ভাষাতাত্ত্বিক স্বাতন্ত্রে চট্টগ্রামী
কাফি কামাল
ভাষা মানুষের গাত্রবর্ণের মতো। ভেতরে ভাবপ্রকাশের একই রঙের রক্তধারা বইছে,
বাইরে বহুরঙের গাত্রবর্ণ হয়ে ফুটছে ভাষা। গাত্রবর্ণ যেমন সাদা, কালো,
বাদামী, মিশ্র তেমন ভাষাও শব্দ-বর্ণে-উচ্চারণে স্বতন্ত্র। কিন্তু উদ্দেশ্য
তো একটাই, ভাবপ্রকাশ। পৃথিবীতে হাজার হাজার ভাষার অস্তিত্ব বিদ্যমান।
সৃষ্টির প্রথম পর্যায় থেকে মানুষের সংখ্যাবৃদ্ধি ও চারদিকে ছড়িয়ে পড়ার
মাধ্যমে এসব ভাষার সৃষ্টি। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে পৃথিবী এখন ছোট
হয়ে আসছে। এতে একদিকে মৃত্যু হচ্ছে একের পর এক ভাষার। অন্যদিকে মাত্র
কয়েকটি ভাষাই প্রসার পাচ্ছে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ
দেশের ভাষাই প্রচার-প্রসারে পাচ্ছে অগ্রাধিকার। যেমন: ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ,
স্পেনিশ, জাপানী, আরবি... ইত্যাদি। উল্টোভাবে বললে, দরিদ্র দেশগুলোর ভাষা
অব্যাহতভাবে সংকুচিত হয়ে আসছে। সে সব দেশের মানুষ অর্থনৈতিক উন্নতির
লক্ষ্যে আয়ত্ব করছে উন্নত দেশের ভাষা, ভুলে যাচ্ছে মাতৃভাষা। বাংলাদেশের
নতুন প্রজন্মের মুখের ভাষা এ যুক্তিকে গ্রহণযোগ্য করে তোলে। আবার
রাষ্ট্রক্ষমতার নিয়ন্ত্রণের কারণে অনেকভাষা সংকুচিত ও মৃত্যুমুখে পতিত হয়।
চট্টগ্রামী তেমন একটি ভাষা। রাষ্ট্রভাষা বাংলার প্রভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা
বৃহত্তর চট্টগ্রামের ভাষাকে কোণঠাসা করে ফেলেছে। যেখানে মাত্র কয়েক হাজার
লোকের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষাকে পূর্ণাঙ্গ রূপ সেখানে প্রায় কোটি লোকের
মুখের ভাষা রক্ষার কোন উদ্যোগ নেই রাষ্ট্রের। উদ্যোগ তো দূরের কথা নূন্যতম
শ্রদ্ধাবোধ, ভালোবাসাও নেই। নানামুখী প্রতিবন্ধকতার দেয়াল বন্দি হয়েও আপন
স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের কারণে টিকে আছে চট্টগ্রামী। কিন্তু সম্ভাবনাময় এ
ভাষাটির আয়ু কতদিন তা এখন প্রশ্নবোধক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চট্টগ্রামী ভাষাকে স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে স্বীকার করতে বড় দ্বিধা বাংলাভাষী
পণ্ডিতদের। বাংলাভাষাভাষীরা তো বটেই। কিন্তু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য তো
স্বীকৃতির ধার ধারে না। আপন বৈশিষ্ট্যই তাকে স্বতন্ত্র করেছে, টিকেয়ে
রেখেছে। বাংলা ভাষায় নেই বা বিরল এমন বহুবৈশিষ্ট্যর অধিকারী চট্টগ্রামী।
বাংলাভাষায় বিরল কিন্তু চট্টগ্রামীতে গুরুত্বপূর্ণ এমন বৈশিষ্ট্যগুলোর
মধ্যে রয়েছে- উচ্চারণ বৈচিত্র্য, শব্দার্থ বৈচিত্র্য, শব্দায়ব সংক্ষেপ
পদ্ধতি ও শব্দ যোজন রীতি।
ক. উচ্চারণ বৈচিত্র্য: চট্টগ্রামীর উচ্চারণ বৈশিষ্ট্য স্বল্পপরিসরে আলোচনা
অসম্ভব। সপ্তমি বিভক্তিযুক্ত ও অসমাপিকা ক্রিয়ার ‘এ-কার’ লোপ পেয়ে শেষের
বর্ণটি হসন্তযুক্ত হয়ে যায়। সপ্তমি বিভক্তিযুক্ত ও অসমাপিকা ক্রিয়ার
‘এ-কার’ লোপ পেয়ে শেষের বর্ণটি হসন্তযুক্ত হয়ে যায়। উদাহরণ-
বাড়িতে>বাড়িৎ, ঘরেতে> ঘরৎ, নদীতে>নদীৎ। শব্দের শুরুতে ক, শ, ষ, স,
থাকলে অনেক সময় ‘হ/অ/ফ’ বর্ণে রূপান্তরিত হয়। যেমনÑ কাকু>হাক্কু/আক্কু,
কাজ>হাজ, কাগজ>হাগজ/হঅজ, শালী>হালি/আলি, শ্বশুর>হউর/অউর,
ষাট>হাইট/আইট, শাক>হাগ/আক, সকল>হক্কল/অক্কর, সুতা>ফুতা...
