মাখা গরুর গোস্ত দিয়ে গরমভাত খেয়ে নেমে পড়বে গাজীর বিলের দাঙ্গায়।
এক ফাঁকে মোতাব্বির ছুটে যায় নবীর চৌধুরীর বাড়িতে। পীড়াপিড়ি করে খাস কামরা থেকে বের করে আনে চৌধুরীকে। এক নিঃশ্বাসে দাঙ্গার প্রস্তুতির কথা শোনায়।
মোতাব্বিরের কথা শুনে নবির উদ্দিন মুচকি হাসে। স্ত্রীকে ডেকে গুলির হদিস চায়। কিরে মন্টুর মা, গুলি-টুলি আছে?
পান চিবুতে চিবুতে মন্টুর মা জবাব দেয়- আছে দশ রাউণ্ড।
নবীর চৌধুরী জানে, দাঙ্গায় সরাসরি গুলি চালানোর খুব বেশী দরকার নেই। চরম মুহুর্তে কয়েকটি ফাঁকা ফায়ারই যথেষ্ট।
তবু অনুসারীকে আশ্বস্ত করে বলে, তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে কাল দুনিয়া উল্টে যাবে। আরে মোতা, চৌধুরী বাড়ির কথা ছাড়া ডলুকুলে একটি পাখিও এ ডাল থেকে ও ডালে উড়ে না। যা তুই লোক যোগাড় কর। আমার বন্দুক তোর জন্য কথা বলবে কাল।


ছ.
সকাল থেকেই দক্ষিণপাড়া আর দিয়াপাড়ায় সাজসাজ রব। সাতছড়ি থেকে মোতাব্বিরের পক্ষে এসেছে সত্তর জনের লাঠিয়াল বাহিনী। যদিও সবাই লাঠি মারবে না। কেউ কেউ উদ্ধারও করবে। সবাই মোতাব্বিরের শ্বশুর বাড়ির লোক। লাঠিয়াল হিসেবে সাতছড়ির লোকজনের ব্যাপক নামডাক। খ্যাতি আর কুখ্যাতি সমানে সমান।
আলী হোসেন আপনজনদের মধ্যে শুধু একজনকেই কাছে পায়নি। এমন এক ঘোরতর বিপদের মুহুর্তের তার সৎভাই ইউসুফ সরে পড়েছে গোপনে। যদিও সে আগেই শুনেছে ইউসুফ এসবে নেই। পিতা তাকে অতিরিক্ত সোয়া কানি জমি দান করে দিয়ে গেছে। এমন কি আলী হোসেন জানতে পেরেছে, ইউসুফ গোপনে মোতাব্বিরের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে।
গাজিরবিলে দাঙ্গা দেখতে আশপাশের পাড়া থেকে উৎসুক লোকজন নিরাপদে চারপাশে ভীড় করে সকাল থেকেই। তাদের মধ্যে নানা গুঞ্জন। তারাও পক্ষে-বিপক্ষে বিভক্ত। মকরিয়া পাড়ার রহিমমুন্সীকে গঁ মেরে হেটে নাজিরবিলের দিকে যেতে যেতে তার পাড়াতো ভাতিজা আবদুস শুক্কুর ডাক দেয়- কাকু কই যাও?
কিছু জানস না?
গাজিরবিলে যাচ্ছেন বুঝি?
হ দেখি গিয়ে কারা জিতে।
এবার শুক্কুর খোচা মারে- কি লাঠি মারবেন নাকি, কতটাকা দিয়েছে?
ধুৎ, সবকিছুতে ইয়ার্কি করবি না। হন হন করে হেটে যেতে যেতে মুন্সী জবাব দেয়।
ততক্ষনে দাঙ্গা দেখতে হাজি বাড়ির পুকুর পাড়ে যেন কৌতুহলী মানুষের মেলা বসেছে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মানুষ পুকুর পাড়ে দাড়িয়ে দাঙ্গার মজা লুটছে। হঠাৎ করে এক নজর দেখলে মনে হবে সেখানে কোন মজমা বসেছে। হতে পারে কোন ফেরিঅলার মেলে বসেছে তার সওদা।
পশ্চিমপাড়ার ফারুক মাতবর পাড়ার ইদ্রিস দর্জির উঠোনে গিয়ে বসে। হাতল ভাঙা ক’টি চেয়ার আর মোড়া নিয়ে উঠোনে বসেছে বাড়ির লোকজন। সেখানে বসেই পরিস্কার দেখা যায় নাজির বিল। ফারুক মাতবরকে দেখে দর্জির বড় ভাই একটি চেয়ার এগিয়ে দেয়। বসেন- মাতবর সাব। ফারুক বসতে বসতে মোতাব্বিরের চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করে। সরাসরি তার সঙ্গে বিরোধ না হলেও মোতাব্বিরের কারণে গত ইউনিয়ন নির্বাচনে তার খুব ক্ষতি হয়েছে। মাত্র তেরো ভোটের ব্যবধানে হেরেছেন মেম্বারপদে। কিন্তু নানামুখি গ্রাম্য সামাজিক জটিলতায় সে সরাসরি বিরোধীতায় যেতে পারেনি। তাই গোপনে আলী হোসেনের পক্ষে লোক পাঠিয়েছেন বিলে।