ইতাদি। একই শব্দ উচ্চারণের দীর্ঘ-হ্রস্বের কারণে অর্থ পাল্টে যায়। আনুনাসিক
ব্যঞ্জনাও এ ভাষার একটা নিয়মিত ফলশ্রুতি। ‘মামু’ শব্দের সবগুলি স্বর আবার
কেব ‘ম’ এই ডাকে এসে দাঁড়ায়, তখন বেকল তাতে আশ্চর্যই হতে হয়। চট্টগ্রামী ও
চাকমা ভাষায় আন্তঃস্বরীয় অঘোষ ধ্বনি লুপ্ত হয়। চাকমা ভাষাকে স্বতন্ত্র
স্বীকৃতি দিলেও চট্টগ্রামীর ব্যাপারে রয়েছে ভাষাবিদদের দ্বিধা।
খ. শব্দার্থ বৈচিত্র্য: বাংলা মান ভাষায় ব্যবহৃত একই শব্দ অনেক সময়
চট্টগ্রামীতে এসে ভিন্ন অর্থ তৈরি করে। কোন বিশিষ্ট দীর্ঘভাবকে সুন্দরভাবে
এক বা অল্পকথায় প্রকাশ করার বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে চট্টগ্রামীর। চট্টগ্রামীর
শব্দার্থ বৈচিত্র্যের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে- প্রতিশব্দের আধিক্য।
যেমন- ব্যথা= বিষ, চিচ্চিয়ানী, ধরপরানী, ইরইরানী ইত্যাদি। এখানে বাংলা
ভাষায় জ্বর, কেটে যাওয়া, আঘাত পাওয়া সব ধরনের বেদনাদায়ক অনুভূতিকে ব্যথা
একটি শব্দ দিয়ে প্রকাশ করতে হয়। কিন্তু চট্টগ্রামীতে কেটে যাওয়া, কাটা
ফুটা, জ্বর, আঘাতসহ নানা বেদনাদায়ক অনুভূতি প্রকাশের জন্য একাধিক প্রতিশব্দ
রয়েছে। শব্দার্থ বৈচিত্রের দিক থেকে বিচার করলে দেখা যাবে চট্টগ্রামী
ভাষা ‘মান বাংলা ভাষা’ থেকে অনেক জায়গায় বেশ স্বতন্ত্র। এ স্বাতন্ত্র্যটুকু
দু’ভাগে ভাগ করা যায়। (১) বাংলা মান ভাষায় ব্যবহৃত একই শব্দ চট্টগ্রামীতে
এসে ভিন্ন অর্থ পায়। অবশ্য মান ভাষার শব্দ উপভাষায় গিয়ে অর্থ পরিবর্তনের
বৈশিষ্ট্য পৃথিবীর প্রায় সব জীবন্ত ভাষায় পরিলক্ষিত হয়। উদারণ হিসাবে আমরা
কয়েকটা শব্দের কথা চিন্তা করতে পারি। যেমন- ‘আঁতুর’ বাংলা মান এবং চলিত
ভাষায় ‘আঁতুর’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘সূতিকাগৃহ’। কিন্তু চট্টগ্রামীতে এর অর্থ
পরিবর্তিত হয়ে অর্থ পেয়েছে ‘খোঁড়া’। একইভাবে ‘আধার’ মানে হচ্ছে ‘স্থান,
পাত্র’। কিন্তু চট্টগ্রামীতে ‘আধার’ এর অর্থ হয়ে গেছে ‘মাছের খাদ্য’। তবে
চন্দ্রবিন্দুর ব্যবহারের ফলে আঁধার অর্থ পেয়েছে অন্ধকার। মান বাংলায় ‘ফুট’
অর্থ ’১২ ইঞ্চি পরিমিত পরিমাপ’। চট্টগ্রামীতে ‘ফুট’ শব্দের অর্থ হয়ে গেছে
‘কাদা’। বিষয়টি বাংলার ক্ষেত্রেও মাঝে মধ্যে প্রযোজ্য। হিন্দী ‘বাল’ যেখানে
চুলের অর্থ প্রকাশ করে সেখানে বাংলায় অর্থ দাঁড়ায় গুপ্তকেশ। হিন্দী এ
শব্দটি বাংলার মতো একই অর্থ প্রকাশ করে চট্টগ্রামীতেও।
প্রতিটি ভাষায় অন্য ভাষার বহু শব্দ নিজের অবস্থান করে নেয়। কখনও
অনুপ্রবেশের মাধ্যমে, কখনও নিমন্ত্রিত হয়ে। চট্টগ্রামী ভাষাও ব্যতিক্রম নয়।
এ ভাষায় নিজের অবস্থান পোক্ত করেছে আরবী, ফার্সি, উর্দু, হিন্দী, বাংলাসহ
বহু ভাষার শব্দ। আলোচ্য বিষয় যেহেতু বাংলা থেকে চট্টগ্রামীর স্বতন্ত্র
নির্ধারণ সেহেতু অন্যভাষার শব্দ গ্রহনে বাংলা এবং চট্টগ্রামের কিছু
স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করছি। বাংলা যেখানে ভিন ভাষার বিকৃত রূপটি
গ্রহণ করেছে সেখানে চট্টগ্রামী নিয়েছে হুবহু বা সামান্য বিকৃতটি। হিন্দী
থেকেÑ চনা>ছোলা>চনাবুট>, বহিন>বোন>বইন,
টাংগ>ঠ্যাং>ঠেং... ইত্যাদি। আবার বাংলা যেখানে মূলটি নিয়েছে সেখানে
চট্টগ্রামী নিয়েছে বিকৃতটি। যেমন: ফারসী থেকেÑ য়খনী>আখনি>আন্নি,
আওয়াজ>আওয়াজ>আবাজ, আরযু>আরজু>আজ্জু, যারযার>জরজর>যজ্জরাই
(বিগলিত ধারায়), নাখানদাহ>নাখান্দা>নান্দা; আরবী থেকেÑ
অক্বীক>আকিকা>আকিয়া, অক্কদ>আকদ>আক্ত, ছল্য); হিন্দী থেকেÑ
হিন্দী থেকেÑ চরখা>চরকা>চরহা, চিটঠী>চিঠি>চিড়ি,
ঠমক>ঠমক>ঠঅক, পরত>পরত>পরল... ইত্যাদি। আবার বাংলা যেখানে কোন
শব্দ নিয়ে বর্জন করেছে বা নেয়নি তেমন বহু শব্দ হুবহু বা সামাস্য বিকৃত
অবস্থায় আত্মস্থ করেছে চট্টগ্রামী। যেমন: হিন্দী থেকেÑ খাটা>খাট্টা
(টক), দুলা>দুলা (বর), রুই>রুই (তুলা), কেয়াড়>কেবার (দরজা),
ক্যা>কেয়া (কেন), গেঁহু>গেউ>(গম), গঁওয়ার>গোয়ার (একগুয়ে),
ঘীরনা>ঘিরা (বেড়া), চরখা>চরহা, চান্দি>চান্দি (রূপা),
চন্দওয়া>চাদোয়া (শামিয়ানা), চনা>চনাবুট (ছোলা), চারা>চারা (মাছের
খাবার), চিটঠী>চিড়ি, ছিলকা>ছিলকা (গাছের ছাল), জও>জও (যব),
জোলাহ>জোলা (তাঁতী), বহিন>বইন (বোন), টট্টি>টাট্টি, টাংগ>ঠেং,
টোকরি>টুরি, টোনা>টোনা, টোপী>টুপি, ঠমক>ঠঅক, ডর>ডর,
তরকারী>তরহারী, তানজাম>থানজাম (পাল্কি), থোড়া>থোরা,
দঙ্গা>দাঙ্গা, দাদা>দাদা, দেরি>দেরি (বিলম্ব), দোনো>দোনো
(উভয়ই), দহাই>দোয়াই (শপথ), নয়া>নোয়া (নতুন), পরত>পরল (ভাজ),
পাতা>পাত্তা; আরবী থেকেÑ আক্কল>আক্কল (আক্কেল); ফারসী থেকেÑ
আসূদহ>আছুদা, অয়ব>আয়েব, য়গানহ>এগানা, কুব্>কুব, গিরহ>গিরা,