জ.
কথা যা কাজও তাই, সম্ভবত এরই নাম জেদ। মোতাব্বিরই আগে নেমেছে জমিনে। বেলা তখন তারুন্যে উদ্ভাসিত। হঠাৎ করেই দিয়াপাড়ার মোতাব্বিরের বাড়ি থেকে বেশ কিছু লোক নেমে এলো গাজিরবিলে। হাতি বাইদ্যা গাছের লাঠি। তারা জমিতে হালটা জুড়তেই পারেনি এমন সময়ে দক্ষিন আর পশ্চিম দিক থেকে নামলো আলী হোসেনের লোকজন। সবার আগে হাতে সাড়ে তিনহাতি একটি বনেদি কিরিচ। আলী হোসেন নিজেই বহুবার গল্পচ্ছলে বলেছে- ওই কিরিচেই নাকি প্রাণ হারিয়েছেন বহু বেয়াড়া, দুঃসাহসী। সারাজীবন ব্রিটিশ সরকারের পেয়াদাগিরি করা তার দাদার প্রিয় বস্তু ছিল এটি।
জমিনে পারে রেখেই আলী হোসেন হাঁক দেয়- আয় রে কোন খানকির পুত আসবি আয়। দেখি কোন গাইয়ে চাও বিয়াইছে। সামনে আয়, আমি তার মায়ের ... দিয়ে জমিন ঢুকিয়ে দিতে চাই... ইত্যাদি, ইত্যদি। কিছুক্ষনের মধ্যেই আল্লাহ আকবর, নারায়ে তকবির, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ, খানকির পোলারে খা, ওরে বাপরে... শব্দবন্ধগুলো মিশে যায়। চাপ পড়ে একটার ভারে আরেকটা, জেগে ওঠে অন্যটাকে সরিয়ে। ভয়কে জয় করা আর হিংস্রতাকে প্রকাশ করার এসব শব্দবন্ধের কোলাজে বেজে ওঠে হৈ চৈ এর দাঙ্গা। এখানে কে হারছে আর কে জিতছে তার কোন ইয়াত্তা থাকে না।
অল্পক্ষনের মধ্যেই বেধে যায় সত্যিকারের দাঙ্গা। আলী হোসেনের চাচাতো ভাই রহমান একটি লম্বা কিরিচ নিয়ে দাঙ্গার মধ্যে ঢুকে পড়ে চিতাবাঘের ক্ষীপ্রতায়। ঘরে তার নতুন বউ। হাত থেকে মেহেদী পাতার রঙ মুছেনি। তাকে কিরিচ নিয়ে বেরুতে দেখে নতুন বউ চেতনা হারিয়ে মাটির দাওয়ায় ঢলে পড়েছে। রহমানের মা আগেই দাঙ্গার খুব কাছে শিমুল গাছের নিচে অবস্থান নিয়েছে। সাহসী এ বুড়ি আলী হোসেনের লোকজনকে সাহস যোগাচ্ছেন। রহমান বেরিয়ে যাওয়ার পর তার বেহুশ বউয়ের চেতনা ফেরাতে ছোট বোনদের অর্ন্তঝাপ শুরু হয়ে যায়। কেউ আনছে লেবু পাতা আর কেউ চোখে মুখে ছিটাচ্ছেন ঠাণ্ডা জল।
গাজীরবিলে রহমানকে নাঙ্গা কিরিচ হাতে দেখেই আলী হোসেন ফুসফুসে আরেকটু বাতাস টেনে নেয়। উজ্জ্বল রৌদ্রকরোজ্জ্বল এ দিনের দখিনা বাতাস যেন আয়ুবর্ধক। দুঃসাহসী ও চতুর রহমান সুযোগ মত পেলেই কয়েকটা ফেলে দেবে। অতীতে সে তার বীরত্ব ও বুদ্ধিমত্তার প্রমান রেখেছে। তবে রহমান এবার নতুন কৌশল নিয়েছে। আগে বাগে নয়, দাঙ্গা চলাকালে ঠাণ্ডা মাথায় ভেতরে ঢুকে পড়েছে। আগেই কৌশল ঠিক করে রেখেছে। দক্ষিণ দিকে ডলুর পাড় ধরে দাঙ্গায় ঢুকে উত্তর