র্প> পরই>পাখা; তুর্কি- আপা>আপা, চিলমচি>চিলমচি,
বহাদুর>বহাদুর, বুলাক>বুলাক>নোলক... ইত্যাদি। আবার কোন কোন শব্দের
মূল অর্থটাই পাল্টে গেছে চট্টগ্রামীতে। যেমন: হিন্দী চুতিয়া শব্দের অর্থ
মুর্খ কিন্তু চট্টগ্রামীতে চুতিয়া শব্দের অর্থ খারাপ লোক; হিন্দী ঠেস
শব্দের অর্থ হেলান দেয়া কিন্তু চট্টগ্রামী মূল অর্থ যেমন নিয়েছে তেমনি নতুন
অর্থ করেছে তাচ্ছিল্য করা; হিন্দী ঢীলা’র অর্থ শিথিল কিন্তু চট্টগ্রামীতে
যার মাথা ঠিকমতো কাজ করে না, হিন্দী ধোলাই শব্দের মূল অর্থ কাপড় ধোয়াই
নিয়েছে চট্টগ্রামী কিন্তু বাংলা নিয়েছে মারপিট অর্থে; হিন্দী পরখ শব্দের
অর্থ পরীক্ষা কিন্তু চট্টগ্রামী নিয়েছে আলাদা অর্থে; ফারসী দরমিয়ান শব্দের
মূল অর্থ মধ্যবর্তী কিন্তু চট্টগ্রামী নিয়েছে কোমরব্যাগ অর্থে, ফারসী
নাখানদাহ অর্থ অনাহুত বা অপ্রিয় কিন্তু চট্টগ্রামী নিয়েছে অযোগ্য অর্থে;
ফারসী নাদান অর্থ অবুঝ বা অজ্ঞান কিন্তু চট্টগ্রামী নিয়েছে পেটুক অর্থে;
আরবী ইন্কার অর্থ অস্বীকার কিন্তু চট্টগ্রামী নিয়েছে আচ্ছিল্য অর্থে; আরবী
খউফ অর্থ শঙ্কা বা ভীতি কিন্তু চট্টগ্রামী নিয়েছে স্বপ্ন অর্থে; বাংলা গম
অর্থ একটি খাদ্যশষ্য কিন্তু চট্টগ্রামী নিয়েছে ভাল অর্থে। এরকম আরও অনেক
শব্দ বাংলা মান চলিত ভাষা থেকে চট্টগ্রামী ভাষায় হুবহু এসে তাদের অর্থ
পরিবর্তন করে ফেলে। আবার বাংলা যেখানে ভূঁই (জমি)’র মতো আপন শব্দ তাড়িয়ে
দিয়েছে সেখানে চট্টগ্রামী তা আত্মস্থ করেছে।
(২) চট্টগ্রামীভাষার রয়েছে কোন বিশিষ্ট দীর্ঘভাবকে এক বা অল্পকথায়
সুন্দরভাবে প্রকাশ করার ক্ষমতা। বাংলায় অল্পকথায় দীর্ঘভাব প্রকাশের শক্তি
তেমনভাবে পরিলক্ষিত হয় না। চট্টগ্রামী ভাষা এ শক্তির উৎস নিয়ে ভাষাবিদদের
মধ্যে ভিন্নমত রয়েছে। আর উদাহরণ স্বরূপ কিছু শব্দ দেয়া হলো যেগুলো
অদ্ভুতভাবে সঙ্কুচিত হয়ে আশ্চর্য রূপে উদ্দিষ্টভাব প্রকাশ করে। যেমন: এই
মুহূর্তে> ইত্তার, সেই সময়ের/তখনকার> এ্যাত্তিয়ার, যন্ত্রণায় ছটফট
করা/মানসিকভাবে অস্থিরতা কাজ করা>কৈছালি (ছাই মেখে কাটাকুটির পর রুদ্ধ
ইন্দ্রিয় কই মাছ যেমন ছট ফট করে, সে সঙ্কটময় অস্থির অবস্থা)। শুধু ‘কৈ’ এবং
‘ছালি’ এ দু’টি শব্দ মিলে এ অপূর্ব ভাবব্যঞ্জক শব্দের সৃষ্টি। আবার কিছু
কিছু ক্ষেত্রে চট্টগ্রামীতে একাধিক প্রতিশব্দ আছে। যেমন- ব্যথা। বাংলাভাষী
একজন (জ্বর হলে, কাটা গেলে, ছিলে গেলে, পোড়া গেলে...) তার যন্ত্রনা বোঝাতে
আগে-পরে (তীব্র ব্যথা, অল্প ব্যথা ইত্যাদি) যুক্ত করে ‘ব্যথা’ শব্দটি
ব্যবহার করে। কিন্তু চট্টগ্রামীতে ধরপরার, ছৈটগরার, ধরহার, চিনচিনার, হোট
মারের, ইরইরার ইত্যাদি প্রতিশব্দ দিয়ে যন্ত্রনার ধরণ ও তীব্রতা বোঝাতে
পারেন। মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসী চট্টগ্রামের শ্রমিকদের চিকিৎসা নিয়ে জটিলতার
কারণে চট্টগ্রামীভাষী চিকিৎসকদের উচ্চ বেতনে মধ্যপ্রাচ্যে নেয়া শুরু হয়।
গ. শব্দায়ব সংক্ষেপ: মান ভাষার দীর্ঘ বাংলা শব্দের সংক্ষিপ্ত অবয়ব বা
শব্দায়ব সংক্ষেপ পদ্ধতি চট্টগ্রামী ভাষার আরেকটি বৈশিষ্ট্য।
চট্টগ্রামবাসীদের উচ্চারণ-ত্রস্ততার কারণে এ রকম হয়ে থাকে। এ বৈশিষ্ট্যের
পিছনে দায়ী কিছু ঐতিহাসিক কারণ। চট্টগ্রাম একটি বিখ্যাত সমুদ্রবন্দর। এ
সমুদ্রবন্দরে নাও ভিড়িয়েছে পৃথিবীর বহুপ্রান্তের নাবিক, ব্যবসায়ী,
ধর্মপ্রচারক, ভবঘুরে। তারা প্রত্যেকেই বয়ে এনেছেন নতুন শব্দ। তাদের সঙ্গে
ভাব বিনিময় করতে গিয়ে চট্টগ্রামের সমুদ্রতীরবর্তী মানুষকে কসরৎ করতে হয়েছে
ভিন্নভাষা ও শব্দ আওড়ানোর। এমনকি নিজের ভাষাটি তাদের মতো করে উচ্চারণ করে
ভাবপ্রকাশের। এছাড়া প্রাচীনকাল থেকেই চট্টগ্রাম একটি ব্যবসা-বাণিজ্য
কেন্দ্র। ব্যবসায়ীদের ধীরে সুস্থে কথা বলার মত অবসর হয় না। এ
উচ্চারণ-ত্রস্ততার কারণে অর্জিত গুনের কারণে ভাষার দীর্ঘ শব্দের সংক্ষিপ্ত
অবয়ব বা শব্দায়ব সংক্ষেপ পদ্ধতি তৈরি হয়েছে এ ভাষায়। এর কারণে দ্রুত কথা
বলার তাগিদে শব্দায়ব সংক্ষেপ হয়ে যায়। যেমন: বৃহস্পতি> বিসিৎ, হরতকি>
হট্টই, জোনাকি> জুনি, মঙ্গল>মঁল, আবদুল রহিম>আদ্দুরইম,
মামা>ম, থামো>থিঅ.. ইত্যাদি। উচ্চারনের একটি দ্রুতি বা ধীর লয়ের
কারণে পাল্টে যায় বহু শব্দের অর্থ। উদাহারণ দেয়া যায়- অ্যা, আ, অ্যা..
ইত্যাদি। আবার শব্দযোজন রীতির দিক থেকে চট্টগ্রামী বাংলার চেয়ে স্বতন্ত্র।
বাংলাদেশের অন্যান্য আঞ্চলিক বা উপভাষার মত পরম্মুখ নয়। চট্টগ্রামীতে দুই
বা একাধিক শব্দ মিলে সংক্ষিপ্ত নতুন শব্দ তৈরির গুন চট্টগ্রামীর
উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। যেমন: উন্দি- ওই খান দিয়ে, ইন্দি- এই খান দিয়ে...