দিকে সুখছড়ি খালের মুখেই বেরিয়ে যেতে হবে। সুখছড়ি খালটা পেরুতে পারলেই মুশকিল আসান। তড়িৎ আক্রমনে কয়েকটি লুটিয়ে দেয়াই তার লক্ষ্য এবং সে তাই করে। তখন লাঠিতে লাঠিতে আঘাতের ফলে এক রণমোহনী সুর উঠেছে চারদিকে। দুইপক্ষের কয়েকজন আহত দাঙ্গাবাজ জমিনে পড়ে কাতরাচ্ছে। কারও মাথা ফেটেছে, কারও হাত ভেঙেছে, কারও গায়ে লেগেছে কিরিচের কোপ।
রহমান হঠাৎ দক্ষিণ দিক দিয়ে কালবোশেখীর মত দাঙ্গার ভেতরে ঢুকে। তথন লাঠি উচিয়ে পূর্বদিক থেকে এলো সাতছড়ির ধইল্লা নাজু। মাথা ঝুকে লাঠির আঘাতটি এড়িয়ে সোজা একটি পোচ মারে তার বাহুতে। রোদের আলোয় ঝলসে ওঠে রক্তধারা। মুহুর্তের মধ্যেই তার হাত থেকে লাঠি পড়ে গেলো। ততক্ষণে পিঠে আরেক কোপ। দ্বিতীয় কোপটি দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই স্থান পরিবর্তন করে ফেললো সে। তারপর দেখলো আলী হোসেনের মেঝো ছেলেকে লাঠির আঘাতে ফেলে দিয়েছে মোতাব্বিরের চাচাতো ভাই রশিদ মাঝি। বনমোরগের মত একটি লাফ দিয়ে তার পিঠে পোচ মারলো রহমান। কিছু বুঝে ওঠার আগেই লুটিয়ে পড়লো সে। ততক্ষণে রহমানের পিঠের উপর আস্ত তিনমনের আঘাত নেমে এলো। মুহুর্তেই ঝাপসা হয়ে এলো তার দুচোখ। যেন বোশেখের মেঘ হঠাৎ ঢেকে দিয়েছে উজ্জ্বল আকাশ। কিরিচটা হাত থেকে প্রায় পড়েই যাচ্ছিল। কিন্তু সে মুঠো করে ধরলো কিরিচের বাট। সে ভাল করেই জানে একবার ভুপাতিত হলেই জান চলে যেতে পারে। হিংস্র দাঙ্গাবাজরা তার কিরিচ দিয়েই তাকে জবাই করে দিতে পারে। দাঙ্গায় এ রকম অহরহই ঘটে। ফলে পরের আঘাতটি নেমে আসার আগেই অল্প ঘুরে কিরিচের ডগাটি এগিয়ে দিলো সে। ততক্ষণে পরের আঘাতের জন্য তার পেছন দিকে আরো কাছাকাছি চলে আসা ভাড়াটে লাঠিয়াল বদিউল আলমের পেটের মধ্যে গেঁথে গেল কিরিচটা। মনে হচ্ছে, তার ভুড়িটা এুনী বেরিয়ে যাবে। আর কোন কিছু চিন্তা না করেই রহমান কিরিচটা টান দিয়ে ছুটলো সুখছড়ির দিকে। শুধু কানে এলো বদিউল আলমের আর্তনাদ- ও মাগো। কান্ত চড়–ই পাখির মত সে ডাক রহমত ছাড়া আর কারো কানে পৌছালো কিনা বুঝা গেল না।
কপাল ফেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে। ক্ষীণ একটি রক্তধারা কপোল চুইয়ে আলী হোসেনের মুখে এসে ঢুকেছে। গরম এবং লোনা। তীব্র যন্ত্রনায় তার মাথা ঘুরছে, দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে। দক্ষিণ পাড়ার আবুল হাসানকে তার দিকে দৌড়ে আসতে দেখার ভেতর দিয়েই আলী হোসেনের চেতনা লুপ্ত