ইত্যাদি। এছাড়া চট্টগ্রামী ভাষায় ঋণাত্বক পদ ক্রিয়ার আগে-পরে দুদিকেই বসে।
যেমন: যাবো না> যাইতাম ন, যামু না>ন যাইয়্যম, খাবো না>হাইতাম ন,
খামু না>ন হাইয়ুম... ইত্যাদি।
ঘ. শব্দযোজন রীতি: চট্টগ্রামী বাংলাদেশের অন্যান্য আঞ্চলিক বা উপভাষার মত
পরম্মুখ নয়। চট্টগ্রামীতে অনেক শব্দ মিলে এক শব্দ হয়ে নিজেই একটি শব্দ
সৃষ্টি ও অর্থ তৈরি করে। ..... । তাছাড়া শোষণ ক্ষমতা চট্টগ্রামীর এক বিশেষ
সম্পদ। অন্যান্য ভাষার শব্দ ও প্রয়োগকে সে নিজস্ব নিয়মে আত্মস্থ করে নিতে
পারে। এই গুণ সজীব সচল ভাষার; যেসব ভাষার এমন গুণ নেই বা ছিল না, তারা এখন
মৃত। এ শোষণ ক্ষমতার কারণে চট্টগ্রামী আত্মস্থ করে নিয়েছে- বহু পর্তুগিজ,
ইংরেজি, হিন্দী, আরকানি, সংস্কৃত, আরবী, উর্দু, ফার্সি, দ্রাবিড়ীয় পিল্লা,
গুজরাটি শব্দ। হিন্দী থেকেÑ রুই>রুই (তুলা), ক্যা>কেয়া,
গেঁহু>গেউ(গম), ঘীরনা>ঘিরা (বেড়া), চান্দি>চান্দি (রূপা),
চনা>চনাবুট (ছোলা), জও>জও (যব), জোলাহ>জোলা (তাঁতী),
টট্টি>টাট্টি, ঠেস>ঠেস, তানজাম>থানজাম (পাল্কি), দোনো>দোনো
(উভয়ই), পাতা>পাত্তা; তুর্কি থেকে- আপা>আপা, চিলমচি>চিলমচি,
বহাদুর>বহাদুর, বুলাক>বুলাক (নোলক); ফারসী থেকে- আসূদহ>আছুদা
(পরিতৃপ্ত), অয়ব>আয়েব (ত্রুটিধরা), য়গানহ>এগানা, কুব্>কুব,
গিরহ>গিরা (কাপড়ের মাপ), দরমিয়ান>দরমিয়ান
(মধ্যবর্তী/কোমরব্যাগÑঅর্থপাল্টে), নাদান (অবুঝ,অজ্ঞান/পেটুক-
অর্থপাল্টেছে), র্প> ফইর (পাখা); আরবী থেকে- ইন্কার>ইংকার
(অস্বীকার/আচ্ছিল্য), য়াদ>ইয়াদ, ইরাদহ>এরাদা, ইলাজ>এলাজ,
ক্ববালহ>কবলা, গুরবা>গরবা, ফুলানো>ফলানা, ফারগ>ফারক,
বয়জা>বজা, তযীম>তাযিম>সমাদর, তুফান>তুয়ান; ক্ষেমারজাত শব্দ- গম
(ভালো), লাঙ (ভাতার); বার্মিজ থেকেÑ লঙ্গি (অর্থসহ মূল উচ্চারণ), থাই
(অর্থসহ মূল উচ্চারণ)... ইত্যাদি।
আইরিশ ইংরেজি ও মূল দ্বীপের ইংরেজিতে খানিকটা ব্যকরনী ভেদও দু®প্রাপ্য নয়,
তেমনি বাংলা উপভাষাতেও চট্টগ্রামী বাংলায় বাক্যগঠন রীতি অপর প্রান্তীয় ভাষা
রংপুরী বাক্যগঠন রীতির সাথে মিললেও (আঁই ন যাই/না জাঁও মুই ইত্যাদি) এই
পদক্রম রীতির ঐতিহাসিক সংরক্ষণ অন্য কোনও উপভাষায় দুর্লভ। অধ্যাপক ড.