হল। লাঠির আঘাতে জমিনে পড়ে যাওয়ার পর মোতাব্বিরের চাচাতো ভাই কলিমউদ্দিন তার বুকের উপর চড়ে বসে। হাতে তার ধারালো কিরিচ। আলী হোসেন বুঝতে পারে তার সময় শেষ। তাই কলেমা পড়তে পড়তে শেষ চেষ্টা হিসেবে একঝটকায় চিৎ থেকে উবুড় হয়ে যায়। আর কলিমউদ্দিন গলায় চালাতে গিয়ে ঘাড়ে আর পিঠে কয়েকটি পোচ দিলো। এরই মধ্যে সুখছড়ি কুল থেকে পরপর দুইরাউণ্ড গুলির শব্দ হল। মুহুর্তেই স্থির হয়ে গেল সবকিছু। যেন পুরো দাঙ্গাটিই একটি স্থিরচিত্র। পরমুহুর্তে মকরিয়া পাড়া থেকে তিন রাউণ্ড। মানে দুইপক্ষের মদদদাতারাই জানিয়ে দিল পরিস্থিতি গুরুতর। দুনো তরফে গুলির শব্দে দাঙ্গাবাজরা রণে ভঙ্গ দিয়ে যে যেদিকে পারে ছুটে পালালো।
আলী হোসেনের মেঝ ছেলের নুর হোসেনের অবস্থা আশংকাজনক। কিরিচের কোপে তার বামহাতের তিনটি আঙুল বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। লাঠির আঘাতে ফেটে হা হয়ে আছে মাথার সামনের দিক। বাঁকা টেটা পেটের নাড়িভূড়ি সব বের করে ফেলেছে। দাঙ্গার এক পর্যায়ে একা পেয়ে তাকে প্রথমেই কোপটি মারে সাতছড়ির গফুর। বা হাত দিয়ে ঠেকাতে গিয়ে বিচ্ছিন্ন হয়েছে আঙুলগুলো। কে একজন মাথায় লাঠির আঘাত করেছে। ঘুরে মাটিতে পড়ে যেতে যেতে সে শুনতে পেলো গুলির শব্দ আর ততক্ষনে মোতাব্বিরের বড় শালা তার পেঠের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে টেটা।
মাত্র কয়েক মুহুর্তের ব্যবধান। দুইপক্ষের আহতদের আর্তচিৎকারে তখন মুখরিত হয়ে ওঠলো গাজিরবিল। দুইপক্ষের মেয়েরা আহত স্বজনদের উদ্ধারে নেমে এসেছে বাঁধভাঙা ঢলের মতো। কারো হাতে পানির জগ, কেউ বা পরণের শাড়ি ছিড়ে বাঁধছে আহতের ব্যাণ্ডেজ। তখন আহত লোকজনের মুখে দোয়া-কালাম, গালাগালি, বেদনার্ত চিলচিৎকার। জোরে জোরে কলেমা আর দোয়া পড়ার শব্দ, মাগো-বাবাগো, আমাকে বাঁচাও, পানি-পানি, মরে গেলাম রে ... শব্দের অদ্ভুত এক মিথস্ক্রিয়ার সৃষ্টি হলো গাজীরবিলে।

Friday, January 6, 2012

তিনি (কবিতা)

তিনি
কাফি কামাল

তিনি বলে চলছেন দ্রুত এবং অশ্রাব্য
বোশেখের হাওয়ার মতো পাক খেয়ে
লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে
ছড়িয়ে পড়ছেন দিগ্বিদিক।

হাওয়ার সূত্র ধরে
তার সুক্ষ্ম-তীব্র বিষ্ময়গুলো
বিস্ফোরিত শিমুলের মতো ডালে-পত্রে
জমে উড়ছে প্রশ্নময়।

ধারালো শব্দে বোনা নিখুঁত বাক্যাবলী
সুনিপুন উচ্চারণে
ছাড়িয়ে যাচ্ছেন তিনি
যাবতীয় উচু উচু বাঁধার পাহাড়।