মনিরুজ্জামান তার ‘উপভাষা চর্চার ভূমিকা’ গ্রন্থে বলেন, ‘চট্টগ্রামীর
অক্ষর-ঝোঁক, হ-উহ্যতা এবং আন্তঃস্বরীয় ব্যঞ্জন ধ্বনির লোপ বা দ্বিত্বতা ও
তৎসহ শব্দগঠনে সংকোচন সংক্ষেপন প্রবণতাই বাংলাদেশের অপরাপর উপভাষা থেকে একে
পৃথক করেছে। ... চট্টগ্রামীকে পৃথক উপশ্রেণীভুক্ত করার যুক্তি এই উপভাষার
মধ্যেই নিহিত: ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যে পূর্ববঙ্গীয় উপভাষা থেকে তার
পার্থক্যটি স্পষ্ট। যথা, স্পর্শ ক, প এর উষ্মী এবং ঘোষী রূপ, আন্তঃস্বরীয়
ব্যঞ্জন লোপ, আন্তঃস্বরীয় নাসিক্যব্যঞ্জন লোপে পূর্বস্বরের সানুনাসিকতালাভ,
শব্দের মাত্রা বা অক্ষরভাগের সংকোচন, ক্রিয়ার পূর্বে নিষেধাত্মক অব্যয়
যোগ, এবং প্রাচীন (ধৎপযধরপ) কিছু শব্দ (ও শব্দরূপের) সংরক্ষন বা ব্যবহার
প্রবণতাÑ প্রভৃতি এ ভাষাকে বিশিষ্ট করেছে। যাইহোক, পূর্ববঙ্গীয় উপভাষার
সাথে এর মিলও আছে বহু ক্ষেত্রে, তন্মধ্যে অপি’র ব্যবহার প্রধান।’ ড.
মনিরুজ্জামান তার উপভাষা চর্চার ভূমিকা গ্রন্থে লিখেছেন- ‘বাংলা ভাষার
উপভাষাগুলির মধ্যে সিলেট, নোয়াখালী ও চাঁটগার উপভাষা কিছু স্বাতন্ত্রের
অধিকারী। সিলেটি ভাষা ‘টানের’ দিক থেকে, নোয়াখালি দ্রুততার দিক থেকে ও
চট্টগ্রামের ভাষা স্বরধ্বনি বহুলতা ও শব্দ সংকোচন বা সংক্ষেপিকণের দিক থেকে
আবার ভিন্ন। ... অনুমান করা যায় যে, সিলেট ও নোয়াখালি ভাষা অপেক্ষা
চট্টগ্রামের ভাষায় সংঘাত এসেছে প্রচুর। সংঘাত বলতে আমরা একটি নদী-বন্দর
কেন্দ্রে ও তার পশ্চাৎ ভূমিতে ভাষা-সংযোগ (খধহমঁধমব পড়হঃধপঃ) ঘটিত পরিবর্তন
ও ঋণায়ন তথা (অংংরসরষধঃরড়হ, ফরংংরসরষধঃরড়হ, পড়হঃধসরহধঃরড়হ) ও ধ্বনি-অভিঘাত
প্রাপ্তির অন্যান্য কারণও ঘটনাকেও বুঝবো। ধ্বনি-উচ্চারণগত প্রক্রিয়ায় বাধা
না দিয়ে ধ্বনিগঠনে একটা ‘বিলোপ-পন্থা’ও সম্ভবত একটা (নু-ঢ়ৎড়ফঁপঃ) হিসাবে
এখান থেকেই জন্ম লাভ করে থাকবে। তাই এ ভাষায় (ঊঁঢ়যড়হরপ পড়সনরহধঃরড়হ,
উড়ঁনষরহম ংড়ঁহফ ওহঃৎঁংরাব ংড়ঁহফ) (প্রবেশি দ্রুতধ্বনি) বড় মোহকারী।
Ñএ্যাত্তর (এতই), কঁত্যে (কখন), কডেত্তন (কোথা থেকে), কইন্য পার (কইতে পার
না), কিয়েল্যাই (কিসের লাগিয়া), শতান শতীন্যা (শয়তান বা শয়তানী) প্রভৃতি
উদাহরণ আনা যেতে পারে। স্থানের নামে, সময়ের উল্লেখে, প্রিয়বস্তুর নির্দেশে
এমনকি রেগে গেলে সাধারণ কথাতেও এই ‘বিলোপ-পন্থা’ দ্রুত কাজ করে। ফলে
বাগধারায় ‘ধ্বনি’ বিচিত্র রূপে ক্রিয়া করে কিন্তু শেষ ‘ধ্বনিগুন’ ক্রমে
ভাবানুসঙ্গতায় নির্দিষ্ট হয়ে যায়। বিশেষ শব্দের ধ্বনি বিশেষ ধ্বনিগুনের
অধিকারী- সিলেটির মত যে কোন বাক্যের প্রথম ও শেষ শব্দের টান রাখার নিয়ম
এখানে অচল, কিংবা নোয়াখালির মত কতকগুলি অব্যয় ধ্বনি সংযোগও এখানে বৃথা।
কৃতঋণ শব্দের মত কিছু প্রাচীন শব্দ (এমনকি পোশাকী শব্দ) এ ভাষায় বহুল
ব্যবহৃত, কিন্তু বাগধারার বিপুল স্রোতে তার স্থান এ ভাষার খেয়াল মত হয়ে
থাকে। বহু সংস্কৃত ও হিন্দী শব্দ এ ভাষা ঘোট পাকিয়ে ও নানা ছদ্মরূপে এ
ভাষায় অবস্থান করছে। অথচ অন্যান্য উপভাষায় মূল শব্দের আদি উচ্চারণ ঠিক
থাকে, পরবর্তী উচ্চারণেই শুধু বিকৃতি ঘটে থাকে। চট্টগ্রামের ভাষা সম্ভবত এই
কারণেই রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। বাইরে থেকে কোন বাঙালীর
পক্ষেই এই ভাষা বোঝা বা আয়ত্ত করা খুব সহজ নয়। প্রফেসর ড. মনিরুজ্জামান
লিখেছেনÑ ‘আঞ্চলিক ভাষারই যদি লেখ্যরূপ গড়ে ওঠে (যেমন জাপান) তবে তার
সমৃদ্ধি সকলকে ছাপিয়ে যায়। চট্টগ্রামের ভাষা সবাইকে ছাপিয়ে উঠতে পারে নি,
তবে স্বতন্ত্র হতে পেরেছে। ধ্বনি উচ্চারণের নিয়ম, শব্দসৃষ্টি ও কৃতঋণ
শব্দের ব্যবহার এবং বাক্য গঠনের বিভিন্ন পর্যায়ে এদের অনুসরন সাধারণ
বাঙালির পক্ষে আজ দুঃসাধ্য। কিছু উদাহারণ সংযোগে এই উপযোগীতার কথা উল্লেখ
করা যাক। ইংরেজিতে এর চাটগোঁয়ে- ‘আঁই ন যাই’। রূপতত্ত্বের দিক থেকে
বাক্যগঠনের এই ভঙ্গিটি তাৎপর্যপূর্ণ। প্রদেশের উপভাষায় ‘আমি’ বড় জোর
‘আমি-এ’ অর্থাৎ অন্তঃস্বরের ভঙ্গি একটা থাকে, আবার থাকেও না। (উল্লেখ্য,
ঐতিহাসিক শব্দটি বহুবচন এবং মহাপ্রাণান্তিক ছিল।)’
চট্টগ্রামীকে সবাই বাংলার উপভাষা বা আঞ্চলিকভাষা বলে চালিয়ে দেন। হিন্দী
এবং উর্দুর মধ্যেও এক সময় এমন যুদ্ধ ছিল। বাংলা ভাষায় আরবী ফারসী তুর্কী
হিন্দী উর্দু শব্দের অভিধান-এর ভূমিকায় সম্পাদক কাজী রফিকুল হক লিখেছেনÑ
আঠারো শতকে উর্দু গদ্য ‘হিন্দী’ নামে এবং উর্দু কবিতা ‘রিখ্তা’ নামে পরিচিত
ছিল। হিন্দী ও উর্দুুর মধ্যে রেষারেষি ছিল উনিশ শতকের শেষার্ধ পর্যন্ত।
এখন এখন দুইটি ভাষায় পরস্পরকে স্বতন্ত্র বলে স্বীকার করে নিয়েছে। একথাও
সত্য যে, চট্টগ্রামের ভাষা মূল ভাষা থেকে বিচ্ছিন্ন হবার সুবিধা পেয়েছে ঢের
অথচ আপন নিয়মকে প্রকাশ করতে গিয়ে হাতের উপাদানগুলিকেই ব্যবহার করেছে বেশি।
শিষ্ট ভাষার বিকল্পে সৃষ্ট এই ‘নব ভাষা’ ক্রমে ক্রমে তার ভঙ্গিকে
পরীক্ষামূলক অবস্থা থেকে অনেকদূরে নিয়ে এসেছে। চীন-কোরিয়া থেকে সরে যেতে
জাপানী ভাষা অথবা জার্মান থেকে সরে যেতে ইংরাজি ভাষারও বোধহয় এমনি সুবিধা
ছিল। চট্টগ্রামের ভাষার তুলনায় আমাদের অন্যান্য উপভাষায় অর্জিত রূপের
প্রতিষ্ঠার সাধনা অল্প।